গল্পঃ শ্রাবণের বৃষ্টি! লেখাঃ সুরাইয়া জামান সুরভী



শ্রাবণের বৃষ্টি!
সুরাইয়া জামান সুরভী
মাকে যে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি সেটা মোটামুটি ভালোমানের বলা চলে। চৌচালা বড় একটা ঘরে ৪টা সিঙ্গেল খাট। এক পাশে কাঠের মাঝারি সাইজের একটা আলমারি। জানালার পাশে একটা টেবিল। রুমের মাথায় একটা তাকে ৩ টা বড় কাপড়ের ব্যাগ, তার ঠিক নিচে দেয়ালে ঝুলছে একটা কাঁচ ভাঙ্গা কালো দেয়ালঘড়ি।
- মা গুছিয়ে নাও তুমি, আমরা আসি। কোনো দরকারে ফোন দিয়ো আমাকে। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব তোমাকে।
ঘোর বর্ষাকাল । আকাশে মেঘ করেছে আবার। আমি অরুনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আড়চোখে দেখি ওর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। ওর সারা মুখে তৃপ্তির লাল আভা দেখে আমার চোখে বর্ষা নামে।
সাথে সাথে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি । শ্রাবণের বৃষ্টি!
আমার বোকাসোকা সহজ মাকে অচেনা অজানা এক পরিবেশে একা রেখে আমরা ঘরে ফিরি।
অরুনাকে মায়ের পছন্দেই বিয়ে করি আমি। বাবার রেখে যাওয়া অল্প কিছু টাকা দিয়ে মা ধুমধাম আয়োজন করে অরুনাকে ঘরে তোলে।
বিয়ের কিছুদিন পর মা ডেকে বলে, "তোর আক্কেল হয়েছে একেবারে তোর বাপের মত ! নতুন বিয়ে করেছিস। বউটাকে নিয়ে কদিন কোথাও ঘুরে আসতে তো পারিস ! আজকালকার মেয়ে এরা। কত শখ থাকে ! কোনোদিন দেখলাম না বউমার জন্য নিজে থেকে একটা কিছু এনেছিস হাতে করে। বেক্কল একটা !"
নতুন চাকরী তখন আমার। যা বেতন পাই তা দিয়ে ভালোমতো পুরো মাস চলে গিয়েও কিছু বেচে যায়। মা কিছু টাকা দেয় হাতে। পরদিন কক্সবাজারের ৩টা এয়ার টিকেট হাতে করে বাসায় ফিরি।
অরুনাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাই। মার টিকেট দেখে ও চেঁচিয়ে উঠে বলে, "তুমি আর তোমার মা গিয়ে ঘুরে এসো। আমি যাচ্ছি না কোথাও !"
- মা কোনোদিন সমুদ্র দেখেনি অরুনা। আমি পারবো না মাকে একা রেখে সমুদ্র দেখতে !
মা আমার কান্ডে বিরক্ত হয়। বলে, তোকে মানুষ করতে গিয়ে গরু থেকে গাধা বানিয়ে ফেলেছি মনে হচ্ছে !
অরুনা কে রাজী করিয়ে সেবারের মত সমুদ্র দেখে ফিরি আমরা।
এরপর থেকে মাঝেমধ্যে অরুনার জন্য হাতে কিছু নিয়ে বাসায় ফিরি আমি। মা দেখে খুশি হয়ে বলে, "আক্কেল হইছে দেখি একটু একটু!"
একবার মার জন্য একটা দুধেল সাদা রঙের শাড়ী কিনে আনি। মা খুশি হয়ে কপালে চুমু খায়।
রাতে অরুনা আমার বুকে মাথা রেখে বিরক্তির স্বরে বলে, আজেবাজে টাকা খরচ করা এখন থেকে কমাও তো একটু!
মাকে রেখে আসার প্রায় ১৫ দিন হয়ে গেলেও মা একটাও ফোন করেনা আমাকে। আমিও সাহস পাইনা ফোন করার। দুরুদুরু বুকে আমিই একটা কল দেই বৃদ্ধাশ্রমের নম্বরে। রিং হয়ে কেটে যায় ফোন।
আমার ৭ বছর বয়েসী ছেলে অন্তু এসে জানায় আজ দুপুরে তার নানা নানুর বেড়াতে আসার কথা। অরুনা বাজারে যাবার তাড়া দিতে থাকে। আমি দারোয়ানকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে যাই।
ফেরার পথে দারোয়ান জানায় তার ছুটির দরকারের কথা।
- বাড়িতে যাবি ?
: হ ভাই। আম্মার শরীর খারাপ হইছে বেশি। বুড়া মানুষ। নড়তে চড়তে পারে না। বিছানায় পেশাব পায়খানা করে। অনেকদিন যাইনা বাড়িত। মন ভালো লাগতেছে না।
শুনে আমার কেমন মন খারাপ হয়। মার কথা মনে পড়ে।
বাজার থেকে আনা বড় ইলিশ মাছ দেখে অরুনা খুশি হয়। শ্বশুড় শাশুড়িকে দেখে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি। খাবার টেবিলে আমার শাশুড়িমা আমার শরীরের খোঁজ খবর নিতে থাকে, জানতে চায় আমার চাকরীর কথা । আমি ভদ্রতা দেখিয়ে উত্তর দিতে থাকি।
অরুনা ডিমওয়ালা মাছের বড় পিসটা আমার পাতে তুলে দিয়ে, আমাকে সাবধানে খেতে বলে অন্তুর পাতের মাছের কাঁটা বাছতে থাকে। আমি জল ভরা চোখে সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখি।
বিকালে পলাশের হাতে এই মাসের বেতন ধরিয়ে দিয়ে বলি, বাড়ি গিয়ে ৭ দিনের ছুটি কাটিয়ে আসার কথা। পলাশ কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে।
বেরিয়ে পড়ি আমি। মাত্র ক'বছরের চেনা দুটো মানুষের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে পারলে মায়ের পা জড়িয়ে ক্ষমা চাইতে পারবো না? যেই পা জড়িয়ে দুলতে দুলতে এত বড় হয়েছি !
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। শ্রাবণের বৃষ্টি!
সুরাইয়া জামান সুরভী

Post a Comment

أحدث أقدم