গল্পঃ এ উইজার্ড।লেখক : হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।পর্ব - ১২


গল্পঃ এ উইজার্ড । পর্ব - ১২
লেখক : হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।
আলিসা চোখ বন্ধ করে তার ক্ষমতা ব্যাবহার করে ফাহাদকে তুলে আনার জন্য, ফাহাদের দিকে হাত বাড়িয়ে মনে মনে মন্ত্র উচ্চারণ করে। মুহূর্তেই ফাহাদের চারপাশ কালো ও বেগুনী রঙে আবৃত হয়ে যায়। কিন্তু ফাহাদকে এক চুল পরিমাণ ও নাড়াতে পারছিলো না সে।তার মন্ত্র ফাহাদের উপর কাজ করছিলো না। চট করে আলিসা সিদ্ধান্ত নেয় ফাহাদকে তীরে আনতে হবে।
আলিসা দ্রুত গতিতে ফাহাদের দিকে এগিয়ে যায়।
কিন্তু জলাধার টা এমনভাবে বানানো ছিল যে ফাহাদের কাছে পৌঁছাতে হলে আলিসাকে পানিতে নামতে হবে। আলিসা লাফ দিয়ে ছোট্ট পুকুরের মত জায়গাটায় নামে। কিন্তু নামার পরপর সে ভালো ই অবাক হয়। উপর থেকে দেখে ঠিক যতখানি গভীর মনে হয়, আসোলে ততখানি গভীর নয়। হাঁটুজল পানি। পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে আলিসা যখন ফাহাদের দিকে এগুচ্ছিলো তখন পানিতে ঢেউ উঠে টলমল টলমল একটা অদ্ভুত শব্দ হচ্ছিলো। হলুদ রঙের ফুলটা খুব সুন্দর করে পানিতে দোল খাচ্ছিলো তখন। আলিসা ফাহাদের কাছে পৌঁছে ফাহাদের দুদিকে ছড়ানো হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। শরীরটা অসাড় হয়ে আছে। ফাহাদকে কোলে তুলে পাড়ে নিয়ে যাওয়ার মত শক্তি আলিসা পাচ্ছিলো না তখন। নিজের উপর রাগ হচ্ছিল তার।নিজের উপর কনফিডেন্স না থাকার কারণে এমন হচ্ছে,এটা ছিলো আলিসার ধারণা।কোনমতে সে ফাহাদকে টেনে হিঁচড়ে তীরে তুলে আনতে সক্ষম হলেও কয়েকবার সে আছাড় খেয়ে পানিতে পরে যায়। পানিতে আলিসার চুল সহ সমস্ত শরীর ভিজে যায়। কিছুটা ঠান্ডা লাগতে থাকে তার।
তীরে আনার পরে ফাহাদের বুকে কান পাতে আলিসা। হৃদপিন্ড খুব স্লোলি পাম্প করে চলেছে। কিন্তু তার নিশ্বাস বন্ধ। গায়ের প্রায় ছিড়ে যাওয়া টি শার্ট টি সে টেনে খুলে দেয়। পেটে ও বুকে পানি ঢুকে যাওয়ায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আছে ফাহাদের। আলিসা ফাহাদের বুকের উপরে এখাতের উপরে অন্য হাত রেখে বেশ কয়েকবার চাপ দেয়। মুখ থেকে কিছু পানি বের হয়ে আসলেও শ্বাস নিচ্ছিলো না ফাহাদ। ফাহাদকে একট হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাথরের দেয়ালের কাছে নিয়ে পা উপরের দিকে ঠেস দিয়ে আবার ও কয়েকবার বুকের উপর দু হাত দিয়ে চাপ দেয় আলিসা। এবার নাক ও মুখ দিয়ে গলগল করে বেশ অনেকখানি পানি বের হয়ে আসে। এর পরেও শ্বাস প্রশ্বাস চালু হওয়ার কোন লক্ষন না দেখে আলিসা সিদ্ধান্ত নেয় ফাহাদের ফুঁসফুঁসের ভিতর বাইরে থেকে বাতাস পুশ করবে। কিন্তু পদ্ধতিটির কথা ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় আলিসা। নষ্ট করার মত সময় এখন আলিসার হাতে নেই। এদিকে মেয়ে সুলভ একটা লজ্জাবোধ ও কাজ করছে। নীল আলোতে ফাহাদের উন্মুক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে আলিসার গায়ের লোম গুলোতে একবার শিহরণ বয়ে যায়। সময় নষ্ট না করে আলিসা বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে এক হাত দিয়ে ফাহাদের মুখটা একটু ফাঁকা করে অন্য হাতে নাক চেপে, নিজের মুখ লাগিয়ে দিয়ে বেশ অনেকখানি বাতাস ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এভাবে আরো একবার। তারপর আবার সে বুকের উপর হাত দিয়ে চাপ দিতে শুরু করে সে। পরপর প্রায় সাতবার ক্রমাগতভাবে মুখ দিয়ে ফুঁসফুঁসে বাতাস পাম্প করে আবার বুকে প্রেসার দেয়ার পর, হঠাৎ করেই কাঁশি দিয়ে চোখ খুলে ফাহাদ। ধড়ফড় করে উঠে বসতে চেয়েও পরে যায় সে। ফাহাদের চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে গিয়েছে। এতক্ষন কি হয়েছে কিছুই মনে নেই তার। শুধু মনে আছে, ফাঁটল ধরে যখন এগিয়ে আসছিলো তখন ওখানে থাকা লতার মত মোটা শিকড়গুলো তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো বার বার। শরীরের বেশ কিছু জায়গায় সুঁচালো মাথা ঢুকিয়ে রক্ত চুষে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু লকেটের শক্তির কারণে ফাহাদের শক্তির সাথে পেরে উঠছিলো না ওরা। সবগুলোকে কেটে কেটে সামনের দিকে এগিয়ে যখন শেষ প্রান্তে জলাধারের পাশে এসে দাঁড়ায়, ঠিক তখন ই উপর থেকে একটা শিকড়ের মাথা মাটি ভেদ করে বেরিয়ে এসে ফাহদের গলা থেকে লকেট টা বের করে ফেলার জন্য টান দেয়। আলিসার সাথে ঝামেলা হতে পারে ভেবে ফাহাদ আগেই স্বর্ণের চেন সরিয়ে তার বদলে বদলে অধিকতর শক্ত এবং সহজে কেটে ফেলা যায়না এমন, ফাইবারে লকেট টা লাগিয়ে সেটা গলায় ঝুলিয়েছিলো । তাই শিকড় যখন ফাহাদের শরীর থেকে লকেটের চেন টা ধরে টান মারে তখন ফাহাদের নিজের শরীর ও লকেটের সাথে উপরে উঠে যায়। একপর্যায়ে মাথা গলিয়ে সেটা শিকড়ের সাথে থেকে যায় এবং ফাহাদ নিচের পানির ভেতরে পরে।ফাহাদের লকেটহীন শরীর দুর্বল এবং এগারোফোবিয়ায় আক্রান্ত থাকায়, উপর থেকে নিচে পরে সে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপর আর তার কিছু মনে নেই।ফাহাদের মাথায় এখন একটা চিন্তা ই ঘুরছে, আলিসা তার লকেট টি হাত করে নেয় নি তো!!চারদিকের পরিবেশে চোখ বুলাতেই ফাহাদের মনে আগের মত ভয় টা কাজ করা শুরু করে। আলিসার দিকে সে ভয়ার্ত আর অনিশ্চয়তার চোখে তাকায়।
হঠাৎ
ফাহাদের জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখে আলিসা খুব খুশি হয়। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে আলিসা ফাহাদের ঠোঁটের উপর নিজের ঠোঁট রেখে চোখ বন্ধ করে দেয়।
নীল আলোয় আলিসাকে যেন অপ্সরীর মত লাগছিল। ফাহাদের মনে কোন কালেই কোন মেয়ের জন্য কোন রকমের অনুভূতি ছিলো না।তবে আলিসাকে আজ তার অন্য সব মেয়ে থেকে আলাদা লাগছে।এই ভয়ংকর পরিবেশে তার সবচেয়ে আপন ব্যাক্তি যেন আলিসা ই। আলিসার ভেজা চুলগুল ফাহাদের চোখমুখ ঢেকে দিয়েছে। ফাহাদের ইচ্ছে করছে এ আলিসাটাকে জড়িয়ে ধরে যদি কাটিয়ে দিতে পারত সারাজীবন!!ফাহাদ আলিসার মাথার পিছনে হাত নিয়ে চুলগুলো মুঠি করে ধরে নিজের ঠোঁটের সাথে আরেকটু বেশি করে চেপে ধরে। আলিসা ততক্ষনে পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছে। তবে ফাহাদের শরীর ছিলো বেশ ক্লান্ত।ক্লান্ত থাকলেও সব কিছুর পরেও সত্যি কথা হলো সে একজন পুরুষ।তার উপর অপ্সরীর মত একটা সুন্দরী মেয়ে তার খুব কাছে রয়েছে।এতটাই কাছে যে একজনের নিশ্বাসের গরম অন্যজন অনুভব করতে পারছে।নিজেকে ধরে রাখার সাধ্য পৃথিবীর কোন পুরুষের থাকতে পারে কিনা জানা নেই। ফাহাদের ছিলো না। যুদ্ধ শেষে ক্লান্ত বীর ঘরে ফিরে এসে যেমন তার প্রিয় রমনীর সাথে আবারো ভালোবাসার যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিজের ক্লান্তি দূর করে,ঠিক তেমনি ফাহাদ এবং আলিসাও স্বচ্ছ জলাধারের তীরে নীল আলোতে অসম্ভব সুন্দর এক পরিবেশে একে অপরকে পরীপূর্ণতা দিয়ে চলেছিলো। হাজারো মৃত মানুষের দেহে পরিপূর্ণ পিরামিডের অভ্যন্তরে এরকম একটা স্বর্গীয় পরিবেশে ফাহাদ জীবনে প্রথম পুরুষত্বের স্বাদ পাবে, সেটা ছিলো তার কল্পনার বাইরে । টপ টপ করে পানির ফোঁটা পরার পরিষ্কার আওয়াজের সাথে তাদের দুজনের ভারী নিশ্বাসের শব্দ। এর মাঝেই একজোড়া নারী-পুরুষ কিছুক্ষনের জন্য দুজনের মাঝে হারিয়ে যায় দুজনেই।
.
.
.
.
.
ফাহাদের বুকে মাথা রেখেই পাথরের তৈরি মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে আলিসা। ফাহাদ আলিসার মাথার নিচে আলিসার ভিজে জামাকাপড়গুলো রেখে নিজে উঠে পরে। পানিতে নেমে গোসল করতে করতেই সে আলিসার ঘুমন্ত দেহে চোখ বুলায় ।মনে মনে ভাবে এই আলিসাকে সারাজীবনের জন্য পেতে হবে তাকে। তা যে করেই হোক না কেনো!!
গোসল করার শব্দে আলিসার ঘুম ভাংগে। আলিসাও বিন্দুমাত্র না সরে শুধু চোখ মেলে ফাহদের গোসল করা দেখতে থাকে। অনেকটা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আলিসার নখ বসিয়ে দেয়া জায়গাগুলোতে পানি দিচ্ছে ফাহাদ। আলিসা তার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে ফাহাদের ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সে পানির ভিতরে থাকা হলুদ ফুলটার দিকে এগিয়ে যায়। মনে মনে ভাবে পৃথিবীর এই ভীষন দুষ্প্রাপ নামহীন ফুল দিয়ে আলিসাকে প্রোপোজ করবে। এই ফুলটার নাম তো অজানা, ফাহাদ ভাবে সে এই ফুলটার নাম দিবে এলেস ফ্লাওয়ার। ভাবতে ভাবতেই ফুল ছিড়ে হাতে নেয় সে। এরপর ই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা, ছেড়ার সাথে সাথেই ফুলগাছ টি শুকিয়ে যায়, যেখানে গাছটি ছিলো সেখানে একটা গর্ত সৃষ্টি হয় এবং পানি সব বের হয়ে যায়। সাথে সাথে আশেপাশের বড় ও মোটা শিকড় গুলিও শুকিয়ে সবুজ থেকে খয়েড়ি রঙ ধারণ করে। যে শিকড়টায় লকেট টি আটকে ছিলো সেটি লকেটসহ ভেংগে আলিসার পাশেই পরে।আলিসা ঘটনার আকস্মিকতায় উঠে আসতে চাইলেও সে ব্যার্থ হয়।নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হতে থাকে আলিসার। সে যেন নড়তেই পারছে না।
ফাহাদ এ অবস্থা দেখে আলিসার কাছে দৌড়ে আসে। কাছে আসতেই আলিসা ফাহাদকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার খুব দুর্বল লাগছে ফাহাদ। ভাংগা শুকনো শিকড়ের দিকে তাকিয়ে ফাহাদ দেখতে পায় তার নীল লকেট টা পরে আছে। ওটা হাতে নিয়ে গলায় দিতেই তীব্র পরিমাণ নীল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে চারপাশ। আলিসা ফাহাদের কাছ থেকে ছিটকে গিয়ে বেশ কয়েক হাত দূরে গিয়ে পাথরের সাথে আছড়ে পরে।
ফাহাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে নীল আভা কমে আসে।চারপাশ বেশ অন্ধকার হয়ে যায়। সে অন্ধকারে জ্বলতে থাকে ফাহাদের গলার নীল লকেট এবং ফাহাদের মনি হীন চোখ দুটি।
লকেট গলায় দেয়ার পর পরই ফাহাদের তার নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হতে শুরু করে।একটা ডায়নীর সাথে কিছুক্ষন আগে এটা কি করল সে!! না না এটা মেনে নেয়া যায়না। আলিসা তার শত্রু,একটা ডায়নী নিজে নিজে আফসোস করতে করতে পাথরের গায়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয় ফাহাদ। সাথে সাথে পাথরটির মাঝখান থেকে ফাটল ধরে।
আলিসার জন্য নিয়ে আসা ফুলটা সে পা দিয়ে পিষে ফেলে । মনে মনে ভাবতে থাকে আলিসাকে মেরে ফেলার এটাই হয়ত মোক্ষম সুযোগ। পরে আর এমন সুযোগ নাও আসতে পারে। কিন্তু পরক্ষনেই আবার মাথায় আসে লাল লকেট উদ্ধার করার জন্য একমাত্র আলিসা ই আছে যে তাকে সাহায্য করতে পারবে। এদিকে আলিসা ফাহাদের দিকে তাকিয়ে ভয়ে জড়োসরো হয়ে পরেছে। ফাহাদের গলায় যে লকেটটি জ্বল জ্বল করছে তা আলিসার বইয়ে আঁকা লকেটের মত ই হুবুহু দেখতে তবে সেটা লাল। এই পৃথিবীতে সব কিছুর বিপরীত জিনিস রয়েছে, যেমন ভালো-মন্দ, রাত -দিন, এমন হয়ত লাল লকেটের ও বিপরীত লকেটটি ফাহাদের গলায় ঝুলছে। লাল লকেট আলিসাকে আরো বেশি পাওয়ারফুল বানালেও নীল লকেট টি তার দুর্বলতার অন্যতম কারণ, ফাহাদ ও আলিসা দুজনেই এটা বুঝতে পারে। ফাহাদ পা দিয়ে লাথি দিয়ে আলিসার জামাকাপড় গুলো ওর দিকে এগিয়্ব দেয়। গম্ভীর কন্ঠে বলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। ফাহাদ হাতে একটা টর্চ নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ফাহাদ সেখান থেকে চলে যেতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আলিসা অনুভব করে তার শক্তি সে ফিরে পেয়েছে। এবং সে প্রথমেই তার ক্ষমতার দ্বারা ফাহাদের টি শার্ট টি কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়। এরপর নিজের জামাকাপড় পরিধান করে নেয়। ফাহাদের পা দিয়ে পিষে ফেলা দুর্লভ ফুলটাকে সে সযত্নে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে। ইচ্ছে করলেই এ ফুলটাকে আগের মত অক্ষত বানিয়ে ফেলতে পারলেও আলিসা তা করে না। পিষে যাওয়া অবস্থায় ই তার ব্যাগের ভিতরে ফুলটা সযত্নে রেখে দেয়। এরপর সুরঙ্গ থেকে বের হতে তার আর কষ্ট হয় নি । একটু দূরে দাঁড়িয়ে সে ফাহাদের হাতে টি শার্ট টি ছুড়ে দেয় এবং চোখ দিয়ে ইশারা করে ডান পাশের সুরঙ্গে ঢোকার নির্দেশ দেয়। ফাহাদ টি শার্ট গায়ে দিয়ে লাইট নিয়ে আগে আগে চলে যায়। আলিসা পিছনে পিছনে তাকে অনুসরণ করে।
এক পর্যায়ে তারা রানীর চেম্বারে গিয়ে পৌঁছায়। এ সকল চেম্বার এ অনেক আগে থেকেই মানুষ এসেছে। তাও দুজন মিলে প্রতিটি কোনা তন্ন তন্ন করে খুজে নতুন কোন সুরঙ্গের ক্লু তারা পায় কিনা, কিন্তু না, সেরকম কিছুই ছিল না রানী কুঠুরি তে। এরপর খালি সুরঙ্গ পার করে আয়নার চেম্বারে এসে পৌঁছায় তারা। সেখানে দেখার মত কিছুই ছিলো না। এরপর আরেকটা সুরঙ্গ পার করে ফারাও খুফুর প্রধাণ চেম্বারে প্রবেশ করে তারা। এ চেম্বারের প্রতিটা পাথর ও মনে হয় যেন অদ্ভুত। ফারাও খুফুর জন্য তৈরী চেম্বারটা বেশ ভালো ই বড়। আশে পাশে সাজানো আরো অনেক কফিন। ফাহাদ খুফুর পাথরের তৈরি কফিনের দিকে এগিয়ে যায়। খুব সাধারণ পাথর দিয়ে তৈরি কফিনটা দেখে তার বিশ্বাস হয়না এটাই খুফুর কফিন বাক্স ছিলো।
পা দিয়ে কফিনের দরজাটা জোরে ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে যায়। যা ভেবেছিলো তা ই। ভিতরে কোন লাশ নেই। মূল কফিন সহ বক্স টি হয়ত কায়রোর জাদুঘর এ রাখা হয়েছে। ফারাও খুপু তার পিরামিড বানাতে এতই টাকা খরচ করছিলো যে তার মেয়েকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত পতিতাবৃত্তি করিয়ে অন্যান্য দেশের রাজকুমার ও রাজাদের থেকে চড়া দাম আদায় করত। তারপর তা ব্যয় করত তার সমাধির জায়গা আরো বেশি বিলাসী এবং প্রশস্ত করার জন্য। চতুর্থ চেম্বারের খোঁজ পেলে তার মেয়ের সমাধিটা পাওয়া যাবে। ওখানেই আছে সে মেয়ে টার কফিন।
হঠাৎ ফাহাদের মনে একটা প্রশ্ন আসে। দ্বিতীয় খালি চেম্বার টা তৈরী করার উদ্দেশ্য কি তবে? আয়নার আড়ালে কোন নতুন চেম্বারের রাস্তা নেই তো?? যারা এখানে আসে তাদের প্রতি নির্দেশ থাকে যেন কোন কিছু না ভাংগে বা না বিকৃত হয়, তবে ফাহাদের বা আলিসার কাছে এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। তারা আয়না গুলো ভেংগে ওপাশের পথ খুঁজতে পারে। আলিসার কাছে ফাহদ এই অভিব্যক্তি জানায়। আলিসা ও ফাহাদের কথা বলার সময় প্রধান চেম্বারের তৈরি হওয়া ইকো সিস্টেম এ সব কিছু রিফ্লেক্ট হয়ে তীব্রভাবে পুরো পিরামিডের চারদিকে ছড়িয়ে পরছিলো। আলিসা ফাহাদের কথায় সায় দেয়। তারা দুজন আবার দ্বিতীয় চেম্বারে ফিরে আসে। ভারী পাথর মেরে আয়না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে?? এ কথা ভাবতে ভাবতে চারদিকে ঘুরে পর্যবেক্ষন করার সময় একটা হলুদ আয়নার সামনে এসে ফাহাদের চোখ আটকে যায়। সেখানে ফাহাদকে আরো অনেক বড় এবং মোটা দেখাচ্ছিল। সাথে সাথে তার চুল এবং চোখ দুটোই নীল বর্ণ ধারণ করেছে দেখাচ্ছিল। কিন্তু অন্যান্য আয়না গুলোতে ফাহাদের নিজের আসল চেহারাটাই প্রদর্শিত হয়েছে এতক্ষন। ফাহাদকে হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলিসাও গিয়ে ফাহাদের থেকে একটু দূরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সাথে সাথে সে এবং ফাহাদ দুজনেই ভড়কে যায়। আলিসার চেহারা আয়নার মধ্যে অন্য আরেকজনের চেহারা দেখাচ্ছে। আলিসার এ চেহারাটা খুব পরিচিত। এটা যে তার নিজের চেহারা, মাশাড়ের চেহারা!! অনেকটা বৃদ্ধ ও কুৎসিত দেখাচ্ছে তাকে। আলিসা আয়নার একদম সামনে চলে যায়। নিজের হাত দিয়ে আফসোসের সাথে আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া মাশাড়ের ছবির উপর হাত বুলিয়ে দিতেই ঘটে অঘটন। সেখান থেকে সম্পূর্ন কাঁচের তৈরি একজন কুৎসিত চেহারার মাশাড়ে বের হয়ে আসে এবং ফাহাদের লম্বা মোটা ও শক্তিশালী প্রতিবিম্ব টাও বের হয়ে আসে, যার হাতে ছিলো সেই ফার্স্ট এইড কিটের খালি সিরিঞ্জ।আলিসার প্রতিবিম্বের হাতে ছিলো আলিসার সেই ডাকিনীবিদ্যার বই টি। আয়না থেকে বের হয়েই আলিসা এবং ফাহাদকে মেরে ফেলার জন্য চেষ্টা শুরু করে কাঁচের তৈরী প্রতিবিম্ব দুটি। আলিসা ফাহাদকে উদ্দশ্য করে বলে, এরা হলো আমাদের ভেতরকার শয়তানি রূপ। আমাদের নিজেদের থেকেও দ্বিগুণ শক্তিশালী, বাঁচতে হলে এখান থেকে পালাতে হবে।
আয়না থেকে নিজেদের শয়তানি রূপের প্রতিবিম্ব গুলো বের হয়েই সরাসরি আক্রমণ করে বসে আলিসা এবং ফাহাদের উপর। হঠাৎ করে কি করতে হবে তা বুঝতে না পেরে দুজনেই কাছা কাছি এসে দাঁড়িয়ে যায়। আলিসা ফাহাদের হাত ধরে গা ঘেঁসে দাঁড়াতেই নিচে লুটিয়ে পরে। ওর শরীর খুব দূর্বল হয়ে গিয়েছে। আলিসার প্রতিবিম্ব আলিসা বা ফাহদের কারো ই ক্ষতি করতে না পেরে চারদিকে চক্কর খাচ্ছিলো। ফাহাদের প্রতিবিম্ব দৌড়ে ফাহাদের কাছে আসে। হাতের সিরিঞ্জটা ফাহাদের ঘাড় বরাবর চালায়। ফাহাদ একটু নিচু হয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। কিন্তু তাতে তেমন লাভ হয়না। ফাহাদের প্রতিবিম্বটি ডান পা দিয়ে ফাহাদের পেটের উপর লাথি দেয় সজোরে।ফাহাদ ছিটকে দূরে পাথরের উপরে গিয়ে আছড়ে পরে। আলিসার গলার উপর পা দিয়ে চেপে ধরে প্রতিবিম্বের ফাহাদ। এদিকে পাথরের সাথে আছাড় খাওয়ার পরও সাথে সাথে ফাহাদ উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। লকেটের ক্ষমতার কারনে তার কোন প্রকার ব্যাথা তার অনুভব হয়না। সে দৌড়ে গিয়ে প্রতিবিম্ব ফাহাদের পাজর বরাবর সজোরে ঘুষি মারে। প্রতিবিম্ব টি কয়েক হাত পিছিয়ে যায়। আলিসা হাত দিয়ে তার নিজের গলা ধরে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকে।
এদিকে আলিসার প্রতিবিম্ব সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে যায় হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে।ফাহাদের দৈত্যাকার প্রতিবিম্বের ঘুষি খেয়েও যেন তেমন কিছুই হয় নি। সে ফাহাদের কাছে এসে এক হাত দিয়ে ফাহাদের মাথা মুঠো করে ধরে চাপ দেয়। ফাহাদের ব্যাথা অনুভব না হলেও মাথার খুলি যে চড়চড় করে ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা হচ্ছে তা সে টের অনুভব করতে পারে। প্রতিবিম্বের ফাহাদের গলায় ও ফাহাদের মত নীল লকেট থাকায় ফাহাদ কিছুতেই পেরে উঠছিলো না সেটির সাথে।ঠিক এমন সময়ে আলিসার প্রতিবিম্ব সুরঙ্গের মাঝের চেম্বার এ ঢুকে। ফাহাদের প্রতিবিম্ব এবং আলস ফাহাদ থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় ভাসতে থাকে সে। তার আশে পাশে কালো এবং বেগুনী রঙ এর বলয় তৈরী করে। সেই বলয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট বড় অনেক পাথর। আলিসার প্রতিবিম্ব দূরে দাঁড়িয়ে সে পাথর ফাহাদ এবং আলিসাকে উদ্দেশ্য করে ছুড়ে মারতে থাকে। আলিসার মাথায় একটা বড় পাথরের টুকরো এসে লাগে। কপাল কেটে রক্ত বের হতে থাকে আলিসার।
ফাহাদের হাতে পায়েও বেশ কয়েক জায়গায় পাথরের আঘাত লাগে।এ সময়ে ফাহাদের প্রতিবিম্বের গায়েও বেশ কয়েকটি পাথরের টুকরো আছড়ে পরতেই দেহের বেশ কিছু অংশে ফাটল ধরে যায়। ফাহাদের মাথা মুঠো থেকে ছেড়ে দিয়ে সে আলিসার প্রতিবিম্বকে আক্রমণ করে। আলিসার প্রতিবিম্ব হাওয়ায় ভেসে ভেসে দূরে চলে যায়। ফাহাদের প্রতিবিম্ব আবার ফাহাদ ও আলিসাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে ঝটপট রিভালবার বের করে ফাহাদ কাচের প্রতিবিম্বের লকেট টা লক্ষ্য করে কয়েকবার ফায়ারিং করে ফাহাদ।
নির্ভুল নিশানা। প্রতিবিম্বের গলার লকেট টায় গুলি লেগে সেটা ভেংগে চারদিকে কাঁচের টুকরোর মত ছড়িয়ে পরে। আলিসার প্রতিবিম্ব আবার ইতিমধ্যে আবার সুরঙ্গে প্রবেশ করে দূর থেকে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। একটা পাথর এসে ফাহাদের হাতে লাগে। ওর হাত থেকে রিভালবার ছিটকে পরে যায়। ফাহাদের দৈত্যাকার প্রতিবিম্বটি ফাহাদকে উদ্দেশ্য করে তেড়ে আসে এবং ফাহাদের নাকের মাঝ বরাবর ডান হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে একটা ঘুষি লাগিয়ে দেয়। এতে হলো হিতে বিপরীত ফাহাদের তো কিছু হলো ই না বরং প্রতিবিম্বের হাতটা ঝুরমুর করে ভেংগে পড়লো। ফাহাদ প্রতিবিম্বটির পেট লক্ষ্য করে পা দিয়ে সজোরে আড়াআড়িভাবে কিক করে। শশার মাঝখান দিয়ে ছুরি চালালে মাঝখান থেকে যেমন আস্তে দুভাগ হয়ে যায় তেমনি কাচের দেহটাও বিকট শব্দে দু খন্ড হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবে ভেংগে পড়লো। আলিসার প্রতিবিম্বটি তখনো বাতাসে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। এবড়োখেবড়ো একটা মাঝারী-মানের পাথর তুলে আলিসার প্রতিবিম্বের মাথায় ছুড়ে মারে ফাহাদ। এতটা সহজ হবে আলিসার কাচের দেহের মাথা গুড়িয়ে দেয়া তা ভাবতে পারে নি ফাহাদ। এজন্য অবশ্য নিজেকে ক্রেডিট নআ দিয়ে নীল লকেটকে ক্রেডিট দেয় ফাহাদ। লকেট না থাকলে লক্ষ্যভেদ তো দূরের কথা এতবড় পাথর তুলতেই পারতো না। ওদের আয়নার ভেতরের খারাপ রূপগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মাঝের চেম্বারের দেয়াল থেকে একটা ছোট্ট আয়না অদৃশ্য হয়ে যায়। সুরঙ্গের মত একটা পথ হয়ে চলে গিয়েছে নিচের দিকে। ফাহাদ লাইট নিয়ে সে অন্ধকার সুরঙ্গের ভিতরে প্রবেশ করে প্রথমে। একদম চকচকে ফকফকে রাস্তা আশেপাশে একটু ধুলাবালিও নেই। কোন সিঁড়ি ছাড়াই চলে গিয়েছে একদম নিচের দিকে।লাইট জ্বালিয়ে সাবধানে আগাতে থাকে ফাহাদ। অনেক পিছনে আলিসা। মসৃণ ঢালে বার বার ই পা পিছলে যেতে চাচ্ছে। এ রাস্তা দিয়ে নামলে পরে উঠে আসবে কিভাবে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছে ফাহাদ। হঠাৎ করে ফাহাদ পায়ের গ্রিপ হারিয়ে ফেলে। টর্চ টা হাত থেকে পরে যায়। ফাহাদ নিজেও টাল সামলাতে না পেরে প্রায় অনেকখানি খাড়া ঢালু মসৃণ রাস্তা দিয়ে অন্ধকারের ভিতর গড়িয়ে পরতে থাকে। মাথা ঘুরে গিয়ে বমি আসে ফাহাদের।নিচের দিকে গড়াতে গড়াতে ই ফাহাদ তার পকেটে হাত ঢুকায়। ছুড়িটা পেয়ে যায় পকেটেই। ছুড়ির কভার খুলতেও ভয় লাগছে এখন। যদি ঝাঁকি খেয়ে পেট বা গলার ভিতর ঢুকে যায়!! তবুও চেস্টা করতে হবে। নির্দিষ্ট একটা ছন্দের প্যাটার্ন ধরে সে ছুড়ির কভার থেকে ধারাল ৫ ইঞ্চির ছুড়িটা উন্মুক্ত করে। হাত উপরের দিকে মসৃণ ঢালু রাস্তাটার উপর আঘাত করে। ছুড়িটা গেঁছে গেলে হয়ত পতন রোধ হবে। কিন্তু কিসের কি!! রাস্তায় চাকু মেরেই ফাহাদ বুঝতে পারল রাস্তাটা পাথরের তৈরি। অন্ধকারে কোথায় গড়িয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছিল না ফাহাদ। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। রাস্তার দুপাশে যে পাথরের দেয়াল ছিল তার সাথে চাকুটার মাথা ঘেঁষিয়ে ধরে রাখে ফাহাদ। বুদ্ধি টা ফলাফল দেয়। পাথরের দুটি ব্লকের মাঝখানে যে ফাঁকা একটা চিড় থাকে তার কোন একটা চিড়ের ভিতর ছুড়ির ফলাটা গেঁথে যায়। হঠাৎ করেই ফাহাদের গড়িয়ে পরা বন্ধ হয়ে যায়। সে চাকুর হাতল ধরে ঝুলে পরে। কিন্তু সেই সময়টাতেই তার একটা নিষ্ঠুর অনুভূতি হয়।ঢালু রাস্তাটা ফাহাদের বুকের কাছে এসেই শেষ হয়ে গিয়েছে। বুকের নিচের অংশ শূন্যে ঝুলে আছে। চাকুর হাতল ছেড়ে দিলে সে নিচের দিকে কোথায় যে পতিত হবে তা ধারণার বাইরে।চারদিকে গাড় অন্ধকারের ভিতর এমন একটা পরিস্থিতে পরবে ভাবে নি সে। অন্ধকারে নিমজ্জিত আছে, আলো দরকার,কথাটা ভাবা মাত্রই তার গলার লকেট থেকে নীল আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে। তাতেই স্পষ্ট দেখত্ব পায়, দেয়ালের একটা পাথরের ফাঁকে তার ছুড়িটা গেঁথে আছে,বুক পর্যন্ত মসৃণ ঢাল থাকলেও পা রাখার মত কোন অবলম্বন নেই। লকেটের জোড়ে ঝুলে থাকতে ফাহাদের কোন অসুবিধে হচ্ছে না। নইলে এতক্ষনে তার হাতের শক্তি শেষ হয়ে, সে নিশ্চত নিচের দিকে অতল গহবরে পরে যেত। নিচে কি আছে! দেখার ইচ্ছে জাগে ফাহাদের। মনে মনে সে প্রার্থনা করে চাকুটা যাতে খুলে না আসে। এভাবে অনন্তকাল ঝুলে থাকলেও তার সমস্যা হবে না। এক হাতে চাকু ধরে সে অন্য হাত পকেটে ঢুকিয়ে পকেট থেকে মোবাইলফোন টা বের করে। নেটোয়ার্ক নেই। টর্চ জ্বেলে নিচের দিকে আলো ফেলে কি আছে দেখার জন্য। যা দেখে তাতে ফাহাদের চোখ কপালে উঠে। ফাঁচ ফুটের মত গভীর, এর পর ই পা রাখার মত মাটি আছে। কিন্তু সেখানে বিছানো হাজার হাজার কাঁচের সুঁচালো ফলক। একেকটার উচ্চতা এক হাতের মত করে। ছুরিটা আটকে না গেলে ফাহাদ হয়ত এতক্ষনে কাচের ফলকের মাঝে গেঁথে থাকতো।হঠাৎ লাইটের আলো এসে লাগে ফাহাদের চোখে। আলিসা কাছাকাছি এসে গিয়েছে। আলিসা পিছলে পরেনি। কারণ আলিসার বইয়ে লেখা মন্ত্রের ক্ষমতা দ্বারা সে গ্রীপ করে নেমে আসছিল। ফাহাদ চিৎকার করে আলিসাকে নিচে নামতে নিষেধ করে। আলিসা ফাহাদকে প্রশ্ন করে,
কি সমস্যা হবে নিচে নামলে!!
- কাঁচের ফলক রাখা নিচে।পাঁচ ফুট উপরেই রাস্তা শেষ।
.
- কাচের ফলক সরানো আমার কাছে কোন ব্যাপার না ফাহাদ।
.
ফাহাদ কোন উত্তর দেয়ার আগেই আলিসা হুড়মুড় করে ফাহাদের খুব কাছে চলে আসে। এতেই ঘটে বিপত্তি।ফাহাদের কাছাকাছি আসা মাত্রই আলিসা দুর্বল হয়ে যায়।প্রায় নিস্তেজ হয়ে ফাহাদের গা ঘেঁষেই নিচের দিকে পরে যায় আলিসা। কিন্তু হঠাৎ করে আলিসার এক হাত ধরে ফেলে ফাহাদ।আলিসা অজ্ঞান ছিল না। কিন্তু নড়াচড়া করতে অক্ষম ছিল। এত লোড পরায় ফাহাদের চাকুটা বেঁকে যায় বেশ অনেকখানি । যে কোন সময়ে ছুটে পড়তে পারে। একটা নির্জন পিরামিডের ভিতরে এমন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে দুজন ঝুলে আছে। না পারছে উঠে চলে যেতে না পারছে সামনে এগোতে। খুবই বাজে একটা পরিস্থিতে পেন্ডুলামের মত দুলছে জীবন মৃত্যুর খেলা।
.
.
.
.
.
আলিসার উচ্চতা ছিল ৫ ফিট ২ ইঞ্চি। ফাহাদ খেয়াল করল আরেকটু নিচের দিকে ঝুঁকতে পারলেই আলিসার পা কাচের ফলাগুলো ছুঁয়ে যেতে পারবে।। ফাহাদ চাকুর হাতলে কব্জির গ্রিপ ছেড়ে দেয়। তার বদলে সে মাত্র দুটো আংগুলের ভাজে চাকুটা ধরে রেখে আলিসা সহ ঝুলতে থাকে। এতে ফাহাদের কোন অসুবিধে-ই হচ্ছিল না।আলিসার পা এবার কাঁচের ফলকের মাথা স্পর্শ করেছে। আলিসা টের পেয়ে প্রাণপণ চেস্টা করে ফাঁকা জায়গায় তার পা নিয়ে যায় যাতে সুঁচালো ফলা তার পায়ে না ফুটে।আলিসার দু পা এমন একটা অবস্থানে আছে, ছেড়ে দিলে তার দু পায়ের মাঝ বরাবর ফলার মাথা থাকবে। পায়ে ফুটবে না। কিন্তু আলিসার নড়াচড়ার শক্তি এখন নেই বললেই চলে। আলিসাকে ছাড়লে ফ শক্তির প্রভাবে দুটো পা ছাড়া শরীরের বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকই ফলার ভিতর ঢুকে যাবে।ফাহাদ বুদ্ধি করে আলিসাকে ঘড়ির ঘন্টার মত দোলাতে থাকে।ওর পায়ে লেগে বেশ কিছু কাচের ফলার সুঁচালো চিকন মাথা ভেংগে যায়।নিরাপদ সংখ্যক কাচের ফলা ভাংগার পরে আলিসাকে ছেড়ে দেয় ফাহাদ। আলিসার অনেকটা নিরাপদে অবতরণ করলেও ব্যাথা পায় বেশ। কাচের ফলক পেরিয়ে আলিসা একটু দূরে চলে গিয়ে নিজের শক্তি ফেরৎ আনে। দূর থেকে তার জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে কাচের ফলকগুল নিমিষেই গুড়িয়ে দেয়। ফাহাদ লাফ দিয়ে নিচে নেমে আসে। এরপর আর ঢালু রাস্ত না। সরু একটা রাস্তা চলে গিয়েছে সোজা অনেক দূর পর্যন্ত। রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে এক পর্যায়ে একটা বাবলের মত পর্দা দৃষ্টি গোচর হয় ফাহাদ ও আলিসার। শ্যাম্পু দিয়ে বাবল উড়ানোর সময় গোল গোল বৃত্তের দেয়াল যেরকম দেখা যায়, ঠিক তেমন একটা পর্দার মত জিনিস পুরো রাস্তাটার মাঝে বসানো হয়েছে। ওপাশে যেতে হলে এই পর্দা ভেদ করে যেতে হবে। ফাহাদ নিমিষেই পর্দাটা পার হয়ে ওপাশে চলে যায়।কিন্তু আলিশা যখনই পর্দা টা পার হয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবে তখনই সে বৈদ্যুতিক শকের মত শক খেয়ে দূরে ছিটকে যায়।
কারণ পর্দা টা পার হতে পারবে শুধুমাত্র রক্তমাংসের মানুষরাই কোন আত্মা নয়।পিরামিডের লাল লকেট টা আত্মাদের নাগালের বাইরে রাখার জন্যই এরকম পর্দার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। মূলত আলিসার সীমাবদ্ধতা এখানেই। ওপাশের পথটুকু পাড়ি দিতে হবে ফাহাদের একার। আলিসা শুধু একটা কথা ই ভাবছে, পিরামিডের প্রথম সুরঙ্গের ভিতরে যে শিকড়ের সাথে নীল লকেট ছিল তা তো বইয়ে কোথাও লেখা নেই!! ফাহাদ লকেট টা পড়ার পর ই কেমন চেঞ্জ হয়ে গেল!! নীল লকেট ওখানে আসলো কোথা থেকে!!
আলিসা ভাবে ফাহাদ লকেট টা প্রথম ওখান থেকেই পেয়েছে। আগে থেকেই যে ফাহাদের কাছে লকেটটি আছে তা সম্পর্কে ধারণা ছিল না আলিসার।
ফাহাদ সমান্তরাল পথে প্রায় আধা ঘন্টা হেঁটে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর দেখতে পায়,অনেক দূরে ঢিবির মত উঁচু জায়গায় একটি স্বর্ণের, সিংহাসন বসানো আছে।ওটার চারপাশে লালচে আলো জায়গাটাকে আলোকিত করে রেখেছে।হেঁটে যেতে হয়ত আরো অনেক্ষন সময় লাগবে। ফাহাদ বুঝতে পারে ঐ সিংহাসনে ই খোদাই করে বসানো আছে সেই লাল পাথর। আরো কিছুক্ষন হেঁটে যাওয়ার পর একটা ছোট খাট পানির পরিখা দেখতে পায় সে। সিংহাসনের জায়গাটার চারদিকে এমন পানির পরিখা করা। যেতে হলে এটা পাড়ি দিতে হবে। আনুমানিক ২০ ফুট প্রশস্ত এই জলাশয় পাড়ি দেয়ার মত আশেপাশে কিছুই নেই। কালো কালো পানিতে গা ডোবাতে ইচ্ছে করছিল না ফাহাদের।
হঠাৎ ফাহাদের চোখ যায় দেয়ালের গা ঘেঁষে রাখা একটা বিশাল কাঠের তৈরী কফিনের দিকে। কফিনটার পেছনে দেয়ালে আঁকা ছিল তলোয়ার হাতে দাঁড়ানো একজন টাইটানের মত বিশাল মানুষের ছবি। যার পেছনে দাঁড়ানো আছে ছোট ছোট স্বাভাবিক হাজারো সশস্ত্র মানুষ। ফাহাদ অনুমান করতে পারে হয়তো এই টাইটানের মতো মানুষটি ছিল তৎকালীন সময়ের সৈন্যদলের সেনাপতি। মানুষটি আকার আকৃতে সাধারণের চেয়ে অনেক বড় ছিলো। তাই তার কফিন টাও ছিলো অনেক বড়। এই সেনাপতি কেও কপালে লাল আংটির ছাপ দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল হয়ত। তাই ছবিতেও তার মাথায় গোল একটা ছাপ সুস্পষ্ট।
কফিনটা খালি করতে পারলে হয়ত এটা নৌকার মত ব্যাবহার করা যাবে।
ফাহাদ একটা হ্যাঁচকা টানেই কফিনটির দরজা উপরের দিকে উঠিয়ে দেয়। ভারী কাঠের তৈরী কফিন। দরজা খুলতেই সে মোটামুটি অবাক হয়ে যায়। এ যে জীবন্ত মানুষ!!
.
.
.
.
.
প্রথমদিকে মমিটিকে জীবন্ত ভেবে ভড়কে গেলেও পরক্ষনেই টের পায় এটা আসোলে পাইন গাছের আঠা দ্বারা প্রস্তুত করা মমি। তাই এতটা জীবন্ত দেখাচ্ছে।মমিটির হাতে আলতো করে হাত রাখে ফাহাদ। ফাহাদের হাত মমিটির হাতের কাছে ছিল নিতান্তই ছোট। আঁঠালো একটা চিটচিটে জিনিসে ফাহাদের হাত ভিজে যায়। নাকের কাছে হাত নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকে ফাহাদ। একটা পচা গলা গন্ধ আসছে কেমন যেন। এটাকে ধরে বাইরে বের করতে হবে ভেবেই ফাহাদের গাঁ ঘিনঘিন করে উঠলো। আঠালো দ্রবণের জন্য বেশ শক্ত করে লেগে আছে লাশটা। বাম হাত ধরে টান দিতেই সেটা খুলে ফাহাদের হাতে এসে যায়। ফাহাদ হাতের অংশটা ছুড়ে ফেলে দেয়। এভাবে হবে না।মমিটার মুখের উপর ঝুঁকে ফাহাদ তার হাত ওটার কাঁধের নিচে নিয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিলো কাধের নিচ ধরে টান দিলে হয়ত লাশটার অনেক খানি উঠে আসবে। কিন্তু সেটা তো হলো ই না, হলো ভিন্ন কিছু। লাশটা হঠাৎ ই কেঁপে উঠে। ডান হাত দিয়ে ফাহাদকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে লেপটে নেয়।ফাহাদ যতই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে তত জোড়েই লাশটি তাকে আটকে নিজের কফিনের ভিতর নিয়ে আসে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে খট করে কফিনের দরজাটা উপর থেকে পরে আটকে যায়। ফাহাদ জীবন্ত কফিনের ভিতর আটকা পরে। ভয়ানক ব্যাপার হল কফিনের দৈত্যাকার লাশটা ও তখন জেগে উঠেছে।
লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।
.
.
(চলবে)

Post a Comment

أحدث أقدم