ব্লাক ক্যাফেটেরিয়া পর্বঃ ৫
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ
আলফার গলার শব্দ অনুসরণ করে রিও অনেকক্ষন দৌড়ে পথ চলার পর একটা ফাঁকা জায়গার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়।ততক্ষনে রিওর পা থেকে রক্ত ঝড়া শুরু হয়েছে। জংগলের কাটাযুক্ত লতাপাতায় পাগুলো বার বার আটকে গেলেও রিও থামায় নি তার দৌড়ানো। শত বাঁধা উপেক্ষা করে ছুটে এসেছে আলফার কাছে। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে চোখ বের করে নিঃশব্দে উঁকি দেয় সে।
বেশ কিছু জংলী যুবক যুবতীরা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা কে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরে নাচ গান করে চলেছে। পাশেই একটা বটবৃক্ষ। বৃক্ষটির মোটা শিকড়ের উপরে বসে বৃদ্ধরা গানের তালে তালে মাথা দুলাচ্ছে।
রিও আরেকটু ভালো করে খেয়াল করে,
অর্ধনগ্ন জংলী মানুষগুলো একা নয় সেখানে।
আছে আধুনিক শার্ট প্যান্ট পরিহিত শহুরে মানুষরাও।
শহুরে লোকদের প্রত্যেকের কাছেই দেখা যাচ্ছে দু-নলা হাত বন্দুক ।
বটবৃক্ষের পাশে চার পা শক্ত করে বেঁধে আলফাকে ফেলে রাখা হয়েছে। রিওর উৎসুক চোখ তখন খুঁজে বেড়াচ্ছিলো হেলেনের অস্তিত্ব।
কোথাও হেলেনকে দেখতে না পেয়ে রিও সন্তোপর্ণে ঘুরে আলফার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। নেকড়েদের ঘ্রাণশক্তি ঘোড়াদের চেয়েও প্রক্ষর হয়। রিওর গায়ের ঘ্রাণ পেয়েই আলফা তার চিৎকার কমিয়ে ফেলে, মনে যেন আশার আলো খুঁজে পায় সে।
শহুরে সাহেবদের সাথে মিলে গ্লাসে করে মদ্যপান করছিলেন বৃদ্ধরা, এদিকে যুবারাও উৎসবের আনন্দে নাচা নাচি করছিলো। রিও এই সুযোগে ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে রিও। মাটির সাথে নুয়ে নুয়ে এগিয়ে যায় আলফার কাছে।
মোটা দঁড়ির গিঁট খুলতে শুরু করে দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে। রিও অনেক বুদ্ধিমান হওয়ায় আলফার সামনের পা দুটোর গিট্টু একটু কষ্টের পরে খুলে ফেলতে সক্ষম হয়।
বাকি পা দুটো মুক্ত করতে অবশ্য তেমন বেশি বেগ পেতে হয়নি। আলফা এবং রিওর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঁধন খুলে যায় সহজেই। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে অন্য জায়গায়। আলফা দাঁড়াতে গিয়ে বুঝতে পারে তার পায়ে হাঁটার মত ও শক্তি নেই। একবার উঠতে গিয়েই আবার ধরাম করে পরে যায় আছাড় খেয়ে।
টের পেয়ে যায় বনদস্যু রা। নাচ থামিয়ে হাতে ধাঁরালো অস্ত্র নিয়ে হই হই করে ছুটে আসে তারা। ততক্ষনে কোনরকম লাফ দিয়ে ঝোপেড় আড়ালের অন্ধকারে চলে গিয়েছে আলফা ও রিও ।
মশাল নিয়ে ওদের দুজনের পিছু করতে চাইলে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয় তাদের সর্দার। একটা নেকড়ের পেছনে ছুটে, লাখ টাকার চুক্তি নষ্ট করার কোন মানে হয়না। শহর থেকে কিছু স্মাগলার এসেছে। বনদস্যুদের সর্দারের সাথে ডিল হয়েছে তাদের।
অস্ত্র এবং মাদকদ্রব্য চালান দিতে হবে, জংগলের এ পাশ থেকে ওপাশে।
এ কাজটি করে দেয়ার মত সবথেকে নিরাপদ হলো বনদস্যুরাই। কারণ পুরো জংগলটা ই ওদের দখলে।
আঁকাবাকা জংলী পথ পাড়ি দিয়ে ওরা ই খুব দ্রুত, কম সময়ে, এবং নিরাপদে পৌঁছে দিতে পারবে ওদের অবৈধ সব জিনিসপত্র।
.
.
আলফা কোন রকমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে এগুতে থাকে। এই জংগলেই একটা বিরল লতানো গাছ আছে, নাম 'ডিকয়'। এ গাছের পাতা এখন আলফার সেরে ওঠার জন্য খুব ই জরুরী হয়ে পড়েছে। তিন চারটে পাতা চিবিয়ে খেলেই আবার পূর্ণ শক্তি চলে আসবে আলফার শরীরে। রিও জানে যেখান থেকে আলফাকে মুক্ত করেছে সে, সেখানে হেলেন নেই। তাহলে আলফা এত সহজে অন্য পথে পা বাড়াত না।
প্রায় আধা ঘন্টা পথ চলার পরে ডিকয় গাছটি খুঁজে পায় আলফা। কয়েকটি পাতা চিবিয়ে খেয়ে নেয় সাথে সাথে। আলফার দেখাদেখি রিও ও কিছু পাতা চিবুতে থাকে। কিন্তু পাতার স্বাদ ভয়ানক রকমের তিতে হওয়ায় রিওর বমি চলে আসে। সে জিহবা বের করে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করতে থাকে। ততক্ষনে আলফা তার গায়ে পূর্ণ শক্তি ফিরে পেয়েছে। জংগলে রাতের থমথমে পরিবেশে কাঁপন ধরিয়ে গলা উঁচু করে বিশাল এক হুংকার দেয় আলফা। ভয়ে কিছু পাখ পাখালি অন্ধকারেই এলোপাতাড়ি উড়ে এদিক সেদিক চলে যায়। রিও তখন ও জিহবা বের করে তিক্ত স্বাদের জন্য এদিক সেদিক লাফাচ্ছে। আলফা রিওকে দেখেও না দেখার মত ভান করে, হুট করে ছুটে চলে যায় কোন এক দিকে। আলফার এরকম স্বার্থপর আচরণ দেখে কয়েক সেকেন্ড ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিও। মনে মনে অনেক দুঃখ পায় সে।
.
.
.
সকালে ক্রুইফ দম্পতি তাদের বাসার ছেলেটিকে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকা অবস্থা উদ্ধার করে। ছেলেটির চোখেমুখে পানির ছিটে দিতেই চোখ মেলে তাকায় ।
কাল রাতেও চোখে ঘোর অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখে নি সে। কিন্তু এখন দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। তবে চোখের পাতা ব্যথা করছিল তার
।জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই দৌড়ে হেলেনের রুমের থেকে কান্না করতে করতে দূরে চলে যায় ছেলেটি।
ক্রুইফ ওকে রেডি হয়ে নিতে বলেন। ক্যাফেটেরিয়া টাও তো খুলতে হবে। ক্রুইফ জানালা ঠিক করার জন্য কিছু লোক ও খবর দেয়।
আজকালকার মিস্ত্রীগুলো অনেক আলসে। কাজ করতে অনেক সময় ব্যয় করে। কিন্তু নিরলসভাবে কাজ করলে ভাংগা কাঁচের জানালাটা দুপুরের মধ্যেই ঠিক করে ফেলা যাবে। ক্রুইফ চাচ্ছে, সন্ধ্যায় যাতে ওহমা এসে সব কিছু ঠিকঠাক দেখতে পায়। আরেকটা ব্যপার ক্রুইফ লক্ষ্য করে,তা হলো ওহমা কাল যে কয়েকজনকে ছুড়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিল তাদের কারো কোন অস্তিত্ব সেখানে নেই। যাক, তার মানে বেঁচে আছে লোকগুলো।
নিশ্চিন্ত হয় ক্রুইফ।
.
.
.
.
সেদিন সকাল থেকেই ক্যাফেটেরিয়ায় মোটামুটি ভীড় লেগেই ছিলো।
চায়ের কাপ এবং চামচের টুং টাং আওয়াজের সাথে কথার গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে ছিলো চারদিক। বেশি টাকা পারিশ্রমিকের কথা শুনে মধ্যাহ্ন পার হওয়ার আগেই ঠিক হয়ে যায় ক্যাফেটেরিয়ার জানালা।
চা - কফি খেতে আসা লোকজন দের কাছে একটা গুজবও শুনতে পায় ক্রুইফ। মানুষের থেকেও আকৃতিতে বড় একটা নেকড়ে নাকি দাঁত বের করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মফস্বলের চারদিকে। ছোট ছোট বাচ্চারা ভয়ে বাইরে নামছে না। বাবা মায়েরা বিপদ আসন্ন ভেবে পুলিশে খবর দিয়েছে। মোট কথা একটা হুলস্থুল কান্ড হতে চলেছে সব মিলিয়ে। ক্রুইফ সাহেব গালে হাত দিয়ে দৃষ্টি দরজা থেকে বাইরের দিকে রেখে ভাবছিলেন, এত লম্বা জীবনে সে কখনো শুনে নি, একটা নেকড়ে দেখতে মানুষের চেয়েও বড় হয়। চোখের সামনে সে কল্পনা করতে থাকে, ঠিক কত বড় হতে পারে নেকড়ে টা!!
ধবধবে সাদা,
লম্বা গায়ের লোম,
উচ্চতায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ফিট,
লম্বায়!! দশ ফিটের মত!! নাকি কম বেশি হবে! আন্দাজ করতে পারছে না সে। যেন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে বেশ বড় একটা নেকড়ে তার দোকানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে!!
ক্যাফের ভিতরে থাকা লোকজন চিৎকার চেচামেচি শুরু করে যে যেখান থেকে পারছে দৌড়ে বের হয়ে যেতে থাকে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকেন ক্রুইফ, কারো কারো হাত থেকে মেঝেতে চায়ের কাপ পরে চৌচির হয়ে গেছে।
দরজা থেকে সবাই ছুটে বেড়িয়ে যাচ্ছে আর আওয়াজ করছে, নেকড়ে নেকড়ে!! পালাও পালাও!!!!
ক্রুইফ সাহেব দু হাত দিয়ে ভালোভাবে চোখ পরিষ্কার করে দেখেন, যেটাকে সে এতক্ষন তার কল্পনা ভেবেছিলো সেটা আসলে তার কল্পনা নয়!
সত্যি।
.
.
.
আসর এর আযান হয়ে যাওয়ার পর পর ই একটা জিপ এসে থামে ক্রুইফ এর ক্যাফেটেরিয়ার সামনে।
দরজা খুলে বাইরে আসে এক যুবক।
বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশ হবে।
গায়ের রং উজ্জল ফরসা।
চুলগুলো সিল্কি, বাতাসে দোল খাচ্ছে,
কালো বুট, আর্মড জ্যাকেটের সাথে কালো চশমাটা বেশ মানিয়ে গেছে ছেলেটির সাথে। গোলাপি ঠোঁটের একটু উপরে ছোট্ট তিলটা ছেলেটার চেহারাকে আরো বেশি মায়াবি করে তুলেছে।
ক্রুইফের দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন সিনেমার নায়ক এসে তার সামনে উপস্থিত।
জিপ থেকে নেমেই ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে ঢুকে একদম সামনের সিটে বসে ছেলেটি। ক্রুইফ কে ভালো করে এক কাপ কফি পরিবেশন করতে বলে।
বাম হাতে সিল্কি চুল গুলো উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ম্যাচ দিয়ে জ্বালিয়ে নেয়।
ক্রুইফ এসে কফি দেয়ার সময়, দু ঠোঁটের মাঝে সিগারেট রেখে ছেলেটি বলে,
ভোর রাতে আপনার ক্যাফের সামনে থেকে পাঁচটি লোকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
আপনি কিছু জানেন এ সম্পর্কে!!
ক্রুইফ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। দরদর করে ঘামছিলো সে,
এর ভিতরেই ক্যাফেটেরিয়াতে প্রবেশ করে হেলেন।
ক্রুইফ কে কিছু বলতে যাবে, ঠিক এমন সময়ে চোখ পরে
সামনের সিটে বসা ফর্সা চেহারার ছেলেটির দিকে। নজর আর যেন ফেরাতে পারেনা সে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলেটির দিকে।
ছেলেটি বাম হাত দিয়ে মাথার চুল আবারো উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ক্রুইফ সাহেব! তারপর বলুন!
কাল পাঁচজনের মার্ডারের ব্যপারে কি জানেন আপনি!!
দেখুন, সব সত্য বললে ঝামেলা বাড়বে না। মিথ্যার আশ্রয় নিবেন ন।
ক্রুইফ সাহেব অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা নিচু করে বলেন,
ওহমা তকিতা,
কাল ওর সাথেই ঝামেলা হয়েছিলো লোকগুলোর।
"ওহমা ত কি তা!
বাসা কোথায়!"
-তা তো জানিনা!
বয়স কত?
- আজ পর্যন্ত চেহারা দেখিনি তার।
সমস্যা নেই। খুব দ্রুত ই দেখবেন। সাধারণ মানুষরা যা দেখে না, পুলিশ সেটা ঠিক ই দেখতে পারে।
তার কথা বলার ইতি ঘটে ক্রুইফ সাথে । হেলেন তখনো ঘোর লাগা চোখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেটির মুখপানে।
.
চলবে..

إرسال تعليق