ভালোবাসা তোমাকে দিলাম ছুটি

ভালোবাসা তোমাকে দিলাম ছুটি









বাবা হাসপাতালে ভর্তি । বাড়িতে শুধু মা আর ছোট বোন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বাবা। বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে নিদারুণ সংকটের মধ্য দিয়ে এখনকার সময়টা অতিবাহিত হচ্ছে। আমিও তেমন কিছু করতে পারছিনা। মাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। তারপর ও চাকরীর জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছি। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ও যেখানে হাজার হাজার তরুন চাকরীর জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে, পাচ্ছে না। সেখানে অনার্সে পড়া অবস্থাতেই আমার চাকরী পাওয়াটা অনেক, অনেকটা কঠিন ব্যাপার । তারপর ও চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদি কোনমতে একটা চাকরী পেয়ে যাই ।
এদিকে ছোট বোন সেদিন দেখলাম আম্মুর সাথে বলছে, কলেজের তিন মাসের বেতন বাকি পরে আছে, সামনে ওর পরীক্ষা । কলেজ থেকে নোটিশ দিয়েছে পরীক্ষার আগে দিতে হবে।
আমার পকেটে তখন দু টাকা ছিলো । এসব শোনার পর বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। বেরোতেই সামনে একটা আট-দশ বছরের ছেলেকে দেখলাম ছোট্র একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । হাটা দিয়ে একটু কাছে গেলাম। ছেলেটা দেখলাম তখনো কেঁদে যাচ্ছে । বাসার সামনের এই রাস্তাটায় যে ছেলেটাকে আমি নতুন দেখছি তা নয় । সেই ছোট থেকেই তাকে এখানে দেখে আসছি, তবে তখন সাথে তার মা ছিলো । আজ শুধু ছেলেটাকে, আর তার কোলে ছোট একটা বাচ্চা দেখছি । ছেলেটার নাম আমি জানি না। তবে তাকে আমি সংগ্রাম সাহেব বলেই ডাকি। এই নামে ডাকার পেছনে ও একটা গল্প আছে । থাক, সেটা অন্য কোন একদিন বলবো। থাকনা একটু রহস্য।
কাছে গিয়ে সংগ্রাম কে কাদার কারণ জিজ্ঞেস করতেই, আমার নিজের ও কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, চল সংগ্রাম সামনের ওই দোকানটায় তোকে নিয়ে ভালো কিছু খাওয়া যাক । ছেলেটে দুদিন না খেয়ে আছে, পানি ছাড়া তার নিজের পেটে তেমন কিছুই পরে নি। বাসায় বাসায় গিয়ে অনুনয়-বিনয় করে ছোট বোনের জন্য সামান্য কিছু খাবার পেয়েছে। সংগ্রামের কোলের মেয়েটা তার বোন। বয়স এক বছরের চেয়ে একটু বেশি হবে।
পকেটে দু টাকা নিয়ে, সাথে সংগ্রাম কে ভালো খাবার খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে..উন্নতমানের একটা রেস্টুরেন্ট এর ভেতরে যখনি চেয়ারে বসতে যাবো; ঠিক তখনি পেছনের টেবিলটায় আমার চোখ পড়লো। দেখলাম মিরা বসে আছে । মিরার সাথে আমার পরিচয়টা দীর্ঘদিনের। অনেকদিন পর দেখা, স্বাভাবিক ভাবেই ওর সাথে একটু কথা বলতে মন চাচ্ছিলো ! মনের তীব্র ইচ্ছাটাকে বাদ দিয়ে, সংগ্রামকে নিয়ে পাশের টেবিলটায় বসলাম। মিরা সম্ভবত আমাকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে কথা বলার জন্য ঠিকই ছুটে আসতো।
দোকানের একজনকে ডাক দিয়ে বললাম, ভাই ভালো কিছু খাবার দিন। লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে খাবার আনতে গেলো । আমি বসে ভাবতে লাগলাম পকেটে আছে মাত্র দু টাকা, খাবার খাওয়ার পর বিল একশ টাকার নিচে আসবে বলে মনে হয়না । টাকা কোত্থেকে দিবো ভাবছি, ঠিক তখনি মিরা সামনে দাঁড়ালো। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি একবার তাকিয়ে, চোখ সড়িয়ে নিলাম । আমার পাশেই এসে বসলো । আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি।
- কেমন আছো মাসুদ ?
- আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো আছি । তুমি ভালো আছো ?
- হ্যা, খুব ভালো আছি । তা আজকাল কি করছো? কোথায় আছো ? সেদিন তোমার মেসে গিয়েছিলাম, একজন বললো তুমি নাকি মেস ছেড়ে চলে গেছো ! কি হয়েছে বলবে কি ?
- চাকরীর জন্য ঘুরছি, হ্যা ; আগের মেস ছেড়ে দিয়েছি । এখন এক আত্মীয়ের বাসায় আছি । কিছু হয়নি মিরা, বাবা-মা-বোন নিয়ে এইতো বেশ আছি। তুমি কি করছো ?
- আমি লেখাপড়া ছাড়া আপাতত কিছুই করছিনা। তোমার চেহারায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ! কোন সমস্যা ?
- আমার কিছু টাকা লাগবে মিরা । দিতে পারবে ?
- অবশ্যই ! তুমি টাকা চেয়েছো আমি দিবো না সেটা ভাবলে কি করে ! বলো কত টাকা দরকার ?
- দুশো টাকা দাও । পরে দিয়ে দিবো।
- দুশো টাকা! কি করবে? তোমার পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে কিছু খাওয়ানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছো, আর তোমার পকেটে টাকা নেই ! তাইনা ?
- হ্যা, ঠিক ধরছো। টাকা নেই বললে ভূল হবে, দু টাকা আছে ।
- তুমি যা খাওয়ার খাও, বিল যা আসে আমি দিবো। টাকা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।
- আচ্ছা।
দুশো আশি টাকা বিল দিয়ে বাইরে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালাম। মিরা ও একটু পরে আমার পাশাপাশি এসে দাড়ালো।
- মিরা আরেকটা উপকার করতে পারবে ?
- বলো, এবার কার জন্য কি করতে হবে। নিজের জন্য তো তুমি আমার কাছে কখনো কোন সাহায্য চাওনি। আজ ও যে চাইবে সেটা ও বলছিনা।
- একটা দুধের প্যাকেট কিনে দিতে পারবে ?
- চলো । ওই দোকানটায় যাই ।
আড়াইশো টাকা দিয়ে একটা দুধের প্যাকেট কিনে সংগ্রামের হাতে দিয়ে বললাম, যা ব্যাটা। আর কাঁদবি না । এই প্যাকেট দিয়ে, তোর বোনকে কয়েকদিন খাওয়াতে পারবি ।
সংগ্রাম চলে গেলো । আমি মিরাকে উদ্দেশ্য করে যখনি কিছু বলতে যাবো, আমাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত দিয়ে আমার হাতটা টান দিয়ে, হাতের মুঠোয় কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো।
- মাসুদ, এখানে কিছু টাকা আছে । রেখে দাও। তোমার কাজে লাগবে।
প্রতি উত্তরে আমি বললাম, 'চলো তোমাকে বাসায় পৌছে দেই' ! মিরা একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আমি যে তাকে বাসায় পৌছে দেয়ার কথা বলেছি সেটা সে বিশ্বাস করতে পারছেনা, আবার পারছে !
- চলো ।
মিরাদের বাসার সামনে আসতেই মিরা থমকে দাঁড়ালো। এবার আমি ওর দিকে একটু তাকালাম। বহু পরিচিত মানুষটাকে বহুদিন পর এতো কাছ থেকে দেখছি । বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা ঠিক হবে না । আমি চোখ সড়িয়ে নিলাম। কেনো জানি মনে হচ্ছে মিরা কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি সামনের দিকে পা বাড়াতেই মিরা ডাক দিলো ! বহুদিন পর কারো মায়া মাখানো ডাক শুনতে পেলাম !
- মিরা কিছু বলবে ?
- না মানে, তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো। শুনবে একটু ?
- না, শুনতে ইচ্ছে করছে না । বাসায় যাও । আমি গেলাম। আল্লাহ্‌ হাফেজ।
মিরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি সামনে পা বাড়ালাম। একটু এগিয়ে গিয়ে, আবার একটু পেছনে তাকালাম। মিরা এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
আমি এবার আরেকটু দ্রুত গতিতে সামনে পা বাড়ালাম।
ফোন বাজছে । আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করতেই মিরার কন্ঠ শুনতে পেলাম !
- হ্যালো, মাসুদ ভালো আছো ?
- আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো। তুমি ভালো আছো ?
- হ্যা, ভালো । কি করছো এখন ?
- তেমন কিছু না । শুয়ে ছিলাম,তুমি ফোন দেয়াতে বিছানা থেকে ওঠে ফোন রিসিভ করলাম।
- তোমার কি শরীর খারাপ ? কথা কেমন যেনো শোনাচ্ছে !
- না মিরা, শরীর ভালো । কিছু হয়নি।
- আচ্ছা, ভালো। তুমি কি আগামীকাল ক্যাম্পাসের গেইটের বাইরে আমার সাথে দেখা করতে পারবে ?
- আচ্ছা , আমি দুটার দিকে চলে আসবো ।
- আচ্ছা, ঠিক আছে। রাখি এখন, ভালো থেকো ।
মিরা ফোন রাখার আগেই আমি রেখে দিলাম । স্কুলজীবনে মিরার সাথে পড়াকালীন সময় থেকে আমি ওকে পছন্দ করতাম । সে বিষয়টা সে প্রথমে জানতো না । আমি যে ওকে পছন্দ করতাম, ওকে দেখে যে জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতি মনের মধ্যে অনুভূত হয়েছিল সেটা আর কেউই জানতো না ! স্কুলজীবনে মিরা বাদে প্রায় সবার সাথেই টুকটাক কথা হতো, বেশিরভাগই ছিলো পড়ালেখা বিষয়ক। কিন্তু মিরার সাথে পড়ালেখা বিষয়ক কোন কথাও পর্যন্ত বলতাম না ! প্রচন্ড জড়তা থাকার কারনে ওর সাথে আমার কথা হতো না ! জড়তাটা শুধু ওর ক্ষেত্রেই কাজ করতো বেশি! জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতি ছিলো মিরা, সেজন্যই বোধহয় তাকে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই জড়তাটা অনেকটা বেশি কাজ করতো । তবে দূর থেকে বিভিন্ন ভাবে মিরাকে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করতাম। স্কুলের শার্টের হাতা গুটিয়ে, হোল্ড করে...একটুখানি ভালোভাবে নিজেকে মিরার সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালাতাম ! জানিনা সে তখন এসব খেয়াল করতো কিনা, তবে আমি দিনের পর দিন আরো অদ্ভুতভাবে ও নিজেকে দূর থেকেও ওর সামনে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করতাম। স্কুল ছুটির পর, ওকে একটু দেখার জন্য গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে পায়চারী করা বিকেল গুলিকে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় ! বহু অপেক্ষার পর যখন একদল ইউনিফর্ম পড়া মেয়েকে আসতে দেখতাম, বাইরে থেকেই দেয়ালের পাশে লুকিয়ে একই ইউনিফর্ম পড়া একদল মেয়ের মাঝে মিরাকে খুঁজে বেড়াতাম ! গেইটের কাছে আসতেই 'মিরা দেখে ফেলবে' এই ভয়ে অনেকটা আড়ালে চলে যেতাম ! প্রিয় মুখটাকে দুটা মিনিট দেখার জন্য, ক্লাস পিরিয়ড মিস দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গেইটের বাইরে অপেক্ষা করার মূহুর্তগুলো, আজ.. এতবছর পরও আমার কাছে অমূল্য ! কিন্তু সেই তিন শব্দের কথাটি বলা হয়নি কখনো ! স্কুলজীবনটা এভাবেই কেটে গেলো। কলেজ লাইফটাতে ও মিরাকে প্রায় সবসময়ই আড়াল থেকে এভাবে দেখে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বলা হয়নি কোনো অনুভূতির কথা। মিরা এখনো এই ব্যাপারে কিছু জানে না ! আর যদি জেনে ও থাকে সেটা আমাকে বুঝতে দিচ্ছে নাহ !.. এসব ভাবতে ভাবতে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম ।
অনেকদিন স্বপ্ন দেখা হয়না !
সকালে ঘুম ভাঙলো কারো কান্নার শব্দ শুনে ! আমি অনেকটা থতমত খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে মায়ের রুমে যেতেই দেখলাম এক জটলা মানুষ মায়ের বিছানার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ! আমি একটু কাছে গেলাম । মায়ের নিথর, নিস্তব্ধ দেহটার পাশে বসলাম। ছোটবোন কাঁদতে কাঁদতে প্রায় বেহুঁশ হবার মতো অবস্থায় ! আমি চোখ বুঝে মায়ের কপালে হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। সবাই বেরিয়ে গেলো । আজ এতো বড় হয়ে যাওয়ার পরও যে মানুষটা রোজ আমাকে মুখে তুলে নিজ হাতে খাইয়ে দিতো, কিছুক্ষণ পর পর আমার রুমে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো 'বাবা, তুই চিন্তা করিস না, তোর বাবা ঠিক হয়ে যাবে.. তুই মন দিয়ে লেখাপড়া কর'.... সেই মানুষটা আর নেই ! আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। চোখে পানি আসার উপক্রম হলেও, আসতে দিলাম নাহ!
মায়ের কোন রোগ ছিলোনা । হয়তো এই পরিবার, বাবার অসুস্থতা এইসব চিন্তা করতে করতেই...!!
সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে গেলো ! দুপুর দুটার মধ্যেই জানাজা হয়ে গেলো... কবরস্থানে মায়ের মৃতদেহ দাফন করে দুপুর তিনটার দিকে বাসায় ফিরলাম। ছোটবোন আমার রুমে বসে কাঁদছে । আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম, ওকে কোন প্রকার শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমি আবার বাসার বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাসার বাইরে আজ সংগ্রাম কে দেখতে পেলাম না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটছি..প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । মিরাদের বাসার সামনে এসে কিছুটা সময়ের জন্য দাঁড়ালাম ! ওকে একটু দেখতে ইচ্ছে করছিলো ! চার মিনিটি পর মিরা নিচে নেমে আসলো । বাসার গেইট খুলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
- তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো মাসুদ ?
- কেমন ! একটু অন্ধকার তো তাই তুমি ভুল দেখছো।
এটুকু বলে আমি চশমাটা একটু ঠিক করে নিলাম । আমার চশমা পড়া শুরু সেই ক্লাস নাইন থেকে।
- আচ্ছা, চলো আমার বাসায় চলো।
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর মিরাই আরেকটু এগিয়ে এসে আমার হাতটা টান দিয়ে ধরে বাসার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। সিঁড়ির সামনে এসে আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। মিরা একবার পেছনে ফিরে বললো 'এসো' । আমি মিরার পেছন পেছন ওদের ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলাম। মিরা আমাকে বসিয়ে রেখে ওর রুমে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই ওর বাবা-মা এসে আমার সামনে বসলো। শার্টে হাতা ছেড়া, জুতা ও জোড়াতালি দিয়ে রেখেছি । প্যান্টের অবস্থাটা অবশ্য ভালো। মাত্র এক বছর ধরে এটা পড়ছি । মিরার বাবা-মা সামনে আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম ! দুজনেই আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একনজর দেখলো। একটু বসলো। তারপর আবার চলে গেলো ! আমি বিষয়টা আঁচ করলাম। মিরাদের বাসা থেকে বেরিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর উকি দিয়ে ভেতরে তাকালাম। মিরা তাহলে এতোক্ষণ সাজগুজো করছিলো ! নীল শাড়ী, নীল চুড়ি, ঠোটে হাল্কা লিপস্টিক ! কয়েক সেকেন্ড আমি এক দৃষ্টিতেই ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। একটু পরেই দেখলাম ও চোখের পানি মুছছে !
নাহ, এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। আমি বেরিয়ে পড়লাম । হাসপাতালে গিয়ে বাবার খোজ নেয়া দরকার। আমি হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মিরাদের বাড়ি ত্যাগ করলাম ।
হাসপাতালের সামনে পৌছুতেই মনে হলো আজ কেমন যেনো থমথমে ভাব বিরাজ করছে । আমি গুটি গুটি পা ফেলে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাবার কেবিনে গিয়ে দেখি বাবা নেই ! মাথা ঘুরতে শুরু করলো ! গুটি গুটি পা ফেলে আমি রিসিপশনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। যতোই এগোচ্ছি, বুকের বাম পাশের ব্যাথাটা ততো বৃদ্ধি পাচ্ছে। রিসিপশনে গিয়ে বাবার কেবিং নং আর নাম বলতেই.. রিসিপশনে বসে থাকা লোকটা আমাকে যা শোনালো.. সেটা শোনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না ! এবার আমার ভেতরে একটু খারাপ লাগা শুরু করলো!
আমি ধীরে ধীরে অন্ধকার একটা ঘরের দিকে এগোতে লাগলাম। আমি ওখানে প্রবেশ করতেই কেনো যেনো একটু মাত্রাতিরিক্ত অন্ধকার মনে হলো! হাতে টর্চ নিয়ে আমার পেছন আরো দুজন লোক লাশ রাখার এই ঘরে প্রবেশ করলো। একজন আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে, আর আরেকজন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ও সামনের জনের পিছুপিছু নিয়ে যেতে লাগলো জড়িয়ে ধরে থাকা লোকটা। বাবার নিথর, নিস্তব্ধ দেহটা আমার সামনে আনা হলো। মুখের উপর থেকে সাদা কাপর সরানো হলো।
আমি বাবার কপালে হাত রাখলাম। খুব কাছে থেকে বাবার চোখের দিকে তাকালাম! যে চোখ বারবার শুধু একটি কথাই বলছে.. ''বাবা! তুই একদম ভেঙে পড়িস না। আমাদের জন্য চিন্তা করবি না। তোর বোনটা কে একটু দেখে রাখিস। আর নিজের খেয়াল রাখিস'' !
এবার আমার চোখ বেয়ে একটু একটু অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। তারপর ও আমি যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলাম।
ওখান থেকে আমাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা হলো। হাসপাতালের বারান্দায় এসে দেখি কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিরাও দাঁড়িয়ে আছে ! আমাকে বাদে, প্রায় সবাই কাঁদছে ! আমার বাবা মারা গেছে। পরিবার বলতে আমি আর আমার ছোট বোন ছাড়া আর কেউ নেই। যেই কষ্টটা পেয়ে আমি কাঁদার কথা... সেটা আমার বন্ধুরা কিংবা মিরা কেনো পাচ্ছে ! আমার বন্ধু মারুফ এসে আমাকে ধরে বেঞ্চে বসালো। আমার দু পাশে প্রায় সবাই বসলো। শুধু বরাবর সামনে মিরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার মিরার দিকে তাকালাম। চোখে চোখ পড়লো। আমি কয়েক সেকেন্ড মিরার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মিরা এবার চোখ নামিয়ে ফেললো। মনে হচ্ছে মিরা কিছু বলবে। বাবা মারা গেছে, আমাকে সে এই নিয়ে কোন শান্তনাই দেবেনা। মিরা এটা ভালো করেই জানে, আমার প্রচণ্ড কষ্টের মুহূর্তগুলিতে কারো শান্তনায় আমি বিন্দুমাত্র ও ভ্রুক্ষেপ করিনা। মিরা অন্যকিছু বলবে।
আমি খেয়াল করলাম মিরার চোখের কোণে এবার বিন্দু বিন্দু পানি জমতে শুরু করলো। এবার আমার খুব করে মনে হলো মিরা আসলেই এমন কিছু বলতে চাচ্ছে, যেটা বলতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে ! আবার আমাকে না বলে ও থাকতে পারছে না !
- মাসুদ আমি আগামীকাল আমার গ্রামের বাড়ি চলে যাবো। কবে ফিরবো, তাও জানিনা। হয়ত এই শহরে আর কোনোদিন না ও ফিরতে পারি। তোমাকে খুব মনে পড়বে!
'তোমাকে খুব মনে পড়বে' এটা বলেই মিরা অন্যদিকে মুখ লুকালো। মিরা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। প্রচণ্ড জোড়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ! আমি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলাম। এটা মিরা তো ?
হটাতই মিরা আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আমি বুঝেও বুঝতে পারলাম না মিরার কান্নার কারন! জীবনে কিছু কিছু সময় অনেক কিছু খুব করে অনুভব করলে ও, 'আমি কিছু বুঝি,আমাকে এসব বোঝা মানায় না!' এসব ভেবে এড়িয়ে যেতে হয়। আমি এড়িয়েও গেলাম না, আবার এটা নিয়ে বেশি ভাবলাম ও না !
- আমাকে একটু এগিয়ে দিবে?
মিরা এই শহর ছেড়ে চলে যাবে, এটা ভাবতে এবার একটু খারাপ লাগা শুরু করলো! শরীরের কাঁপুনি ও শুরু হলো! আমি মারুফদের হাসপাতালে রেখে মিরাকে এগিয়ে দেয়ার জন্য পা বারালাম।
- চলো।
রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিরাকে নিয়ে হাটছি। মিরা কোন কথা বলছে না। আমি ও চুপচাপ হাটছি। মিরা এমনিতেই রুপবতী। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিরাকে অনন্য রুপবতী লাগছে! আমি একটু মিরার দিকে তাকালাম। মিরা ও তাকালো। চোখাচোখি হলো। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সামনের দিকে তাকিয়ে হাটা শুরু করলাম।
মিরা হয়তোবা এখনো জানে না, আমার জীবনের প্রথম প্রেম.. প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি ওকে দেখেই হয়েছিলো! এতোটা বছর বিন্দু বিন্দু করে ভালোবাসার যে পাহাড় আমি তৈরি করেছি, ভালোবাসার সে পাহাড়ের কথা মিরা কোনোদিন ও জানতে পারবে না ! এই মুহূর্তে স্কুল জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়লো। জীবনের এই মুহূর্ত পর্যন্ত স্মরণীয় ঘটনায়গুলির মধ্যে এটা অন্যতম!
তখন ক্লাস টেনে পড়ি । স্বাভাবিকভাবেই ক্লাসের কোনো মেয়ের সাথে তেমন একটা কথা হতো না। মিরার সাথে ও না! হটাত একদিন, বিরতির সময় বাইরে থেকে ক্লাসে এসে দেখলাম জানালার ধারে একটা বেঞ্চে মিরা.. বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মিরা কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না! আমি একটা বেঞ্চ টেনে.. মিরা একপাশে এসে বসলাম। এবার মিরা একটু নড়েচড়ে বসেছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে, আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এবার আমি আবার দাঁড়ালাম! মিরার সামনে গেলাম! টান দিয়ে ওর বা হাতটা ধরলাম ! ও একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কোনো কথা বলছেনা! আমি হাতটা ছেড়ে দিয়ে.. বসে, আবারো মিরার হাতের উপর আমার হাতটা রাখলাম। মিরা কিছু বললো না। কথা বলার অনেক চেষ্টা করলাম। দুয়েকটা জোক্স ও বললাম, তাতে ও মিরার কোন ভ্রুক্ষেপ দেখলাম না!
মিরাকে হাসানোর, আমার সাথে একটু কথা বলানোর আধ ঘন্টার ওই মুহূর্তের কথা এখনো বড্ড মনে পড়ে ! যে মিরার সাথে স্কুল জীবনে কথা বলার হাজারো প্রয়াস চালিয়ে ও, তেমন একটা কথা বলতে পারিনি.. সেই মিরাই একটু আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে!
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মিরার বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি খেয়ালই করেনি। মিরা এখনো কাঁদছে! কান্নার শব্দ পাচ্ছি! এ কান্না আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না।
- মাসুদ, আসি। ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করো। রাত বিরাতে বাইরে ঘুরাফেরা করো না। আর পারলে সংগ্রাম কে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসো! আর...
মিরা এটুকু বলে থামলো। রাত অনেক হয়েছে। আমার গ্রামের বাড়ির, পাশের গ্রামেই মিরার বাড়ি! বেশিদূর না। হেটে গেলে পনেরো মিনিটের পথ। গ্রামে আমাদের একটা ছোট বাড়ি আছে। বাবা মাঝেমধ্যে ওই বাড়িতে গিয়ে থাকতেন। কলেজে পদার্পণ করার পর থেকে,আজ পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়নি।
- আচ্ছা, ঠিক আছে.. মিরা। যাবো । রাত অনেক হয়েছে, বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ো।
মিরা কাঁদতে কাঁদতে গেইট অতিক্রম করে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো। একবার পেছনে ফিরে তাকালো। চোখে তখনো আমি পানি দেখেছি। মিরা বাসার ভেতরে চলে গেলো। আমি তারপর ও কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
রাত প্রায় এগারোটার কিছু বেশি হয়েছে। আমি হাসপাতালের উদ্দেশ্য হাটা শুরু করলাম। পথিমধ্যেই সংগ্রামের সাথে দেখা গেলো। কোলে এখনো তার ছোটবোন। ছলছল চোখে সংগ্রাম আমার দিকে তাকালো। আমি কিছু বললাম না। হাটতে শুরু করলাম। সংগ্রাম ও আমার সাথে হাটা শুরু করলো। পথিমধ্যে সংগ্রাম কোনো কথা বললো না। গুণগুণ করে কান্নার শব্দ পেলাম । সংগ্রাম কাঁদছে! সংগ্রাম কাঁদছে কেনো ?
হাসপাতালে পৌঁছে দেখি মারুফ সহ বাকি সবাই মিলে হাসপাতালের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, বিল সব পরিশোধ করে আমার জন্য বসে আছে। একটা এম্বুলেন্স নেয়া হলো। বাসার পাশের মসজিদের হাফেজ সাহেব কে ডেকে জানাজা পড়িয়ে, কবরস্থানের উদ্দেশ্যে বাবার নিথর নিস্তব্ধ দেহটা নিয়ে যেতে শুরু করলাম। মারুফ সম্ভবত এখানকার কাউকে বলে ঠিক মায়ের কবরের পাশেই বাবার কবরটা করার ব্যবস্থা করেছে। বাবার লাশ দাফন করে সংগ্রাম কে মারুফের কাছে দিয়ে, আমি বাসার উদ্দেশ্যে চলে আসলাম। এসেই দেখি ছোটবোনের পাশে তার কয়েকজন বান্ধবী বসে আছে। খাবার নিয়ে এসেছে। কিন্তু বোন আমার একেবারেই ভেঙে পড়েছে। খাচ্ছেনা কিছুই। আমি ওকে খেয়ে নিতে বলে হাতমুখ ধুতে গেলাম। এসে দেখি বোন আমার শুয়ে পড়েছে। ওর বান্ধবীরা ও ততোক্ষণে চলে গেছে। আগামীকালই এই শহর ছেড়ে দেবো। বাবা-মা দুজনেই থাকবে এই শহরে, শুধু আমি থাকবো না! এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সব রেডি করে ফেলেছে বোন। আজকে মিরা ও এই শহর ছেড়ে চলে যাবে, আমি চলে যাবো। রেডি হয়ে, ছোটবোন কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশনে গিয়ে মারুফদের দেখা পেলাম। মারুফ পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিলো। আমি মারুফ সহ সবাইকে একবার জড়িয়ে ধরে, একটু কাঁদলাম!
একটু পর ছোটবোনকে নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম! বাসে উঠার আগে, মারুফ আরেকটা কান্ড ঘটালো! একটা টাচস্ক্রিন মোবাইল আমার ব্যাগের এক পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে ইশারায় চুপ করে.. মোবাইলটা রেখে দিতে বললো!
আমি আর কিছু বললাম না। একটু তকিয়ে থেকে বোনকে নিয়ে সিটে গিয়ে বসলাম। বাস ছেড়ে দিলো। প্রথমে মন্থর গতিতে চললে ও একটু পড়েই প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকলো।
বিকাল প্রায় সাড়ে চারটা বাজলো গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছতে। গ্রামের পরিবেশটা অনেকটা আগের মতোই আছে। আগের থেকে কিছুটা উন্নতি ও হয়েছে। রাস্তাঘাটের ও বেশ উন্নতি হয়েছে। বাড়িতে বেশ জঞ্জাল জমে রয়েছে। ছোটবোন কে নিয়ে সেসব জঞ্জাল পরিষ্কার করে, গ্রামের বাড়িটাকে গুছাতে গুছাতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এতোদিন পরে গ্রামে আসতে দেখে ততোক্ষণে অনেকেই এসেছে আমাদের বাড়িতে। এখন আর বোন একা না। পাশের বাড়ির এক বড় আপুর সাথে বোন বেশ মিশে গেছে দেখে ভালো লাগলো। মনে একটু প্রশান্তি অনুভব করলাম। ইতিমধ্যে পাশের বাড়ির রহিম চাচা এসে বলে গেছে আগামী এক সপ্তাহ যেনো আমি কোনো বাজার না করি। তিনি চাল, ডাল সহ আনুষঙ্গিক আরো অনেক কিছুই দিয়ে গেলেন। আমি একটু বাইরে বেরুলাম। দীর্ঘ অনেকদিন পর গ্রামের রাস্তায় হাটছি। পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হলো। মিরাকে একটু দেখতে ইচ্ছে হলো। তারপরও আমি ওদের গ্রামে গেলাম না। বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় ফিরে রান্না ঘরে যেতে বেশ চমক খেলাম! মিরাকে দেখলাম, ওর আম্মু সহ আমার ছোটবোন কে রান্নার কাজে সাহায্য করছে।
মিরার আম্মু আমাকে চেনেন দীর্ঘদিন ধরেই। এক কথায় মিরার আম্মুর সাথে আমার পরিচয় সেই স্কুল জীবন থেকেই। বেশ ভালো সম্পর্ক মিরার আম্মুর সাথে। কিন্তু মাধ্যমিক ছাড়ার পর আর যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি। মিরার আম্মু আমাকে দেখলেন। আমি আমার রুমে এসে বসলাম। মিরার আম্মুও আসলেন। বাবা-মা মারা গেছেন। এটা ওনি সম্ভবত মিরার কাছেই শুনেছেন। আমাকে শান্তনাসূচক অনেক কথাই বললেন! এক পর্যায়ে মিরার আম্মু আমাকে নিজের ছেলের মতো বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন! আমার নিজের আম্মুর কথা মনে পড়ে গেলো! আমি নিজেকে অনেক চেষ্টা করে ও ধরে রাখতে পারলাম না। কেঁদে দিলাম। মা ছাড়া, এতোটা আদর-স্নেহ কারো কাছ থেকেই পাইনি! মিরার আম্মু আমাকে কাঁদতে নিষেধ করে.. আবারো রান্না ঘরে গেলেন। আমি বিছানায় গা'টা একটু এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলাম।
কিছুক্ষণ পরেই মিরা রুমে আসলো। রুমের লাইট অফ করে শুয়েছিলাম। মিরা এসে লাইট জ্বালালো। আমি শোয়া থেমে উঠতে গিয়েও উঠলাম না। মিরা আজ চোখে কাজল দিয়েছে। নীল শাড়ীর সাথে নীল চুড়ি ও পড়েছে! আমি একবার তাকিয়ে, আর তাকালাম না। নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের কারো মায়ায় পড়ে যেতে নেই।
মিরা আমার পাশে এসে বসলো। আমাকে কিছুটা অবাক করে দিয়েই আমার মাথায় হতা রাখলো! আমি কেপে উঠলাম!
- আরে! ভয় পাচ্ছো কেনো? আমিই তো!
মিরার এই কথা শোনার পর আমি আবারো মিরার দিকে তাকালাম, এবারো বেশিক্ষণ তাকিয়ে রইলাম না। মিরা আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। কিন্তু কোন কথা বলছে না।
- মিরা তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে!
এটা বলা মাত্রই মিরা কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে চলে গেলো। আমি কিছু বুঝতে চেষ্টা করলাম না ।
কিছুক্ষণ পর মিরার আম্মু সহ সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করলাম। মিরার আম্মু বাসায় চলে গেলেন। আমাদের গ্রামের বাড়িটা ছোট হলে ও তিনটে রুম ছিলো। রান্না ঘর ছিলো আলাদা।
একটু পরই পাশের বাড়ির বড় আপু আসলেন.. আমার ছোটবোনের ব্যাপারে জানতে চাইলেন। লেখাপড়া কতদূর করেছে, এখন কি করবে এইসব। সবশেষে আপু বললেন আমাদের এই গ্রামে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে, যেটার দায়িত্বে ওনি নিজেই রয়েছেন। আমি বললে মিরাকে ওখানে সহকারী শিক্ষকের চাকরী দিতে পারবেন! ইন্টারমিডিয়েট পাশটা ও করা হয়নি ওর। অনেক ভাবলাম, পরে আপু বললেন একটা ভালো পরিবারে ওকে বিয়ে দিতে হলে প্রথমেই শিক্ষা এবং চাকরী-বাকরি এসবের খোজ নেয় আজকাল। বড় আপুর পরামর্শের কিন্ডারগার্টেনে বিশেষ বিবেচনায় আমার ছোটবোন যোগ দেয়। এবার আমাকে ও কিছু একটা করতে হবে। আমি ও গ্রামের পরিচিত গণ্যমান্য কয়েকজনের সাথে কথা বললাম, যারা বাবার খুবই কাছের ছিলেন। তাদের সহায়তায় মিরাদের গ্রামের একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজির.. খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। বেশিদিন স্থায়ী হলাম না এখানে। ঐ চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে, ওই গ্রামেই আরেকটা কিন্ডারগার্টেনে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। প্রায় অনেকেই পরিচিত।
এভাবেই দিনাতিপাত হতে লাগলো। ছোটবোন সকালে রান্না করে দিয়ে যায়, আবার দুপুরে এসে রান্না করে। দুই ভাইবোনের জীবনটা এভাবেই চলতে লাগলো।
এরমাঝে প্রায়ই মিরার সাথে দেখা হতো। টুকটাক কথা হতো। মারুফের দেয়া টাচস্ক্রিন মোবাইল দিয়ে 'Masud R Rahman' নামে একটা ফেইসবুক আইডি খুললাম। নামের মাঝে 'R' এর কোন রহস্য থাকলে ও নেই।
কয়েকমাস কেটে গেলো। প্রায় সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে ওঠলো। ঋতুর পরিবর্তন ঘটলো। শীতকাল চলে এলো। ছোটবোন কে একটা চাদর কিনে দিলাম, সাথে নিজে ও একটা কিনলাম। একদিন ভুল করে.. মোবাইলটা বাসায় রেখেই স্কুলে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে জানতে পারি মিরা নাকি এসেছিলো। অনেকক্ষণ আমার রুমে বসেছিলো। সেদিন রাতে মিরার আম্মুর নাম্বারটা আমি রেখেছিলাম। মোবাইলটা নিয়ে ফোন দিবো, তখনি দেখি মোবাইলের ডাটা অন করা! ফেইসবুকে লগিন করলাম! 'Mira Ma' এই আইডি থেকে আমার রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করা হয়েছে এই মর্মে একটা নোটিফিকেশন পেলাম! আমিতো কাউকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টই পাঠাইনি! তাছাড়া নামটা ও রহস্যজনক! 'Mira Ma' এটা কোন নাম হলো!
আমি মেসেজ বক্স চেক করে দেখলাম বেশ কয়েকটা মেসেজ ওই আইডি থেকে। মেসেজ পরে পরক্ষণেই বুঝলাম এটা মিরার আইডি। বাসায় এসে ও'ই হয়ত আমার আইডি থেকে ওর আইডিতে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে!
মিরার সাথে ফেইসবুকে টুকটাক কথা হতে শুরু করলো। আমি কোনমতেই আমার ভেতরকার অপ্রকাশ্য রক্তাক্ত অনুভূতির কথা ওকে জানতে দিলাম না। প্রায় প্রতিদিনই মিরার সাথে ফেইসবুকে কথা হতে লাগলো। ইতিমধ্যে মিরাদের গ্রামের কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে চাকরীটা ছেড়ে দিয়ে, আমার গ্রামের কিন্ডারগার্টেনে যোগ দিলাম। পাশের বাড়িত বড় আপু এতে বেশ খুশি হলেন!
মিরার সাথে আমার দেখা হওয়ায়াটা প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। আমি অনেকটা শুন্যতা অনুভব করতে লাগলাম। রাতজাগা অভ্যাসটা আবার জেকে বসলো!
কিছুদিন পর.. পাশের বাড়ির বড় আপু, আমার বোনের জন্য একটা বিয়ে আনলো। সব শুনে, আমি বোনের মতামত জানতে চাইলাম। বোনকে অবাক করে দিয়ে জানতে চাইলাম 'তুই কাউকে ভালোবাসিস কিনা'?
বোন সহজ ভাবেই না করলো। হুট করেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেললাম! বন্ধু মারুফের দেয়া টাকাটা এখন কাজে লাগবে। অনেকটা অনাড়ম্বর ভাবেই বিয়ে হয়ে গেল। আমার বোনের ভাগ্যটা বেশ ভালোই বলতে হবে। ছেলে যেমন শিক্ষিত, ব্যবহারেরও বেশ মার্জিত। দেশের বাইরে থাকে। লন্ডনের একটা ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চার হিসেবে আছে! বিয়ের দিন বোন আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব, খুব কেঁদেছিল!
বিয়ের কয়েকমাস পর জানতে পারি বোনকে নিয়ে ওর স্বামী দেশের বাইরে চলে যাবে । আমার বোন আমাকে ছেড়ে, এতো দূরে যেতে কোনমতেই রাজি না। আমি ওকে অনেক বোঝালাম। বোন রাজি হলো। এর ঠিক কয়েকদিন পরেই দেশের বাইরে চলে গেলো। দেশের বাইরে গেলে প্রত্যেকটা মুহূর্তে আমাকে ফোন করে। সকালে, বিকালে, রাতে। খাওয়াদাওয়া করেছি কিনা, স্বাস্থ্য ঠিকাছে কিনা। বেশি রাত যাতে না জাগি। আমার মা আমকে যেভাবে আগলে রাখতো, দেশের বাইরে চলে গেলেও বোন আমার ঠিক সেভাবেই আগলে রাখছে! বাবা-মা'হীন জীবনে এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
ফেইসবুকে লগিন করে দেখলাম মিরার আইডি ডি-এক্টিভেট করা! পরদিন সকালে মিরাদের গ্রামে গেলাম। গিয়ে জানতে পারলাম ওরা দেশের বাইরে চলে গেছে! আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না! বড্ড খারাপ রকমের শুন্যতা অনুভব করতে লাগলাম! মিরার দূরে চলে যাওয়া এবার আমাকে নিদারুণ কষ্ট দিচ্ছে!
( বছর তিনেক পর...)
এই তিন বছরে অনেক কিছুই হয়েছে। আমার ছোটবোনের একটা মেয়ে হয়েছে। যার নাম আমার পছন্দেই রাখা হয়েছে। কাকতালীয় ভাবে ছোট বোনের স্বামীর নাম আর আমার নাম একই ছিলো! 'মাসুদ'!! ছোট বোনের মেয়ের নাম রাখলাম 'মিমশা মাসুদ ইশা' । আমার পছন্দের নাম। আরো একটা আছে, 'মেহরাব মাসুদ নিঝুম'! এ দুটো নাম মিরার পছন্দের! ফেইসবুকে কথা হওয়ার ফাকে একদিন এই নামগুলো আমকে বলেছিলো! কিন্তু, ছোটবোন এই ব্যাপারটা জানেনা!
সেদিনও ছিলো শীতের সকাল। আমি চাঁদর গায়ে হাটতে বেরিয়েছি। গত সপ্তাহে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি। অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষাই করলাম। কিডনি দুটোই প্রায় ডেমেজ হয়ে এসেছে! পাশাপাশি ব্রেইন ক্যান্সার ও ধরা পড়েছে আমার। এই নিয়ে কোন চিন্তাই আমার মধ্যে কাজ করছেনা। হয়তো পৃথিবীতে আমার স্থায়িত্বকাল আর খুব একটা বেশি নেই!
মিরাদের গ্রামের বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম ! চাদর গায়ে একটা মেয়ে দেখলাম আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সম্ভবত মিরাই! আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম!
- কেমন আছো মাসুদ?
- এইতো.. আলহামদুলিল্লাহ্‌ বেশ ভালো আছি। তুমি ভালো আছো?
মিরা আমার এই প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো!
- তোমার এই অবস্থা কেনো? কি হয়েছে তোমার?
- আসলে মিরা....
আমি পুরো কথা শেষ করতে পারলাম না। পরয়ক্ষণেই মিরাকে দেখলাম দু-তিন বছরের একটা বাচ্চার পেছনে ছুটে যেতে! আমি চশমাটা ঠিক করে চোখে দিলাম। আমার কান্না দেখলে মিরা কষ্ট পাবে.. চশমা চোখে দিয়ে অশ্রু ঝড়ালে বাইরে থেকে মিরা দেখতে পাবে না ভেবে চশমাটা চোখে দিয়ে নিলাম। মিরাদের ঘর থেকে মারুফ কে বের হতে দেখলাম! মিরার স্বামী আমার বন্ধু মারুফ! আমি ওখান থেকে বাসায় চলে আসলাম।
সারাটাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে রাত ন'টায় বাসায় গিয়ে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লাম! খুব করে ঘুম আসছে! আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম! ঘুমের মধ্যেই কারো চাপা কান্নার শব্দ পেলাম! কে কাঁদছে? কে?
অনুভূতিরা গুমড়ে কাঁদুক, ভালো থাকুক ভালোবাসারা।

Post a Comment

Previous Post Next Post