থ্রীলার গল্প। অতীত কুৎসিত ভবিষ্যত | লেখা: Masud_Rana


বক্সিং এরিনার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ। হাতের এই ব্যাগটার ভেতর যে জিনিসটা আছে সেটার ইতিহাস যদি এখানকার একটা লোকও জানতো তাহলে স্টেজে আজ কিছুতেই তাকে উঠতে দিত না। এমন কি এখানকার সিকিউরিটিতে থাকা লোকগুলো সোজা তার বুক বরাবর গুলি চালিয়ে দিত। পুলিশ তাকে লকাপে ঢোকাতে টানা-হেঁচড়া করে বেড়াত। কিন্তু জানে না কেউ কিছু। এমনকি আন্দাজও করতে পারছে না। কিন্তু বড় দেড়ি নেই। এই জীর্ণ ছোট ব্যাগটার ভেতর গত ৩ বছর ধরে সে কী নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তা আর আধা ঘন্টা পরেই সবাইকে দেখিয়ে দেবে সে। নিজের বিশাল থলথলে চর্বিওয়ালা শরীরের দিকে একবার তাকালো সে। ৩ বছরে শরীরের ওজন বাড়িয়েছে সে ৩ গুন। দেখলে নাদুস-নুদুস হলেও এই মেদ ভরা শরীরে যে তার কত শক্তি জমা আছে তা জানে না কেউই। এই ৩ বছরে যত শক্তি অর্জন করেছে সে সব আজ দেখানোর সময়। সব শক্তিকে ক্রোধে বদলে দেবে সে। এই দিনটার জন্যই এতদিন অপেক্ষা করে ছিল। ঐতো এগিয়ে আসছে তার দিকে আরেকটা ছেলে।

ছেলেটা একেবারে তার শরীরের বিপরীত। এই ছেলেটার শরীর একেবারে মেদহীন, জীম করা, সুঠামো। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। মুখে দুষ্ট হাসি। ছেলেটা এসেই তার স্তনে একটা খোঁচা মেরে বলল, 'কিরে বেটা এগুলো তো সব ঝুলে যাচ্ছে, বলতো কাউকে দিয়ে একটা ব্রা আনিয়ে দেই!' ছেলেটার পেছনে থাকা ওর বন্ধুরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সে অপমানিত বোধ করলো না। তার মুখ গম্ভীর। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুধু দেখতে পারছে একটা বিশ্রী অতীত আর একটা কুৎসিত ভবিষ্যতকে। তার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ছেলেটা পুনরায় তার পেটে একটা গুঁতো দিয়ে বলল, ' তোর ওটা আজ ফাটিয়ে তারপর খেলা শেষ করবো। এম্বুলেন্স ডেকে রাখিস। নাহলে রিকশায় করে তোকে আজ হাসপাতালে নিতে তিন চারবার টায়ার বদলাতে হবে।' ছেলের দল তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
ছেলেগুলো চলে যেতেই একটা বিকৃত হাসিতে তার মুখটা ভরে গেল। এই হাসিটা দেখলে হয়তো ছেলেটা এইসব কথা বলার সাহস করতো না। আজকের ফাইট টা দেখতে অনেক দর্শক এসেছে। সে জানে বেশির ভাগ দর্শকই তাকে সমর্থন করবে না। দর্শকদের আকৃষ্ট করার কোনো গুণই তার নেই কেবল বৃহৎ এই দানব আকৃতির শরীরটা ছাড়া।
মঞ্চে ছেলেটা উঠতেই ছেলেটার নামের জয়ধ্বনিতে চারপাশ ভরে গেল। পরক্ষণে সেও যখন মঞ্চে উঠল তখন সেই হৈচৈ আরো বেড়ে গেল। সবার আগ্রহ আরো বেড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ 'মটু-পাতলু, মটু-পাতলু' বলে চেঁচাচ্ছে। এই মঞ্চে সকলেই ওঠে ম্যাচ জেতার জন্য। কিন্তু ৩ বছর অপেক্ষার পর সে আজ উঠেছে শুধু ম্যাচ নয়, নিজের জীবনের সঙ্গে চলা বৃহৎ এক যুদ্ধের জয়ের জন্য।
মঞ্চে উঠেই তার চোখ গেলো গ্যালারির সামনের সাড়িতেই বসে আছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছেলেটার মা-বাবা,বড় ভাই। তাদের ঠিক পাশেই আধুনিক পোশাক পরা এক রূপসী মেয়ে। ছেলেটা এই মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে একটা উড়ন্ত চুমো ছুড়লো। এটা যে ওর প্রেমিকা বুঝতে বাকি নেই। ওড়া সব বড়লোক জানে সে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছেলেটার বাবা বড় ব্যবসায়ী, ওর এক মামা সরকারদলীয় এক বড় নেতা। মামাকে দেখা যাচ্ছে না যদিও দর্শকদের ভেতর।
সে ভাবে এমন একটা পরিস্থিতিই সে চেয়েছিল। সে নিজে সরাসরি ওদের প্রতিক্রিয়া দেখবে আজ। এটা দেখলে হয়তো নিভতে পারে তার ভেতরে ৩ বছর ধরে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখাটা।
বাঁশি বেজে উঠল। চারপাশের মানুষের হৈচৈ , উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল। আজ যে জিতবে সেই চলে যাবে কোয়াটার ফাইনালে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছেলেটার নাম রাসেল আর তার নাম সুমন।
সুমনের মোটা শরীরের দুর্বল জায়গা লক্ষ্য করে প্রথমেই হামলে পড়লো রাসেল। আক্রমণ করার কোনো চেষ্টাই করছে না সুমন। শুধু নিজের শরীর একিয়ে-বাঁকিয়ে মাথাটাকে আঘাতের হাত থেকে রক্ষা করছে সে। ছেলেটার আক্রমন করা দেখেই সে বুঝতে পারলো তার বক্সিং দক্ষতা নিয়ে কোনো ধারণাই নেই ওর। ও তাকে ভাবছে নুব বক্সার। আরও কিছুক্ষণ চলল এমন ছুটো-ছুটি। তার নাজেহাল অবস্থা দেখে আশেপাশের সবাই মজা পাচ্ছে। কেউ বলছে, ' এই মটু বাচ্চাটাকে কে ওখানে ছেড়ে দিয়ে গেছে রে, অলেলেলে...!' এমন সময়েই প্রথম আঘাত হানলো সে। একেবারে পাঁজর বরাবর। এই প্রথম প্রতিপক্ষ বুঝতে পারলো তার ভেতর কতটুকু শক্তি জমা আছে। আছাড় খেয়ে বসে পড়লো রাসেল। এক মুহূর্ত নীরবতা পরের মুহূর্তেই সবাই আবার হৈহৈ করে উঠল এই চমক দেখে। এবার সবাই 'সুমন, সুমন' করে চেঁচাচ্ছে।
খানিক থেমে আবার শুরু হলো লড়াই। এবার সুমন আক্রমণ চালালো ওর উরুর নিচ বরাবর। ভয়ঙ্কর কষ্টের এক আর্তনাদ করে বসে পড়লো রাসেল স্টেজে। রেফারি তাকে থামতে বলল। কিন্তু সে পাত্তা দিল না। এগিয়ে গিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ঘুষি মারলো ওর চোয়াল বরাবর এরপর মাথার পেছনে। এটা এমন এক আঘাত যে আঘাতের পর টু শব্দটি করার হুস কারো থাকে না।
রেফারি ঘটনা বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে একাই টেনে সুমনকে পেছনে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। সুমনের চোখে-মুখে তখন পৈশাচিক ক্রোধ। সে তার চোখের সামনে একটা সুদর্শন ছেলে বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং দেখছে এক খুনিকে, এক ধর্ষককে। এই সুন্দর চেহারার পেছন থেকে সে রাতে যে বেরিয়ে এসেছিল এক পশু সে কথা এখানকার অনেকেই জানে না। ৩ বছর আগের সেই রাত। ভার্সিটির নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে ওর মিষ্টি বোনটাকে সেদিন তুলে নিয়ে যায় এই ছেলেটা। এরপর। এই দেশে যা হবার তাই হলো। পুলিশ, ডাক্তার , আইনের লোকেরা প্রমাণ করলো ওর বোন একটা বেশ্যা। তার পরিবার এক বেশ্যার পরিবার। বেশ্যার পরিবার নাকি দেশের উচ্চবংশের একটা পরিবারকে ছোট করতে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের ফন্দি এটেছিল। সকলে একমত হয়েছিল। তাকে সহ তার পুরো পরিবারকে আটকে রাখা হয় প্রতারণার মামলায়। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে তার বোনের চরিত্রহীনতার খবর। অথচ মুক্ত আকাশের নীচে ঘুরে বেড়ায় তখন রাসেল।
অবশ্য জেল থেকে কিছুদিন পর বিনা শর্তে মুক্তও করে দেয়া হয় ওদের। মিথ্যা মামলায় বেশি শাস্তি না দিয়ে দয়াই দেখায় তারা। লজ্জা একটু বেশি বলেই বোন আর বাবা-মা নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়ে আত্মহত্যা করে। দেশে খবরে অবশ্য ছড়িয়েছিল 'হঠাৎ লেগে যাওয়া আগুনে পুড়ে একই ঘরে বাবা-মা আর মেয়ের মৃত্যু'। লজ্জা আর সাহস কম বলেই মরতে পারেনি একা সুমন। সামান্য একটা চাকুরী করে মেরুদণ্ড এমনিতেই আধা ভাঙা ছিল তার। মরবে সে জানতো। তবে খোদার কাছে আরও কয়েকটা বছর সময় চেয়ে নিয়েছিল সে। তার পরিবারের মৃত্যুকে চাপা দিয়ে রাসেলকে সেদিন যারা রক্ষা করে গিয়েছিল সেই ডাক্তার, পুলিশ, উকিল যে পরের কয় বছরে নতুন ফ্ল্যাট-গাড়ি পেয়েছিল এর খবর সে বাদে আর কেউ বুঝি পায়নি। পেলে দেশে একটা হট্টগোল লেগে গেল না কেন! কিংবা রাসেলের মামার সংস্পর্শে থাকা সেই মন্ত্রী সাহেবের নামে রাসেলের বাবার করা একটা বহুতল মার্কেট কী করে হয়ে গেল এই প্রশ্ন ওতো কারো মনে আসেনি!
তবে আজ ওরা কোথায়! দেখ রাসেল, তোর সামনে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। অচেতন রাসেলের মুখে মাথায় নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছে সে। মরে গেছে ও। মরুক! যতক্ষণ না ওর মাথা থেতলে মগজ বেরিয়ে আসছে ততক্ষণ সে থামবে না। এরমধ্যে শরীরের সমস্ত ওজন সে চাপিয়ে দিয়েছে রাসেলের বুকের উপর। তার শরীরের ওজন সহ্য করতে না পেরে মচমচ করে পাঁজরের হাড় গুলো ভেঙে যেন মাংসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে সব। এই অনুভূতি। আহা! এক পৈশাচিক সুখের অনুভূতি দিচ্ছে তাকে। পেছন থেকে দলে দলে লোক ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার উপর। ছাড়িয়ে নিতে চাইছে তাকে। মানুষের আতংক, হট্টগোল কিছুই অবশ্য তার কানে ঢুকছে না। ঐতো রাসেলের বাবা-মা আর্তনাদ করে ছুটে আসছে। সেদিন আদালত থেকে বের হওয়ার সয়ে ওদের মুখের গর্বে ভরা হাসির কথা মনে পড়লো তার।কেমন লাগছে আজ! ছেলেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে না! এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই সে ৩ বছর অপেক্ষা করেছে। কেমন লাগে দেখ এবার হঠাৎ জীবনে অন্য কারো মনোবাসনা পূরণের জন্য নিজের সুখের সংসার তছনছ হয়ে গেলে! এক ধাক্কায় পেছনের সবগুলো লোককে ফেলে দিল সে। মঞ্চে রাসেলের থেঁতলে যাওয়া মরা শরীর পড়ে আছে।
জীর্ণ ব্যাগটি থেকে সে বের করলো একটা কামিজ। এই কামিজটা পড়েই সে ভোরে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকেছিল তার মিষ্টি বোন। কামিজটা মাথার কাছে নিয়ে নিজের মাথা ঢোকাতে চেষ্টা করে সে। কামিজটা পরবে সে। আজ থাকুক এই কামিজ তার পরনে। সবাই দেখুক কেন করেছে সে কাজটা। আলোচনায় আসুক এটা, মুখোশ খুলে যাক পশুগুলোর। কিন্তু তার মোটা শরীরে এই কামিজ ঢুকবে কী করে। রাসেলের শরীরের দিকে তাকাতেই এক অনাবিল হাসিতে ভরে গেল সুমনের মুখটা। ওর মাথা একটু উঁচু করে কামিজটা ওর গলা দিয়ে পরিয়ে দিল সে। চিৎকার করে বলল, ' দেখ দুনিয়া! এই ন্যায়বিচার!'
একসাথে লাঠির অনেকগুলো আঘাত এসে পড়ল তার উপর। একটা গুলির শব্দ। কিন্তু এসব আর পরোয়া করে না সে। তার প্রয়োজন এখানে ফুরিয়েছে। ( শেষ )
বিশ্রী অতীত কুৎসিত ভবিষ্যত
লেখা: Masud_Rana

Post a Comment

أحدث أقدم