গল্পঃ গৃহযুদ্ধ । লেখকঃ Hasibul Islam Fahad। পর্বঃ২

 


গল্পঃ গৃহযুদ্ধ

লেখকঃ Hasibul Islam Fahad

পর্বঃ২

কাল রাতে বাড়িওয়ালা ভাবি আমার স্ত্রীকে অপমান করার পরেও, সকালে আমি ওর রান্না করে রেখে যাওয়া খাবার না খেয়ে সেই ভাবির রেঁধে দেয়া খাবার গো-গ্রাসে খেয়েছি, এটা যদি ও জানতে পারে, তাহলে ঝামেলা হতে পারে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে একটা আয়ডিয়া বের করলাম। টেবিলের উপরে রাখা সুপ্তির খাবারগুলো একটা প্যাকেটে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসলাম। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন একটা খারাপ লাগা কাজ করছিলো। স্ত্রীরা কখনো তার হাজবেন্ড এর জন্য অবহেলা করে রান্না করেনা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কাজে মনোযোগ দিলাম। মণিকা ভাবির খাবারের সাথে দেয়া চিরকুটটা যাতে ওর চোখে না পরে, তাই সেটাকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে দিলাম।
বক্স গুলো যদি দ্রুত ফেরৎ দিয়ে না আসি, তাহলেও তো সমস্যা। সব ক'টি বক্স ধুয়ে একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে মণিকা ভাবির বাসায় গিয়ে কলিংবেল বাজালাম।
ভাবি, বাসার দরজাটা খুলে একটা মিষ্টি হাসি দিলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো!
খেতে কেমন হয়েছে?
জবাবে জানালাম।
-খুবই ভালো ভাবি, ধন্যবাদ।
- ধন্যবাদ দিতে হবেনা। আসো ভেতরে এসে বসো। তোমাকে চা বানিয়ে দিচ্ছি।
- না থাক ভাবি। কিছু কাজ বাকি পড়ে আছে। আমি এখন আসি।
- আরে আমার বাসায় এসেছ, আর চা না খেয়ে চলে যাবে?
এসো বসো। মাত্র পাঁচ মিনিটের ভেতরে চা বানিয়ে আনি।
ভেতরে ঢুকে বসলাম আমি। এসির বাতাসে গা শীতল হয়ে এলো।প্রকৃতি যত নিষ্ঠুর আচরণ ই করুক না কেনো, বিত্তবানদের সমস্যা খুব কম ই হয়।
সোফায় বসলে এখান থেকে ভাবির বারান্দাটা দেখা যায়। বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন। বারান্দাটির চারপাশে দামি দামি অর্কিড এবং ফুল গাছের সমারোহ। একপাশে খাঁচায় রাখা আছে দুটি এলবিনো লাভবার্ডস, সুন্দর মিষ্টি সুরে ওরা গান করছে।
আমি যে বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছি সেটা এতক্ষনে ভাবি খুব ভালোভাবেই খেয়াল করেছে। উনি কখন যে দু হাতে দু কাপ চা নিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তা আমি খেয়াল ই করিনি৷ যখন ছোট্ট করে গলায় খাকরি দিয়ে কাশি দিলেন, তখন আমি একটু চমকে উঠে ওনার দিকে তাকালাম। তিনি মুচকি হেসে আমার দিকে চায়ের একটি কাপ এগিয়ে দিলেন।
জিজ্ঞেস করলেন বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিলে যে?
বললাম, প্রকৃতি আমাকে বেশ টানে। আপনার রুচির প্রশংসা করতে হয়।
উনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আমার একাকিত্বের সঙ্গী এখন এই বারান্দার গাছ আর পাখি গুলোই।
যদি কিছু মনে না করো, তবে চলো, বারান্দায় গিয়েই চা টা শেষ করি। বলে উনি বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও ওনার পিছনে পিছনে অনুসরণ করলাম।ড্রয়িং রুমের সোফা থেকে বারান্দার একটা অংশ দেখা গিয়েছিলো মাত্র। বারান্দায় আসার পরে বুঝতে পারলাম বারান্দাটা আসলে প্রকান্ড। বসার জন্য দুটো চেয়ার রয়েছে। রয়েছে একটা ফাউন্টেইন। লাভবার্ডস এর পাশাপাশি আছে ককাটেল ও। পুরো বারান্দা জুড়ে তাজা ফুলের মিষ্টি সুবাশ। সত্যিই মনটা ভরে গেলো। ওনার সাথে দু একটা কথা বলতে বলতে চা খাওয়া শেষ হয়ে গেলো।
কাপটা ওনার হাতে দিয়ে বললাম, আজ আসি ভাবি।
উনি মিষ্টি করে হেসে আমাকে বললেন,আবার এসো।
আমি দরজা খুলে বের হব, এমন সময় উনি আমাকে পেছন থেকে ডাক দিলেন, ওনার দিকে তাকালাম। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
তোমার বউয়ের রান্নার হাত কিন্তু ভালোনা। বলেই একটা অট্টহাসি দিলেন। আমি কিছু না বলে বাসায় চলে আসলাম।
আমার ফোনটা বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। দেসে দেখলাম সুপ্তি বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো। তাড়াতাড়ি করে কলব্যাক করলাম।ফোন ধরে জিজ্ঞেস করলো কোথায় ছিলাম?
সুপ্তিকে আগে কখনো মিথ্যা বলিনি, তবে আমি যদি বলি যে মণিকা ভাবির বাসায় ছিলাম,তবে জিজ্ঞেস করবে কেনো গিয়েছিলে, খাবারের ব্যপারটা তখন ও জেনে যাবে। তাই ওর কাছে সত্যটা লুকিয়ে বললাম ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।
সুপ্তি বললো - আচ্ছা। আমি একটু টেনশনে পরে গেছিলাম। তুমি সকালে খেয়েছ?
- হ্যাঁ।
- সকালে তাড়াতাড়ি রান্না করে রেখে এসেছি। জানিনা কেমন হয়েছে, তুমি খেতে পেরেছো কিনা।
- খুব ভালো হয়েছে৷ আমি পেট ভরে খেয়েছি।
- যাক বাঁচা গেলো। তুমি দুপুরে একটু এসো আমার অফিসে। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
- আচ্ছা আসব।
বলে ফোনটা রেখে দিলাম। বেচারির কথাবার্তা শুনে মনে হলো, কাল রাতের বিষয় নিয়ে এখনো মন খারাপ।
ভাবলাম ওকে একটা সারপ্রাইজ দিব।
ঘন্টা দুয়েক অনলাইনে কাজ করলাম।
এরপর নিচে গিয়ে কিছু ঘাসফুল, কয়েকটা রজনীগন্ধার কান্ড, কিছু সাদা গোলাপ এবং কিছু মর্নিং গ্লোরি ফুল নিয়ে আসলাম।
বাসায় এনে নিজ হাতে র্যাপিং করে একটা তোড়া বানালাম।
এরপর একটা কাগজ নিয়ে ওর জন্য সুন্দর করে আমার অনুভূতির শিকড় নিংড়ে কবিতার মত কিছু একটা লেখার চেষ্টা করলাম-
" একটা কাচের গ্লাসে,
ব্যস্ততা ঢেলে নেশা করে তোমাকে কতক্ষন ভুলে থাকা যায়?
কর্ম ব্যস্ততা? সে আবার কি?
আমার নিজের মৃত্যুও তো তোমাকে ভুলাতে পারবেনা।
জানো?
আমার অনেক শক্তি আছে অনেক সাহস আছে।
আমি জানি,
আমি চাইলেই এভারেস্ট জয় করতে পারি, হেক্টরকে বধ করতে পারি।
না খেয়ে অনায়াসে দিন পার করতে পারি, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাংগা খাটুনি খাটতে পারি,
বিজলীর সাথে পাঞ্জা ধরতে পারি,
মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারি।
আমি সব পারি। সব।
কিন্তু,আমার দুর্বলতা তো একটাই
আমি যে চাইলেই তোমাকে ভুলে থাকতে পারি না!
তুমি যখন পাশে থাকো মনে হয় পুরো পৃথিবী আমার পাশে আছে।
আর, তুমি যখন থাকোনা, তোমার শূন্যতায় আমি লাশের মত একা হয়ে যাই।"
কবিতার কাগজটা ফুলের তোড়ার ভেতরে গুঁজে আমি সুপ্তির অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম,
নামার সময়ে আবার মণিকা ভাবীর সাথে দেখা।তিনি তার নিজ বাসার দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ফুল নিয়ে কোথায় যাচ্ছি, বললাম, সুপ্তির মন খারাপ, ওকে একটু সারপ্রাইজ দিব আরকি!
ভাবি ওহ আচ্ছা বলে বাসায় ঢুকে গেলেন। দরজা বন্ধ করার আগে বললেন,ওর রান্নার হাত কিন্তু একদম ই ভালোনা।
এবার বিষয়টা আমার মাথায় এসে লাগলো, উনি কি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন! বারবার একই কথা বলার মানে কি!!
ওনার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে সুপ্তির অফিসে চলে আসলাম। ওকে লাঞ্চ টাইমে খাওয়ার জন্য কিছু সময় ছুটি দেয়। ঐ সময়টাতেই আমি এসেছি। ও আমার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলো অফিস ভবনের পাশেই।
ফুলের তোড়াটা এক হাতে নিয়ে আমার পেছনে করে লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে এসেছি।
ওর কাছে আসতেই আমাকে বললো, তোমার হাতে কি লুকানো দেখি? আমি বললাম, চোখ বন্ধ করো, নইলে দেখতে দিবনা।
ও চোখ বন্ধ করলো। আমি হাটু গেড়ে বসে ওর হাতে ফুলের তোড়াটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আমার মিষ্টি বউয়ের জন্য মিষ্টি একটা উপহার নিয়ে এসেছি।
চোখ খুলে ফুলের তোড়া দেখে রিতীমত চমকে উঠে সুপ্তি। এমন ভরদুপুরে এরকম কিছু হয়ত একদম ই আশা করেনি। ও। আমাকে দ্রুত বসা থেকে উঠিয়ে সব লোকজনের মাঝেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, আমার কাছে সবথেকে মিষ্টি উপহার তো তুমি, আল্লাহর পক্ষ থেকে।
ওর কথা শুনে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। সকালে ওকে মণিকা ভাবীকে নিয়ে মিথ্যা বলাটা একদম ই ঠিক হয়নি। ভেতরে ভেতরে বেশ অপরাধবোধ কাজ করছিলো আমার।
দুজনে বাইরেই একসাথে দুপুরের খাবার খেলাম।
এরপর ওকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে আমি চলে আসলাম আমার বাসায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে আবারো সেই মণিকা ভাবীর সাথে দেখা।
আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, তোমার বৌ এর রান্নার হাত কিন্তু ভালো না। বলে দাঁত বের করে একটা হাসি দিলেন।
আমি মনে মনে
ওও খোদা আ আ আ আ আ আ আ বলে বিকট এক চিৎকার মারলাম। দৌড়ে বাসায় ঢুকে গেলাম। এ মহিলার মাথায় সমস্যা আছে নাকি! আমার তো মনে হয় এই একটা কথা উনি আমাকে যতবার দেখবে ততবার ই বলবে।
ওনার এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবো কিভাবে ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
কলিং বেল এর শব্দে ঘুম ভাংল। পাঁচটা ত্রিশ বেজে গেছে। সুপ্তি বাসায় চলে এসেছে।
দরজা খোলা মাত্রই সুপ্তি আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর ব্যাগ থেকে সেই কবিতার কাগজটা বের করে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ব্যাঙ্গ করে পড়া শুরু করলো। আমি ভীষন লজ্জায় পড়ে গেলাম। লজ্জা এড়াতে দরজা আটকে দিয়ে ওকে কোলে তুলে আমাদের বেডরুমে নিয়ে আসলাম। ওর হাত থেকে কাগজটা সরিয়ে নিয়ে বললাম, অনেক কবিতা পড়া হয়েছে। এবার একটু
((" এসব কথা পাঠকদের শোনানো যাবেনা"))
ও গা ঝাপটা মেরে আমার থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিলো! বললো তুমি আসলে দিনে দিনে অসভ্য আর খাটাশ হয়ে গেছো৷ আমি বাইরে থেকে এসেছি, গা ঘামে ভেজা। গোসল করে ফ্রেশ তো হতে দিবে!!
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।
আমিও শিকারি বেড়ালের মত বসে বসে গোঁফে তা দিতে থাকলাম। শুধু একবার ফ্রেশ হয়ে বের হোক!!
.
.
.
সুপ্তি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে ওর যেহেতু অফিসে যেতে হয় তাই ও রাত জাগে না।
আমার ঘুমাতে একটু দেরী হয়। রাত জেগেই আমি অনলাইনে কাজ করি। তবে সেদিন শরীর একটু ক্লান্ত থাকায় বেশি রাত জাগলাম না। ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। খানিক বাদেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়লাম আমি।
রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখছি,
মণিকা ভাবি বারান্দার একটা চেয়ারের উপরে বসা।
আমি ছাদে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি।
মণিকা ভাবি তার মোবাইল থেকে আমাকে মেসেজ দিচ্ছে-
আজ বিকেলে আমার বারান্দায় আসলে না?
তার মেসেজের লেখাটা পুরো আকাশ জুড়ে বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠছে।
আমি আকাশে তাকিয়েই তার মেসেজটি পড়ে নিলাম। আমি রিপ্লাই করলাম,
সময় পাইনি তাই আসতে পারিনি।
আমার লেখাটাও ভেসে উঠলো পুরো আকাশ জুড়েই।
মণিকা ভাবী আবার লিখলেন,
কাল এসো। বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প করবো।
লেখাটা আকাশে ঝলমল ঝলমল করছে।
আমি রিপ্লাই দিলাম- আচ্ছা আসব।
আমার রিপ্লাই দেয়ার সাথে সাথেই দেখলাম সুপ্তি ছাদে চলে এসেছে। ও এসে দৌড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, তারপর আমার বুকের মাঝেই আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেলো।
আচমকা লাফ দিয়ে উঠলাম ঘুম থেকে।
কি ভয়ানক স্বপ্ন। আমি প্রচন্ড ঘামছিলাম।
বসে বসে ভাবতে লাগলাম! এমন স্বপ্ন আমি কেনো দেখেছি! কয়টা বাজে চেক করার জন্য মোবাইল ফোন হাতে নিলাম!
দেখলাম মণিকা ভাবির নম্বর থেকে একটা টেক্সট ম্যাসেজ এসেছে মিনিট পাঁচেক আগেই।
এত রাতে কেন সে আমাকে মেসেজ করলো!!
মনের ভেতর ধুকপুক করতে শুরু করলো! কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজটি ওপেন করলাম আমি।


চলবে...

Post a Comment

Previous Post Next Post