২০০৯ এর আগস্টের মাঝামাঝি । এক ঝকঝকে সকাল বেলা! এ’ দিনই আমার জন্ম। এটাকে ‘জন্ম’ বলব নাকি ‘সৃষ্টি’?
সে যাই হোক। চীন দেশের সিম্ফোনি কোম্পানির নাম তো আপনারা সবাই শুনেছেন? এ' বিখ্যাত পরিবারেরই এক গর্বিত সদস্য আমি। সিম্ফনি ডি ৩২।
আমার সহোদর ভাইয়ের সংখ্যা সাকুল্যে ১০ লাখের কাছাকাছি! তবে জন্মতিথিতেই নাকি দেড় হাজার বিকল হয়ে পড়ে ! যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে।
এসবই অবশ্য শোনা আমার দাদুর কাছ থেকে। বেইজিং এ একটা মোবাইল ফোন জাদুঘরে অবসর জীবন যাপন করছেন সিম্ফনি সিরিজের প্রথম প্রজন্মের এ’সন্তান।
সে এক সময় ছিল তাদের ! সারাদিন ইজি চেয়ারে বসে দোল খাওয়া। কত লোক বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকতো। আর আমার দেড় কেজি ওজনের যুবক দাদু মিটমিট করে হাসতেন।
কি বলছিলাম যেন? হ্যাঁ,আমার কথা।
জন্মের পরপরই এক সুদৃশ্য-সুগন্ধি ঝকঝকে প্যাকেটে মোড়ানো হল আমাকে। একেক কার্টনে আমরা ১০০ জন। এরকম প্রায় শতাধিক কার্টন কোন এক দুপুরে মালবাহী ট্রাকে যাত্রা শুরু করলো।
চলছি আমরা। চলছি তো চলছিই।
তখনো বুঝিনি - আমরা এয়ারপোর্টে!
কার্গোর ঘরঘরে আওয়াজে সেদিন কত স্বপ্নই যে এঁকেছিলাম কিশোর মনে!
এক সবুজ দেশে এলাম। বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে আসার পর আমরা ভাইয়েরা একেকজন একেকদিকে চলে গেলাম। আমরা ক’জন চললাম উত্তরবঙ্গের দিকে।
গন্তব্য ছিল রংপুর। এক অজানা আনন্দে ভরে উঠেছিল তণু-মন। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ‘মায়ের দোয়া ইলেক্ট্রনিক্সের’ কাঁচের টেবিলে আমাকে বিক্রির জন্য খোলা হল! শীতের কনকনে হাওয়ায় এক অদ্ভুত ভালোলাগায় সিক্ত হলাম সে’বার, দ্বিতীয়বারের মত।
নগদ ৪৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়ে গেলাম আমি । ‘বিক্রি’ বললে ভুল হবে । বলা উচিৎ ‘আমি সেবা দেয়া শুরু করলাম’। আমার নতুন ঠিকানা হল ঠাকুরগাঁও। আমার মনিব পেশায় ব্যবসায়ী। অখিল চন্দ্র পোদ্দার।
প্রথম ১ বছর আমি দুর্দান্ত সার্ভিস দিলাম। এরমধ্যে যে কিছুটা ‘বিটলামি’ করিনি তা নয়। মাস ছয়েক যেতেই আমার মনিব আমার প্রতি অবহেলা শুরু করলেন। রাতের বেলা তার শোবার বালিশের নিচে শ্বাসরোধ করে রাখা শুরু তখন থেকেই। আমিও শুরু করলাম ‘ঘাড় ত্যাড়ামি’।
কাউকে কল করলে এ'সময় মনিবকে শুনতে দিতাম না কিছুই। ফলাফল- ‘আমার স্পিকারটা চেঞ্জ’। মাস যায়। বছর পেরোয়। আমার স্বেচ্ছাচারী মনিব আমাকে বিক্রির জন্য এবার উঠেপড়ে লাগলেন।
১৫০০ টাকায় এবার আমি হাতবদল হয়ে গেলাম । চৈত্রের এক অলস তপ্ত দুপুরে।
কামরুজ্জামান সজল তালুকদার । আমার নতুন মালিক। তাঁর কথা বলা শুরু করলে আরেক ‘শাহানামা’ জন্ম নেবে। তবে এটুকু বলতে পারি সজল ভাই আমাকে যে ভালোবাসা আর মমতায় সিক্ত করেছেন তাঁর কাছে হাল আমলের আইফোন-৮ প্রীতিও নস্যি!
সজল ভাই এখন ডাক্তার। নামকরা ক্যান্সার স্পেসালিস্ট। তাঁর নতুন ফোনের সাথেই আমাকে রাখেন আজকাল। দিবা-রাত্রি।
আসছে আগস্টে আমার বয়স ৯ বছর পূর্ণ হবে। আমার সহোদররা আজ অধিকাংশই বেঁচে নেই। অনেকে বার্ধক্যে উপনিত। কেউবা ঘরের কোণে, ড্রয়ারে বা আলমারিতে অবসর জীবন যাপন করছেন। আমারও বয়স হয়েছে। জীবন সায়াহ্নে বসে বসে স্মৃতি হাতড়াই পুরোনো দিনের! কত কিছুই যে ঘটে গেল এ’ দু চোখের সামনে ! ব্ল্যাকবেরির যুগ শেষ হয়ে আজ এন্ড্রয়েড-আইফোনের যুগ। ওদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর ভাবি আমার যৌবনের কথা।
কতশত 'মিসকল', নির্ঘুম রাত্রির গল্পগাঁথা আর হাজারো টেক্সট্ মেসেজের নীরব সাক্ষী আমি। কি রঙিনই না ছিল প্রতিটি ক্ষণ।
বার্ধক্যের ছাপ আজ আমার শরীরে! ‘বাটনে’ পাক ধরেছে। ব্যাটারিতেও বদ হজম হয় মাঝে মাঝে । তাতে কি? সহস্র অভিজ্ঞতায় যে ঋদ্ধ তাকে কি ‘ওল্ড হ্যাগার্ড’ বলে ফেলে দেয়া চলে? সিম্ফনি পি-৬ কে চেনেন নিশ্চয়! আমার ছোট নাতনি। দেখতে কিন্তু বেশ।
রাত বাড়ে। আমার নাতনিও ব্যস্ত হয়! মাঝ রাতে ২-৩% চার্জ নিয়ে আমার পাশে এসে শোয়!
আমি তাকে গল্প শোনাই! ডিজুস আমলের ফ্রি টকিঙয়ের গল্প, ৭ টাকায় ১ মিনিটের ‘গল্প বলার গল্প’, ছেলে ছোকরাদের ফোন হাতে ‘স্টাইল মারার গল্প’ !
বিপ বিপ করে জ্বলতে থাকা জোনাকির মত সবুজ আলোয় আমার নাতনি ঘুমিয়ে পড়ে। আমি জেগে থাকি।
একা। বড় একা। _________________________________

إرسال تعليق