গল্পঃ এ উইজার্ড।লেখক : হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।পর্ব - ৯


গল্পঃ এ উইজার্ড | পর্ব - ৯
লেখক : হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ


মিশরের প্রাণঘাতী মরুভূমির ভিতর অত্যন্ত ভয়াল একটি রাত কাটলো।
ফাহাদের জামা কাপড় ও নাকমুখে রক্ত লেগে শুকিয়ে আছে। পানি সংগ্রহ করে সে আস্তে আস্তে ফ্রেশ হয়।চটজলদি একটা বুদ্ধি তার মাথায় এসে যায় তার। রাতুলকে রুম থেকে বের করে কোয়াডের সিটে এনে রাখে ফাহাদ। পরে যাতে না যায়,এজন্য শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেধে ফেলে রাতুলকে। এরপর আবার সেই বাড়িতে ঢুকে সে। মেয়েটার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে ফাহাদ, ওদের কাছে থাকা সুঁচালো রডগুলোর একটা নিয়ে,দ্রুত নিচে নেমে আসে।
হাতের বাঁধন খোলা হলেও মেয়েটার পা এবং কোমড়ের বাঁধন খুলতে বেশ কিছুক্ষন লেগে যাবে। ততক্ষনে ফাহাদ চলে যাবে অনেক দূর। এছাড়া রিভালবার তো তার কাছে আছেই, ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই।
রাতুলদের গাড়িতে থাকা পানির বোতলগুলো নেওয়ার সময় ফাহাদ পুলিশের গাড়ি এবং রাতুলদের গাড়ির চাকাগুলো একমাথা চোঁখা রড দিয়ে লিক করে দেয়। মেয়েটাকে কেউ উদ্ধার করতে না আসলে বেঁচে থাকার জন্য ওর হয়ত স্বামী তারপর দেবর এবং শেষমেস বৃদ্ধ লোকটার শরীরও খাদ্য হিসেবে ব্যাবহার করতে হবে। তারপর ধুকে ধুকে মারা যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই পানি দিয়ে বোতল পূর্ণ করে ফাহাদ নিজের কোয়াডের কাছে চলে আসে। রাতুলের মুখে মাস্ক পরিয়ে দিয়ে নিজেও মাস্ক পরে নেয়। যাতে ধুলোবালি নিশ্বাসের সাথে পেটের ভিতরে না যেতে পারে।এরপর রড টার শেষ ব্যাবহার করে ফাহাদ। রাতুলের পায়ের যেখানে গুলি লেগেছিলো তার ঠিক ইঞ্চি দুয়েক নিচেই পায়ের মাংসল জায়গায় রড দিয়ে সজোরে আঘাত করে।
জায়গামত লেগেছে কিনা, তা দেখে নিয়ে মনে মনে খুশি হয় ফাহাদ। রড টা একটু দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সিটে বসে স্টার্ট দেয় কোয়াডটি। তারপর দ্রুতগতিতে ম্যাপ অনুযায়ী মরুভূমির বালুর উপর দিয়ে দৌঁড়ে চলে যেতে থাকে নাসের লেকের দিকে।ভোরের আলো মাত্র ছড়াতে শুরু করেছে।
দোতলার জানালা দিয়ে পুরো দৃশ্যটাই দেখছিলো মেয়েটি। সবুজ রংঙের কোয়াড টা ছোট হতে হতে আস্তে আস্তে দূরে চলে গেল। একসময় বিন্দু তারপর চোখের আড়ালে অদৃশ্য।
সূর্য 6:30 এর দিকেই উঁকি মারে। রাতের দিকের গড় তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট থাকলেও সূর্য ওঠার সাথে সাথে তা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
যাত্রা শুরুর প্রথম দু ঘন্টা নির্বিঘ্নভাবে চালাতে পারলেও তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রী ফারেনহাইট এ পৌঁছে যাওয়ার পর
ফাহাদ মাঝে মাঝেই কোয়াড থামাচ্ছিল। তার কোন সমস্যা হচ্ছিলো না লকেটের কারণে।কিন্তু রাতুলকে নিয়ে সে চিন্তিত ছিল। হা করিয়ে মুখের ভিতর পানি খাইয়ে দিচ্ছিল বারবার। যাতে ডিহাইড্রেড হয়ে মারা না যায়। কাপড় ভিজিয়ে রাতুলের মাথার উপর বেঁধে দিয়েছিল ফাহাদ। একটু পর পর বোতলের পানি ঢেলে সেই কাপড় ভিজিয়ে দিতে হচ্ছিল। আবার যাতে রাতুলের জ্ঞান না ফিরে আসে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছিলো তার।ফাহাদের সিক্সথ সেন্স বলছিলো, যদি কোয়াডটা নষ্ট ও হয়ে যায়, তবুও রাতুলকে মাথায় নিয়ে অনায়াসেই নাছের লেক পৌঁছে যাওয়া যাবে।লকেটটার দিকে তাকিয়ে সে পুনরায় নিজের কনফিডেন্স বাড়িয়ে নেয় একটু।
.
.
বাতাস কোয়াডের বিপরীত দিকে না চলায় ধুলোর ঝামেলা পোহাতে হচ্ছিলো না তাদের।তবে পৌঁছাতে বেশ কিছু সময় লেগে যায়। দুশ কিলোমিটার পার আওয়ার বেগে চালালেও নাছের লেকের কাছাকাছি আসতে সময় লাগে ৫ ঘন্টার মত। তাপমাত্রা তখন প্রায় ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। ফাহাদ কোয়াড টা থামায়। সকালে রাতুলের পায়ের যেখানে রড দিয়ে আঘাত করেছিলো সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে কালো হয়ে আছে। হ্যাঁ এটাই চেয়েছিলো সে।
ছুড়ি বের করে একটা কাঠিকে ঠিক সাপের দাঁতের মত ছুঁচালো করে রাতুলের ফোলা কালো স্থানের মাঝ বরাবর হাফ ইঞ্চি ফাঁকা রেখে দুটো ছিদ্র করে দেয় ফাহাদ। দেখে যেন মনে হয় সাপ দংশন করেছিল।এরপর ফাহাদ নিজের সাথে আনা অতিরিক্ত টি শার্টের একটা ছিড়ে অনেকটা চ্যাপ্টা দড়ির মত বানায়। রাতুলের যেখানে বুলেট লেগেছিল সেখানে শক্ত করে টি- শার্টের ছেড়া অংশ দিয়ে বেঁধে দেয়, লোকজন দেখলে বুঝবে সাপের বিষ রক্তে ছড়িয়ে পরা থেকে রোধ করার জন্য ই এরকম বাঁধা হয়েছে। বুলেটের ক্ষত দেখা গেলে যে কেউ-ই পুলিশকে ইনফর্ম করতে পারত। অন্তত সেরকম ঝুঁকি থেকে বাঁচা গেল।
.
.
নাসের লেক পৌঁছে ভাড়া নেয়া কোয়াড টা ফেরৎ দেয় ফাহাদ। কোয়াড থেকে রাতুলের নিস্তেজ দেহ নামিয়ে রাস্তার উপর রাখতেই আশে পাশের লোকজন দৌঁড়ে এসে জড়ো হয়।
রাতুলের প্যান্ট গুটিয়ে ক্ষত স্থান আগেই বের করে রেখেছিলো ফাহাদ। লোকজন নিজে থেকেই সব বুঝে নিলো। শুধু জিজ্ঞেস করলো!! "বডিটা কোথায় পেলেন?"
" আছে নাকি মরে গেছে?"
ব্যাস্ততা দেখিয়ে ফাহাদ জবাব দেয় তাড়াতাড়ি কেউ একটা এম্বুলেন্স ডাকুন।
স্থানীয় কেউ কেউ জরুরী এম্বুলেন্সে ফোন দিতেই মাত্র মিনিট পাঁচেকের ভিতর সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটা এম্বুলেন্স এসে হাজির হয়।
সবাই ধরাধরি করে এম্বুলেন্স এ উঠায় রাতুলকে। কেউ কেউ সাথেও যেতে চায়। কিন্তু ফাহাদ নিতে নারাজ। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে নাসের লেক থেকে এম্বুলেন্স নিয়ে রওনা দেয় সে।
পথিমধ্যে রাতুলের জ্ঞান ফেরে। ক্লোরোফর্মের অতিরিক্ত প্রয়োগের ফলে রাতুলের মস্তিষ্ক খুব আস্তে আস্তে কাজ করতে শুরু করে। তখনও সে কিছু মনে করতে পারছিলো না। ফাহাদ সাথে থাকা শুকনা খাবার এবং পানি রাতুলের মুখে তুলে দিয়ে খাইয়ে দেয়। নিজের হাতে ধরে খাবার খাওয়ার মত শক্তি কিংবা সেন্স তখনো ফিরে পায় নি রাতুল।
খাওয়া শেষ হয়ে গেলে রাতুলকে ড্রাইভারের চোখের আড়ালে অজ্ঞান করে ফেলতে হয় আবারও।
.
.
.
ড্রাইভার গাড়ি থামায় আসওয়ানের একটা হাসপাতালের সামনে এসে। ফাহাদ ড্রাইভারের কায়রোর পথে এগুতে বলে। ড্রাইভার কায়রো যেতে রাজি না হলে ফাহাদ ড্রাইভারের হাতে মোটা অংকের টাকা ধরিয়ে দেয় ও বলে
" সাপের ঘাঁ বেশি মারাত্মক না, বিষধর সাপ কামড়ায় নি ওকে। দেখলেন না একটু আগে খাবার খাইয়েছিলাম!! কিন্তু বেচারা সাপের কামড় খেয়ে মরুভুমিতে অজ্ঞান পরে ছিল।পানিবার খাবার না পেয়ে অনেক ক্লান্ত হয়ে পরেছে। ডাক্তারের কাছে নিতে হবেনা। বাসায় নিয়ে সেবা করলেই হবে। ফাহাদের কথা সত্য মিথ্যা যাচাই করতে আর গেলনা ড্রাইভারটি। মোটা অংকের টাকা পেয়েই সে রওনা দিলো কায়রোর উদ্দেশ্যে।
.
.
.
কায়রো শহরের সীমায় প্রবেশ করার আগেই এম্বুলেন্স ড্রাইভারকে আরো কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয় ফাহাদ। এরপর একটা ট্যাক্সি নেয় সে।
ট্যাক্সি করে সরাসরি বাসায় না গিয়ে একটা মিউজিক ইন্সটুমেন্ট এর দোকানের সামনে যায় সে।
আগের মতই বড় ট্রলি ব্যাগ, ফেক হেয়ার ও কিনে উঠে বসে ট্যাক্সিতে। একটা পরিচিত পার্টি ক্লাবের সামনে যাওয়ার জন্য হুকুম দেয় তাকে।
কায়রোর ট্যাক্সি চালক। এ পর্যন্ত তার ট্যাক্সিতে হাজার হাজার অপকর্ম হয়েছে। পেছনের সিটে ড্রাগ টেকিং, খুন,আর্মস ডিলিং থেকে শুরু করে ধর্ষণ অথবা অবৈধ মিলনের দৃশ্য পর্যন্ত দেখেছে সে।
একটা আস্ত মানুষকে তাই ট্রলি ব্যাগে প্যাক করতে দেখে সে এবার আর বেশি অবাক হয়না। তার উপর পকেট থেকে গান বের করে পাশের সিটেই রেখেছিল ফাহাদ। এটা সে করেছিলো স্রেফ ভয় দেখানোর জন্য।
বারের সামনে নেমে ট্রলি এবং গিটার সহ বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে সে। আগের ট্যাক্সি টা চোখের আড়াল হতেই নতুন একটা ট্যাক্সি ধরে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ফাহাদ। তাও বাসা থেকে একটু দূরে নেমে ট্যাক্সি চালক কে বিদায় করে। এরপর ট্রলিটা কে টেনে টেনে নিয়ে আসে বহুতল ভি আইপি ভবনের সামনে। সিসি ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দেয়া না গেলেও অনায়াসেই বোকা বানানো যায়। নিজের বাসার ভিতরে ট্রলিটা নিয়ে ঢুকতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি ফাহাদের।
ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে লক খুলে বাসায় ঢুকেই প্রথম ফাহাদের চোখ যায় বেঁধে রাখা সুবাতার দিকে।
সুবাতা লক্ষ্মী মেয়ের মতই হাত পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে চেয়ারে।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে পালানোর চেস্টা করে নি। সুবাতার সামনেই ট্রলি ব্যাগ খুলে ফাহাদ রাতুলের নিস্তেজ দেহটা বের করে।
ফাহাদের বাসায় মোট তিনটে কামড়া। ফাহাদ
সিদ্ধান্ত নেয়, রাতুলকে সে একটা কামড়ায় রাখবে।আপাতত রাতুলকে সুস্থ করে ওঠানো যাক। এ জন্য যেটা সবথেকে বেশি প্রয়োজন সেটা হলো সুবাতার সহযোগীতা। রাতুল পুরোপুরিভাবে সুস্থ না হওয়ার আগ পর্যন্ত, ওর কাছে লকেটের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় ফাহাদ।
তবে সুবাতাকেও সে বিশ্বাস করে না।
নিকোলাস থাকাকালীন সময়ে যখন গ্যাংদের উৎপাত বেশি ছিলো চারদিকে তখন স্পাই, ডিফেন্স, আর্মস ডিটেক্ট এমনকি খুন করার কাজেও রটওয়েলার নামক কুকুর ব্যাবহার করা হত। এরা প্রচন্ড পরিমান বদমেজাজি। কন্ট্রোল করাও বেশ দু:সাধ্য। একবার কোন কিছুকে কামড়ে ধরতে পারলে শরীরের শেষ শক্তিটুকু থাকা অবস্থায় ও কামড়ে রাখে। প্রচন্ড ভয়ানক এ কুকুরগুলোকে বশে আনার জন্য তখন এক ধরণের রিমোট কন্ট্রোল মেটাল হারনের ইউস করা হত। এটার সাথে ছিলো আধুনিক ফিংগারপ্রিন্ট লক, স্পাইক্যাম এবং ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে সাময়িকভাবে শরীরকে অকেজো করে দেয়ার ক্ষমতা। বাইরের কোন লোক কুকুরের গলা থেকে এই দামী হারনেস খোলার জন্য ধরে টান দিলে সে ও সাথে সাথে ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে লুটিয়ে পরত। বাজারে এ হারনেস গুলো ক্রয় বিক্রয় ছিল সম্পূর্ন অবৈধ। তবে ফাহাদ নিজের কাছে এরকম বেশ কিছু হারনেস সংগ্রহ করে রেখেছিল।ওগুলো থেকে দুটো হারনেস বের করে সে একটা রাতুলের গলায় এবং একটা সুবাতার গলায় লাগিয়ে দেয় ।
সুবাতা কিংবা রাতুল কি বলছে বা করছে তা হারনেসের মাধ্যমে টের তো পাওয়া যাবেই আবার উল্টাপাল্টা কিছু করার চেস্টা করলেও ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে অজ্ঞান করে দেয়া যাবে।
সুবাতার চলাফেরা এবং কাজ কর্মের একটা সীমাবদ্ধতা দিয়ে দেয় ফাহাদ। এর বাইরে কিছু করলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গন্য হবে। সাফ সাফ জানিয়ে দেয় সে। এ বাসায় সুবাতার খাওয়া এবং থাকার কোন প্রকার ত্রুটি হবে না। তবে আপাতত সুবাতার কাজ হবে শুধুমাত্র রাতুল এবং হাসপাতাল থেকে শাফায়তের মা কে রিলিজ করে বাসায় নিয়ে আসার পর সেবাযত্ন করে দুজনকেই পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা।
.
.
.
নিজের গলায় কুকুরের বেল্ট বাঁধা দেখে ভীষন রাগ হলো রাতুলের। তাও আবার যে সে বেল্ট না। এক্কেবারে মেটাল ইলেক্ট্রিক বেল্ট। টিভিতে অনেক আগে ক্রাইম ফিকশনের একটা প্রতিবেদনে এই হারনেস গুল দেখেছিল রাতুল। মনে মনে গালি দেয় সে। লাস্ট পর্যন্ত কুত্তা বানাবে নাকি!! আয়নার একদম সামনে গিয়ে রাতুল ভালোভাবে গলার হারনেস টা পর্যবেক্ষন করতে থাকে ।ভয়ে টাচ ও করতে সাহস পাচ্ছে না। এমনি শরীরের উপর দিয়ে বেশ ধকল গিয়েছে তার। প্রত্যেকটা লিগামেন্ট এ প্রচন্ড পরিমানে ব্যাথা। তার উপর এখন দ্বিতীয়বারের মত ইলেক্ট্রিক শক খেলে জানপাখি উড়াল দিতে সময় লাগবে না।
.
.
.
কিছুক্ষন আগেই রাতুলের হুশ-জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা শূন্য কামরায়। রুমটায় কোন ফার্নিচার ছিল না। ফ্লোরে একটা তোয়ালে বিছিয়ে রাখা হয়েছে শুধু।
হাত পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা। হঠাৎ তার স্মরণে আসে সেদিন রাতে শাফায়ত কে কেটে টুকরা টুকরা করতে দেখার কথা, পায়ে গুলি লাগার কথা। পড়নে শুধু একটা সাদা তোয়ালে ছিলো রাতুলের। নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় পা ব্যান্ডেজ করা।শরীরটা একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তার মানে কেউ তাকে গোসল করিয়েছে!! কথাটা কল্পনা করেই ভীষন লজ্জা পায় রাতুল। নিজের দাঁড়ি-গোফ কিংবা কিছুই কাটা হয় ই বিগত কয়েক সপ্তাহে।দাঁড়ির কথা মনে হতেই গালে হাত বুলায় সে। নাহ, ফ্রেশ একদম। কেউ শেভ ও করিয়ে দিয়েছে তাহলে। আস্তে আস্তে রাতুল উঠে দাঁড়াতে চেস্টা করে। কিছুক্ষন চেস্টার পর সফল হয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে দেয়ালের সাথে ফিক্সড করা আয়নার দিকে এগোয় । আয়নায় তাকিয়েই নিজের চেহারা দেখে অবাক হয় অনেকটা।
তার গলায় একটা ইলেক্ট্রিক মেটাল হারনেস। এই হারনের সম্পর্কে তার আগে কিছু জানাশোনা থাকলেও স্বভাবতই রাতুল ভুল করে বসে, খুলে ফেলার জন্য হারনেসটি হাত দিয়ে ধরে টান দেয়। সাথে সাথে ১২০০ ভোল্টের একটা ছোটখাট শক খেয়ে ফ্লোরে আছড়ে পরে সে। ১২০০ ভোল্ট ছোট খাট শক-ই। হয়ত ফাহাদ ভোল্টেজ কমিয়ে রেখেছিল। এ হারনেস গুলো সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ভোল্টেজ এর শক প্রদান করতে সক্ষম। ভোল্ট বেশি হওয়া সত্যেও বিদ্যুতের এম্পিয়ার ০.০০২-০.০৩ সীমার মধ্যে থাকায় একজন মানুষ কখনোই এতে মারা যাবে না। সর্বোচ্চ জ্ঞান হারাবে। কিন্তু বাসা বাড়ির ১০০/২০০ ভোল্টের এ.সি বিদ্যুতের শক ও প্রাণঘাতী। কারণ এটা শরীর দ্বারা প্রবাহিত হয়, শরীরকে মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করে। বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের এম্পিয়ার ৫০-৪০০ এর ভিতর থাকে। বলে রাখা ভালো ১ এম্পিয়ারের বিদ্যুৎ ও মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম।
.
.
.
ইদফো শহরে রোদের ভিতর কৃষিকাজ করে এবং শুকনা রুটি খেয়ে থাকার চেয়ে ফাহাদের উন্নতমানের বাসায় থাকাটাই সবথেকে বেশি নিরাপদ ও সুবিধাজনক বলে মনে করছিলো সুবাতা।
তাই ফাহাদের বেঁধে দেওয়া সীমাবদ্ধতায় নিজেকে আবদ্ধ করতে সে নারাজ হয় নি। বরং মনে মনে খুশি হয়েছিল। সেই সাথে অনেকটা অবাকও হয়েছিল সুবাতা। ফাহাদ এতটুকু বয়সে এত টাকার মালিক হলো কি করে, সেটা ভেবে।
বাসার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয় সুবাতা। ফ্রীজে বার্গার কোক সহ ফাস্টফুড রাখা। ফাহাদ এতকাল এসব খেয়েই দিন কাটাচ্ছিল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে রেস্তোরাঁতে খেলেও বেশিরভাগ সময় ই জাংকফুড খেয়ে থাকতে হত। সুবাতা ঠিক করে, এখন থেকে সে ই বাসায় রান্না করবে। ফাহাদকে বাজার করারা জন্য প্রয়োজনীয় রসদের নাম লিখে দেয়। ফাহাদ বাজার আনতে বাসার বাইরে গেলে বাসার অগোছালো জিনিসপত্র গুলো গোছানোর কাজে মন দেয় সুবাতা।
হঠাৎ দরজায় আঘাত করার শব্দে অবাক হয় সে। রাতুলের জ্ঞান ফিরেছে তবে। ফাহাদের আদেশ অনুযায়ী রাতুলকে সব রুলস বুঝিয়ে দেয়ার পর সুবাতা আর রাতুলের কথা বলা নিষিদ্ধ।
সুবাতা নাস্তা এবং পানীয় নিয়ে রাতুলের ঘরে ঢোকে। হঠাৎ দরজা খুলে সুবাতার অনুপ্রবেশে ভুত দেখার মত চমকে উঠে রাতুল। তবে কি সুবাতা তাকে এখানে এনে আটকেছে?? বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে চুপ থাকে সে। সুবাতা আগেই ঘৃণা করত রাতুলকে তার উপর রাতুল কিছু জানতে না চেয়ে চুপচাপ বসে আছে দেখে আরও বেশি রাগ হচ্ছিলো সুবাতার। সে খাবারগুল মেঝেতে রেখে রাতুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, " খাবার খেয়ে নিবেন। দরজার বাইরে যাওয়া আপনার জন্য নিষিদ্ধ। গেলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গন্য হবে। আপাতত নাস্তা খেয়ে নিন। বাকিটা ফাহাদ আপনাকে বলবে।
এবার মুখ খুলে রাতুল!!
" ফাহাদ?"
" কোন ফাহাদ??"
জবাবে সুবাতা বলে, " ফাহাদকে চিনতে পারেন নি?? ও আমার সন্তান। "
বলেই রুম থেকে হেঁটে বেরিয়ে যায় সুবাতা।
ফাহাদ কি তবে সব জেনে গিয়েছে!! আর এতটুকু ছোকরা ওকে এখানে আনলো ই বা কিভাবে!! ভেবে পায়না রাতুল। "সুবাতার হাল ও আমার মত ই গলায় কুত্তার বেল্ট পরিয়ে রাখছে" মনে মনে বলে রাতুল।
সে ঠিক করে অসুস্থ অবস্থায় কোন ধরণের পদক্ষেপ ই নিবে না। আগে সুস্থ হোক তারপর কি করা যায় দেখা যাবে।
দিন দুয়েক তেমন কোন দানাপানি মুখে পরেনি রাতুলের। গপাগপ করে নাস্তা খেয়ে নিল সে।
তারপর নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিলো মেঝেতে বিছানো তোয়ালেটার উপরে।
.
.
.
ফাহাদ বাজার সদয় সেরে সেগুলো একটা হেল্পিং হ্যান্ডকে দিয়ে বাসার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয় দেয়।
এরপর রওনা দেয় শাফায়তের মায় কে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে জানতে পারে অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। তবে তিনি আপতত প্যারালাইজড। সামান্য হাঁটাচলা ও নড়াচড়া করতে পারলেও কথা বলতে পারেন না মোটেই। ফাহাদের যেন একটু খারাপ লাগল। ফাহাদ কিছু বকেয়া থাকা টাকা পরিশোধ করে ওনাকে নিয়ে যেতে চাইলে বেঁকে বসে ওখানের দায়িত্বে থাকা স্টাফরা।রোগীকে দিবে না। যে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে তাকে ছাড়া অন্য কারো কাছে রোগীকে কিছুতেই হস্তান্তর করা যাবে না। ফাহাদ খুব করে বোঝালো এটা তার দাদী মা হয়, তারা বলল ডি এন এ টেস্ট করে যদি মিল-ও খুঁজে পায় তবুও রোগী হস্তান্তর সম্ভব হবে না।
ফাহাদ নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে দিয়ে চলে আসে। আসার সময় বলে আসে আপনারা যতদিন ইচ্ছা রাখেন। কেউ তাকে নিতে না আসলে দয়া করে আমাকে ফোন দিবেন।
একপ্রকার রাগ নিয়ে-ই হাসপাতাল ছাড়ে সে।
.
.
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সোজা বাসায় চলে যায় সে। রাতুলের জ্ঞান ফিরেছে শুনে খুশি হয় ফাহাদ। রাতুলকে সুস্থ হতে দেয়া যাক তবে।
ফাহাদ নিজেও সিদ্ধান্ত নেয় তার নিজের ও সুস্থ হবার দরকার। লকেট টা সাথে থাকায় সে এপর্যন্ত কখনোই কিছু টের পায় নি। কিন্তু সে প্রকৃতপক্ষে কতটা অসুস্থ তা সেদিন টের পেয়েছে। ! সিদ্ধান্ত নেয়, বেশ কিছুদিন রেস্ট নিবে সে। সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে গেলে তারপর ই কেবল লকেট টা পরবে।যাতে করে কখনো লকেট শরীর থেকে বিচ্যুত হলেও ফাহাদ ভূপাতিত না হয়।
রাতুলের সাথে আর দেখা করে না সে। সুবাতা রাতুলকে খাবার দেয়ার পর বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়েছে। সুবাতাকে একটা রিমোট এবং নোটপ্যাড দেয় ফাহাদ। রিমোট টা দিয়ে রাতুলের রুমের বাথরুমের দরজা খোলা যাবে। নোট প্যাড টায় রাতুলের হারনেসে থাকা ক্যামেরার ভিডিও চলছে।
সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে নিজের রুমের দরজা লক করে শুয়ে পরে ফাহাদ।
গলা থেকে আস্তে আস্তে লকেট টা খুলে সে। হাতে মুঠো করে লকেট টা ধরে বিছানার চাদর থেকে কয়েকইঞ্চি উপর হাত উঠিয়ে লকেট টা হাত থেকে ছেড়ে দেয়। যাতে হঠাৎ দুর্বল বা অজ্ঞান হয়ে পরলে যেন হাতটা গিয়ে লকেটের উপরে-ই পরে।
কিন্তু না আজ ঐদিনের মত হঠাৎ দুর্বল হয়ে যায়নি সে। কায়রো ফিরে সঠিক খাওয়াদাওয়া আর একটু মেডিসিন নেয়ার ফলে প্রকৃতপক্ষে ই সে একটু সুস্থ বোধ করছে। তবে ভিতরে ভিতরে খুব দুর্বল ফাহাদ।
এ দুর্বলতাটাকে কাটাতে হবে তার। সে সিদ্ধান্ত নেয় দ্রুত-ই একজন চিকিৎসকের সাথে দেখা করবে এবং সুস্থ হওয়ার জন্য চিকিৎসা নিবে।
.
.
.
সুবাতা প্রকৃতপক্ষেই একজন সাধাসিধে মেয়ে। রাতুল এই সরলতার সুযোগ নিয়েই ওক ব্যাবহার করেছিল দিনের পর দিন।মানুষের প্রকৃত ভালোবাসা পেয়ে একজন সাধারণ মানুষের মত জীবন ধারণ করা থেকে সুবাতাকে বঞ্চিত করেছিলো রাতুল।
স্বামী হারানোর শোক টা অনেক টাই কমে এসেছে সুবাতার। প্রতিটা মেয়ের মনেই মাতৃত্ব থাকে। সুবাতার ও সে অনুভূতি ফাহাদের প্রতি কাজ করতে থাকে।
আইনগত ভাবে কিংবা ধর্মীয় মতে ফাহাদ সুবাতার ই সন্তান। সুবাতা ফাহাদের মাঝে নির্ভরতা খুঁজে পায়। যে ছেলে বাচ্চা অবস্থায় ঘর ছেড়ে আজ এত বড় আলিশান বাড়িতে বসবাস করতে পারছে, সেই ছেলের চিন্তাভাবনার প্রতি সম্মান চলে আসে সুবাতার। সিদ্ধান্ত নেয় কোন অবস্থাতেই ফাহাদের মতের অমান্য করবে না । রাতুলের রুমের বাথরুমের দরজা অন করে দেয় সুবাতা। ফাহাদ চাচ্ছে রাতুল খুব দ্রুত ই সুস্থ হয়ে উঠুক। এজন্য ভালো খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি গোসল এবং টয়েলেটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
কিচেনে, সুবাতা বাজারের জিনিসপত্র কি কি কেনা হলো তা দেখতে গিয়ে একটা লাল প্লাস্টিক বক্স খুঁজে পায় ।কৌতূহলী মন নিয়ে সে বক্স টা খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় তার।সেখানে রয়েছে,
হ্যাক-স ব্লেড,
ব্যান্ডেজের কাপড়,
একটা চাবুক,
নেইল পুলার,
হাতুড়ি,
সুঁই
এবং একটা উন্নত মানের লাইটার.
.
ঘরের সাধারণ জিনিসপত্রের সাথে চাবুক এবং নেইল পুলারটা দেখে সুবাতা একটু হলেও অনুমান করতে পারে রাতুলের সাথে কি ঘটতে যাচ্ছে।
তবে সুবাতা নিজে একটুও ভয় পায় না। কারণ ফাহাদের আচরণ স্পষ্ট প্রমাণ করে সুবাতার প্রতি ফাহাদ দুর্বল। হয়ত তার বাবার বৌ ছিল সুবাতা এজন্য ই দুর্বল, অথবা ফাহাদ সুবাতার ভিতর তিং মাং এর ছায়া খুঁজে পায় এজন্য দুর্বল। নইলে অন্তত আজ রিমোট এবং নোটপ্যাড বিশ্বাস করে সুবাতার হাতে দিত না ফাহাদ।
রাতুলকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলার কথা ফাহাদ কেন বলত তা এতদিনে আন্দাজ করতে পারলো সুবা।মনে মনে কিছু একটা কল্পনা করতেই অজান্তেই গায়ের সব লোম গুলো শিউড়ে উঠে সুবার....
.
.
.
.
.
( চলবে)

Post a Comment

أحدث أقدم