বেশ চিন্তিত হয়ে রাবেয়া বললো— এরকম নাক টেপা মেয়ে কেউ বিয়ে করবে না।
কইতরীর এসব কথায় কান নেই৷ সে চিন্তিতও না। ঘুমের মধ্যে নিজের অজান্তে পাশের জনের নাক টিপে ধরা কী বাজে অভ্যাস? একদম না।
হাল্কা রেগে বললো— উফ মা, তোমার জন্যই আমার একটা বিয়েও হয় না।
— এ কী রে? তোর কী কয়েকটা বিয়ে করার শখ আছে নাকি? আমার মান সম্মানটা মারিস না বাপ।
ভেঙচি দিয়ে— বড় বড় কথা বলো কেনো? নিজেই তো প্রেম করে বিয়ে করছো। আমি তো তাও করবো না। একটা বিয়ে করবো শুধু। তাও পারিবারিকভাবে। তুমি বারবার নাক টেপার কথা বলো কেনো?
রাবেয়া মাথায় হাত দিলো। হাফ ছেড়ে বললো— দেখ কইতরী৷ তুই আমাকে অনেক জ্বালাযন্ত্রণা দিছিস। আর দিস না৷ তুই লেখা পড়ায় নাম্বার ওয়ান৷ ভালো চাকরী করে নিজের একটা নাম করবি। তা না বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছিস। তার উপর ঘুমের মধ্যে অন্য কারো নাক টিপে ধরিস।
কইতরী দাঁত কামড়ে বললো— আরেকবার যদি নাক টেপার কথা বলো না, আমি বাবাকে বলবো পান না আনতে।
রাবেয়া বেগম ভয় পেয়ে গেলো। তাঁর কাছে জীবনের আরেক নাম পান। পান ছাড়া সে চলতেই পারে না। পানই এই মধ্যবয়স্ক মহিলার কাছে সব। দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো— মা আমার। তোর বিয়ে এই সপ্তাহেই দিয়ে দিবো। তাও তোর বাবাকে পান না আনতে বলিস না।
সুযোগ পেয়ে কইতরী বললো— নাক টেপার কথা পাত্রপক্ষকে বলে দিবে না?
মুখে হাত দিয়ে— তওবা তওবা, একদম না।
কইতরী কফির মগটা হাতে নিয়ে বললো— মনে থাকে যেন, যাও তাহলে।
সকাল সকাল মেজাজটা গরম করে দিলো মা এসে৷ সুন্দর একটা সকাল। কই একটু আরাম করে ঘুমাবে, তা আর হলো না।
জানালার পাশে দাঁড়ালো। হঠাৎ চিন্তায় পড়ে গেলো কইতরী। উত্তর খুঁজছে, সে হঠাৎ বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেলো কেনো?
শীত আসছে এজন্য? একদম না। একুশ বছর পেরিয়ে গেছে। কতগুলো শীতকাল গেলো। কখনো তো মনে হয়নি একটা জামাই দরকার।
নিজের অজান্তে মাথা নাড়াল সে।
কারো সাথে কী তাঁর প্রেমের সম্পর্ক আছে? না না। কখনো কোনো ছেলেকে ভালোই লাগেনি। কোনো বান্ধবীর কী বিয়ে হয়ে গেছে? তাও না। তাহলে কেনো সে মেয়ে হওয়া সত্বেও বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে বাড়িতে?
তাঁর মনে হয় শরম লাগা দরকার। লজ্জা পাওয়া উচিৎ। এসব কিছুই হচ্ছে না। এতো কিছু জানে না সে। একটা জামাই লাগবে ব্যাস!
–
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। পাত্র চাই। যোগ্যতা শুধু একটাই, পুরুষ হলেই চলবে। একটা ছেলে এসেছে। রাবেয়া পান চিবুতে চিবুতে বললো— তো তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও?
শার্টের কলার তুলে ছেলেটা বললো— না, আমি মরতে চাই।
রাবেয়া অবাক হলো। ভদ্রতা বলতে কিছুই নেই। পাত্রীর মায়ের সামনে কলার খাঁড়া করেছে! চট করে বললো— মানে?
ছেলেটা একটু হেসে বললো— কথায় আছে পুরুষ মানুষ দুই প্রকার। জীবিত, বিবাহিত। এখন পুরুষ আছি, আপনার মেয়েকে বিয়ে করে মরে যাবো।
রাবেয়া হাফ ছাড়লো। কথায় পাকা বুঝা যাচ্ছে। কড়া চাহনিতে জিজ্ঞেস করলো— তুমি করো কী? বিয়ে কেনো করতে চাও? আর তোমার বাসায় কে কে আছে?
ছেলেটা মজার স্বরে বললো— আমি ব্যবসায় ধরা খাই। আব্বা ডাক শুনার জন্য বিয়ে করবো। বাসায় বাবা আছে। একজন দারোয়ান আর কাজের মেয়েও।
রাবেয়া ছেলেটার দিকে তাকালো। চুলগুলো সুন্দর কিন্তু অপরিপাটি। চোখ দুটো কালো। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। বাদামী ঠোঁট। নাকটা মানানসই। গায়ের রং লাল কুমড়ার মতো আর লম্বা।
হঠাৎ মনে হলো ছেলেটার নামই জিজ্ঞেস করা হয়নি!
— ওহ আচ্ছা, তোমার নাম কী?
ছেলেটা জবাব দিলো না। পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে রাবেয়াকে দিলো। কার্ডে লেখা। ফুলবানু ট্রেডার্স। এখানে সুলভ মূল্যে আলু, পেঁয়াজ মরিচ সহ মনোহারি মালামাল পাওয়া যায়। প্রোপাইটর, উদয় আহমেদ।
মাথা নাড়িয়ে রাবেয়া বললো— তোমার সবচেয়ে বাজে অভ্যাস কী?
উদয় দুই আঙুল ঠোঁটের কাছে ধরে বললো— সিগারেট খাই। মারামারি করি। আরেকটা বাজে অভ্যাস আছে। সেটা আপনার মেয়েকে বলা যাবে।
রাবেয়ার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো— আমার মেয়েরও একটা বাজে অভ্যাস আছে।
আর বলতে পারলো না। কইতরী হাজির হয়ে গেলো! একটা পান হাতে নিয়ে বললো— আম্মাজান, পান খাওয়া কিন্তু সাস্থের জন্য ক্ষতিকর।
রাবেয়া বেগম হুঁশে ফিরলো। একটুর জন্য বলেই ফেলেছিলো নাক টেপার কথা। উদয় পাত্রীকে দেখে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! তবুও এমন ভাব নিলো যেন সে খেয়ালই করেনি! কইতরী লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বললো— আলুর বেপারির শরীরে মাংস কম কেনো?
–
রুমে লাল বাতি জ্বলছে৷ নীল চাদর বিছানায়৷ ভিবিন্ন ফুলের সমাহার। উদয় রুমে ঢুকতেই কইতরীর বুকের ভিতরে ধিকধাক শুরু হলো। আস্তে আস্তে দুজন কথাবার্তার নৌকা বেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কইতরী বললো— আপনি এমন কিছু করেন যা বাসর রাতে কোনো স্বামী করেনি।
এই বলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো কইতরী। হঠাৎ মনে হলো সে আটলান্টিক মহাসাগরে গোসল করছে! এক বালতি ঠান্ডা পানি নির্দ্বিধায় কইতরীর গায়ে ঢেলে দিয়ে উদয় বললো— আমি নিশ্চিত, বাসর রাতে এই কাজ কোনো স্বামী করেনি!
শীতে কাঁপতে কাঁপতে কইতরী বললো— তাই বলে পানি ঢেলে দিবেন? আপনি কী পাগল? না তারছেঁড়া?
উদয় উত্তর দিলো না। আলমারি থেকে একটা শাড়ি আনলো। কইতরীর হাতে দিয়ে বললো— গোসল করে এই শাড়িটা পড়ো। সুন্দর লাগবে।
কইতরী দাঁত কামড়ে বললো— কার শাড়ি?
উদয় দীর্ঘশ্বাস টেনে বললো— আমার প্রথম স্ত্রীর।
কইতরী চিৎকার দিয়ে উঠলো! এ হতে পারে না৷ বেঈমান, প্রতারক বলে উদয়ের বুকে ঘুষি দিতে লাগলো। কান্নাস্বরে বললো— আমি তোর কত নাম্বার স্ত্রী সত্যি করে বল?
ঠাস করে কইতরীর গালে একটা থাপ্পড় দিলো রাবেয়া৷ একটা দিয়ে মন ভরেনি। দুই গালে আরো একটা করে থাপ্পড় দেয়ার পর বললো— আগে তো শুধু নাক টিপে ধরতি। এখন কিল ঘুষি যোগ হয়েছে? দেখ আমার ঘাড় লাল করে ফেলছিস!
কইতরী থাপ্পড়ের চোটে উঠে বসে পড়লো। সত্যিই মায়ের গাল লাল করে দিয়েছে! হঠাৎ ফিক করে হেসে দিয়ে বললো— আম্মা, তোমার জামাই খুব বদ।
রাবেয়া আরো তিনগুণ রেগে গেলো— একটা কথাও বলবি না তুই। তোর বাপের মতো ভালো মানুষ এই মহল্লায় আর নাই।
কইতরী আয়নার সামনে গিয়ে নিজের গালে হাত দিয়ে বললো— উফ মা, আমার জামাইয়ের কথা বলছি।
রাবেয়া মাথায় হাত দিয়ে বললো— তুই গেলি একেবারে৷ মানসিক ডাক্তার দেখাতে হবে।
কইতরী ভেঙচি দিয়ে— আলুর বেপারির নাম্বারটা দাওতো।
— নাম্বার তো রাখিনি।
কইতরী চোখ বড় বড় করে বললো— কোন আক্কেলে যে আব্বা তোমার মতো একটা বেয়াক্কল মহিলাকে বিয়ে করছে কে জানে!
–
কইতরীর ইচ্ছে ছিলো শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়া করবে। রাগ করে বলবে— নিজের মেয়ে হলে এরকম করতে পারতেন আম্মা?
কিন্তু তা আর হলো না। উদয়ের মা নেই। বাবা আছে। সারাদিন বাইরেই থাকে।
— আউচ।
বলে চিল্লান দিয়ে উঠলো কইতরী। কে জানি নাক টিপে ধরেছে। শ্বাস নিতে পারলো না তাই ঘুম ভেঙে গেছে। পাশে তাকিয়ে দেখে উদয়! কইতরী জিদ্দি হয়ে উদয়কে খামচে ধরলো! উদয় জেগে বললো— করছো কী? পাগল হয়ে গেছো নাকি?
— আপনি আমার নাক টিপে ধরছেন কেনো?
উদয় চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। বাচ্চাদের মতো নিস্পাপ ভাব নিয়ে বললো— এটাই আমার সবচেয়ে বাজে অভ্যাস! সেদিন তোমার মাকে আমি বলিনি।
কইতরী মাথায় হাত দিয়ে বললো— হাইরে কপাল। সিগারেট খান, মেনে নিছি। মারামারি করে জরিমানা দেন, মেনে নেই। সারাদিন কাজের উপরে রাখেন, কিছু বলি না। কিন্তু নাক টিপে ধরেন কেনো? এটা মানতে পারবো না।
উদয় কানে ধরে বললো— চিল্লাচিল্লি করো না। হানিমুন করতে এসে কেউ চিল্লায় না। হোটেলের মানুষ সব জড় হয়ে যাবে।
কইতরী কান্না করতে করতে বললো— তোর হানিমুনের গোষ্ঠী কিলাই। তুই আমার নাক টিপে ধরছিস কেন?
উদয় এবার বুকের সিনা টান করে বললো— তুমি যে প্রতিদিন নাক টিপে ধরো সেটা কী? আমি সহ্য করে যেতে পারলে তুমি কেনো পারবে না?
কইতরী আঙুল তুলে বললো— তুই ছেলে মানুষ। সহ্যই করবি। আমি পারবো না। আগে জানলে তোকে বিয়ে করতাম না। আম্মা, তোমার মেয়ের কপালে একটা নাক টেপা জামাই জুটছে, দেখে যাও।
— ন্যাকা কান্না বন্ধ করো। উফ অসহ্য।
কইতরী এই রাতের বেলাতেই ব্যাগ গোছাতে লাগলো। সোজা বাপের বাড়ি চলে যাবে। ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ম্যানেজার বললো— ম্যাম, কোনো সমস্যা? এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?
— মরতে যাচ্ছি, আপনি যাবেন?
— না ঠিকাছে, শুভ কামনা আপনার জন্য। আশাকরি সাবধানে মরবেন।
হোটেল থেকে বেরিয়ে ভাবতে লাগলো কইতরী। কতটুকু বাজে উদয়। একে তো নাক টেপা ছেলে। তার উপর আটকালো না। এত রাতে একটা মেয়ে কোথায় যাবে?
এখন তো হোটেলেও ফেরা যাবে না। লজ্জার ব্যাপার। উদয়কে একটা ফোন করা যায়।
— হ্যালো, শুনছেন? আমি কিন্তু চলে যাচ্ছি।
— ঠিকাছে, সাবধানে যেয়ো।
বলে ফোন কেটে দিলো। মেজাজ আর ধরে রাখতে পারলো না কইতরী। হোটেলে ফিরে আসলো। ম্যানেজারের সাথে আলাপ করছে উদয়। সোজা উদয়কে ধাক্কা দিয়ে বললো— ফকিন্নির বাচ্চা। আমাকে আটকাস না কেন? নাক টিপে ধরার সময় খেয়াল থাকে না?
উদয় মুচকি হেসে বললো— ম্যানেজার সাহেব কিছু মনে করবেন না। আমার নিকনেইম ফকিন্নির বাচ্চা।
ম্যানেজার হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললো— নাইস নেইম।
উদয় মুচকি হাসি দিয়ে কইতরীকে নিয়ে রুমে চলে আসলো।
— আবার ফিরে আসলে কেন? একদিন তো শান্তিমত ঘুমাতে পারতাম। কেউ নাক টিপে ধরতো না।
কইতরী গালগোল ফুলিয়ে বললো— তুই যে ধরিস, তার কী হবে?
— তুইতুকারি করবে না। তুমি একটা নাকটেপি। তোমার সাথে ঘুমানো দায়।
কইতরী উদয়ের নাকটা আবার টিপে ধরে বললো— তুইও একটা নাকটেপা। তোর সাথে খুব ঘুমানো যায়?
• টেপা-টেপি
~ সিয়াম আহমেদ জয়
إرسال تعليق