গল্পঃ গৃহযুদ্ধ । লেখকঃ Hasibul Islam Fahad । পর্বঃ৩


গল্পঃ গৃহযুদ্ধ

লেখকঃ Hasibul Islam Fahad

পর্বঃ৩


 মণিকা ভাবির মেসেজ ওপেন করতেই দেখতে পেলাম তিনি লিখেছেন,

" বারান্দায় চা নিয়ে বসে আছি,
হাসনা হেনার মিষ্টি গন্ধ এবং পূর্ণিমা ঢেলে দেয়া চাঁদ আমার ছোট্ট বারান্দাকে একটা অস্থায়ী নন্দনকাননে পরিণত করেছে। লেখালেখির অভ্যেস আমার বেশ আগে থেকেই ছিলো।
কিছু অগোছালো কবিতা পৃষ্ঠার বিছানায় নিরলস শুয়ে আছে। তোমার কন্ঠ বেশ গুরুগম্ভীর। আমাকে কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনাবে? "
মেসেজটা পরে মুখের কোণায় একটা হাসি ফুটলো আমার। মণিকা ভাবীকে যতটা কাঠখোট্টা মনে করেছিলাম ঠিক ততটা তিনি নন। ওনাকে রিপ্লাই করলাম,
সময় পেলে শোনাবো অবশ্যই।
কিছুক্ষন পরে জিজ্ঞেস করলো, তোমার স্ত্রী কি করে! জানালাম, ও ঘুমাচ্ছে।
পরে তার পক্ষ থেকে আর কোন রিপ্লাই আসেনি।
আমিও ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে ঘুম ভাঙলো সুপ্তির ডাকে।
উঠে দেখলাম সুপ্তি চা নিয়ে হাজির। মুখে পানির ঝাপটা মেরে ফ্রেশ হয়ে এসে চায়ে চুমুক দিলাম। কালকে মণিকা ভাবীর হাতের চা খেয়ে সুপ্তির এ চা বেশ পানসে ই মনে হচ্ছে। দু-চুমুক খাওয়ার পর আর খেতে ইচ্ছে করলো না।
সুপ্তি আমাকে চা দিয়েই ঝটপট সকালে কিছু তৈরি করার জন্য কিচেনে চলে গেলো। সকালের নাস্তা হিসেবে পরোটা এবং ভাজি আমাদের দৈনিক রুটিন হয়ে গেছে।
সুপ্তি ওর নিজের জন্য কিছু খাবার একটা বক্সে প্যাক করে বাকিটা আমার জন্য প্লেটে সাজিয়ে রাখে।
অফিসের৷ উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে, ও আমাকে শক্ত করে একটা হাগ দেয়। আমিও ওর কপালে মিষ্টি করে একটা চুমু খাই।
আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। সুপ্তি বের হওয়ার সময় দরজা খোলা রেখে যখন ওকে হাগ দিয়েছি এবং কপালে চুমো খেয়েছি তখন মণিকা ভাবী কোথা থেকে আমাদের দেখে ফেলেছেন তা কে জানে!
সুপ্তি অফিসে যাওয়ার বিশ মিনিট পর আমাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে।
আমি বারবার ওকে জিজ্ঞেস করছি,কি হয়েছে বলো! ও কান্না ই থামাচ্ছে না।
অনেক রিকুয়েষ্ট করার পরে সুপ্তি আমাকে জানালো, মণিকা ভাবি নাকি ওকে ফোন করেছিলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
তো এতে কান্নার কি আছে?
সুপ্তি উত্তর দিলো, মণিকা ভাবী নাকি ওকে নির্লজ্জ বলেছে।মুরুব্বীদের সামনে অসভ্যের মত কাজ করতে যেন আর না দেখে সেটা বলেছে।
বিষয়টা আমার কাছে অনেক খটকা লাগলো, যতদূর জানি মণিকা ভাবী এ ধরণের ভাষা ব্যবহার করার মত মানুষ না। আর এরকম করে বলবেই বা কেনো! কাল রাতেও তো সে কত সুন্দর করে কথা বললো।
তাও বিষয়টা ক্লিয়ার হওয়া দরকার।
দরজা আটকে রেখে মণিকা ভাবীর বাসায় গিয়ে কলিংবেল বাজালাম। দরজা খুললো অল্প বয়সী একটা মেয়ে। বললো, আপনে ভেতরে বহেন, খালামণি একটু পর আসতাছে।
কথা শুনে বোঝা গেলো বাসার টুকটাক কাজ করতেই হয়ত এ মেয়েটিকে রাখা হয়েছে। আমি ভেতরে ঢুকে সোফায় বসলাম।
একটু পর দেখা গেলো মণিকা ভাবিকে।
তিনি কলাপাতা রঙ এর একটা জামদানী শাড়ী পড়েছেন। গলায় চোকার, ঠোঁটে গাঢ় করে খয়েরী রঙ এর লিপস্টিক, সাথে আবার মেকাপ ও করেছেন।
উনাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
কোথাও বের হচ্ছেন বোধ হয় ভাবি। আমি তাহলে একটু পরে আসি।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন!
আরে!
আমি কোথাও বের হবো কেনো! তোমার সাথে কথা বলতেই তো এলাম।
ওনার কথা শুনে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।
ভাবী এমন গেটাপ নিয়েছে মনে হচ্ছে কোন পার্টিতে যাবে। আবার বলে,সে কোথাও বের হচ্ছে না আমার সাথে কথা বলবে। অদ্ভুত ব্যপার।
সে আমাকে বললো,
এখানে বসা কেনো! বারান্দায় চলো।কোন কথা থাকলে ওখানে বসেই বলি।
তার পেছনে পেছনে বারান্দায় গেলাম,
গিয়েই আমার চোখ ছানাবড়া।
আজ চেয়ার দুটোর সামনে একটা টেবিল পাতা হয়েছে। সেখানে রাখা আছে
কোরমা - পোলাও, গরুর রেজালা, মুরগীর রোস্ট, সালাদ, মিষ্টি, দধি, পায়েস,সরষে ইলিশ, এত এত আইটেম যে কোনটা রেখে কোনটার নাম বলবো সেটাই খুঁজে পাচ্ছিনা।
আমাকে বললো, তোমার জন্য ছোটখাটো একটা আয়োজন করলাম। তোমার বউ এর রান্নার হাত তো ভালোনা। কি সব হাবিজাবি খেয়ে দিন পার করছো!
বসো। আগে খাওয়াদাওয়া করো, তারপর কথা হবে।
বললাম, ভাবি আমার দেখেই পেট ভরে গেছে। এতকিছু কেন করতে গেলেন!
- আরে এতকিছু কোথায়! সামান্য কিছু করলাম একদম নিজ হাতে। খেতে বসো দেখবে নিমিষে শেষ হয়ে যাবে।
খাবারগুলো থেকে এত্ত সুন্দর স্মেল বের হচ্ছিলো! তাও সবকিছু উপেক্ষা করে বললাম ভাবি আরেকদিন খাবো।আজ একটা কাজে এসেছিলাম। উনি কপট রাগ দেখিয়ে বললো, আমি কত আশা নিয়ে বানিয়েছি, তুমি না খেলে সত্যি বললাম আমিও কিন্তু না খেয়েই থাকব। ওনার মন রাখতে খেতে বসলাম।
এতকিছুর মাঝে কোনটা রেখে কোনটা খাই!!এ বিড়ম্বনা থেকে বাঁচলাম
মণিকা ভাবি আমাকে প্লেট এগিয়ে খাবার তুলে দেয়ায়।
খাবারের স্বাদের কথা আর কি বলবো! যাস্ট অতুলনীয়। এত ভালো খাবার আমি কোন হোটেলেও খাইনি। এত্তগুলো খাবার কথায় কথায় কখন যে শেষ করে ফেললাম! স্বাদ ভালো হলে যা হয় আরকি।খাওয়া শেষে পেটটা ছোট খাট একটা গামলার মত মনে হচ্ছিলো।
মণিকা ভাবির চোখেও এক ধরণের সন্তুষ্টি দেখতে পেলাম।
খাওয়া শেষে ছোট মেয়েটা এসে টেবিল পরিষ্কার করে চলে গেলো।
একটু পর আসলো ড্রাগন টি।
ভারী খাবারের পরে ড্রাগণ টি খাওয়া নাকি শরীরের জন্য ভালো।
চায়ে চুমুক দিতে দিতেই উনি জিজ্ঞেস করলো! তারপর কি বলবে বলো!!
উনি এত আপ্যায়ন করলেন! এখন যদি জিজ্ঞেস করি আপনি আমার বউকে অসভ্য বলেছেন! সেটা একদম ই বেখাপ্পা দেখায়। তাই ওনাকে বললাম, আপনি আমার ওয়াইফ কে কল দিয়েছিলেন? উনি জানালেন, যে হ্যাঁ।
- আমাদের কোন কাজ কি আপনার কাছে অপছন্দ লেগেছে!
- না। তবে তোমার ওয়াইফ কেমন যেন, আমাকে দেখে সালাম তো দেয়নি বং সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ে গায়ে ধাক্কা দিয়েছে। বিষয়টা আমার খারাপ লেগেছে। তাই ওকে ফোন করে জানিয়েছি।
আমি বললাম, ওহ আচ্ছা। তবে একটা প্রশ্ন!
আপনি জানতেন যে আমি আপনার বাসায় আসব?
- উনি বললেন না। এসেছ ভালোই হয়েছে। নইলে তোমাকে ডাকতে আমার বাসার মেয়েটাকে পাঠাতাম একটু পরে।
এরপর উনি আমার দিকে ওনার একটা ডায়েরি এগিয়ে দিলেন। বললেন ওটা যাতে আমি বাসায় নিয়ে যাই। এটাও বলে দিলেন, আমি যাতে এখন না খুলি ডায়েরিটা। আমি আচ্ছা বলে সেদিনের মত ওনার বারান্দা থেকে বিদায় নিলাম।
বাসায় এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
এত খাওয়াদাওয়া করেছি! একদম ঘুম চলে এসেছে। পেট নিয়ে নড়া কষ্টকর হয়ে গেছে আমার।
ডায়েরি টা বিছানার পাশে রেখে দিলাম এক ঘুম।
লম্বা একটা ঘুম হলো।
ঘুম যখন ভাংলো, তখন ঘড়িতে তিনটা বাজে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম দুটা থেকে আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে সুপ্তি।
সাথে সাথে ব্যাক করলাম।
সুপ্তি জিজ্ঞেস করলো! কি করছিলে!
আমি ওকে বললাম ঘুমাচ্ছিলাম।
ও বললো, ওহ আচ্ছা।
জিজ্ঞেস করলাম
-লাঞ্চ করেছে?
- সরি সোনা, রাগ করোনা।
কলিগ জোড় করায় একটা সিংগারা খেয়ে ফেলেছি। তোমাকে ছাড়া খেতে ইচ্ছে করেনি। তুমি তো একেবারেই কিছু না খেয়ে আছ তাইনা?
- হু,
- আচ্ছা একটু ওয়েট করো অফিস ছুটি হওয়ার পর একসাথে খাব।
- আচ্ছা, রাখছি তবে।
বলে ফোন রেখে দিলাম। আমার ভেতরটা অনুশোচনায় জ্বলে যাচ্ছিলো।সুপ্তি মেয়েটা আমাকে না জানিয়ে মনে হয় এক কাপ চা-ও খায়না।সারাদিন ও বসে বসে অফিসে কাজ করে আর আমি এদিকে পেটপুরে খেয়ে আরাম আয়েশ করছি! এটা কেমন ভালোবাসা হলো!
মণিকা ভাবীর ডায়েরিটা বিছানার তোষকের নিচে রেখে দিলাম।
জামাকাপড় পরে রেডি হলাম। ঠিক করল আজ ওকে ছুটির পরে ভালো কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাব।
পাঁচটায় ওর অফিস ছুটি হলো।বাসায় না ফিরে সোজা চলে গেলাম রবীন্দ্র সরোবরে। সেখানে গিয়ে ওর পছন্দের ফুসকা খেলাম একসাথে।
এরপর দুজনে পাল্লা দিয়ে বেলুন ফাটালাম, বন্দুক দিয়ে। কে কতটা ফাটাতে পারে, আমার থেকে ও বেশি পারলো।জিতে যাওয়ার আনন্দে যে হাসি দেখলাম ওর মুখে মনে হল এ হাসি দেখেই আমি চিরকাল কাটিয়ে দিতে পারবো।
এরপর দুজনে একটা প্যাডেল বোট নিলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার এবং লেকের পানির বুক চিড়ে আমাদের বোট একদম মাঝে চলে গেল। চারপাশটা অদ্ভুত নিরব। সুপ্তি আমার কাঁধে মাথা দিয়ে আছে। বোট টা ঢেউয়ের তালে তালে অল্প অল্প দুলছে। দুজনের কারো মুখে কোনো কথা নেই।
নীরবতারা আমাদের হয়ে গল্প করছে।হুট করেই এ নিস্তব্ধ নিরবতা ভেংগে দিলো মোবাইলের রিংটোন। আওয়াজ করে বেজে উঠলো। ফোন বের করে দেখলাম মণিকা ভাবির নাম্বার থেকে কল এসেছে। দ্রুত কেটে দিলাম। সেভ করা নেই দেখে সুপ্তি বুঝতে পারেনি।
কে কল দিয়েছে জিজ্ঞেস ও করেনি৷ সুপ্তি আমার কাঁধে মাথা রেখে পরিবেশটা উপভোগ করছিল। খানিক বাদে আবার ও মণিকা ভাবির কল। এবার কেটে দিয়ে ভাইব্রেশন করে রাখলাম৷ এরপরেও বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে সে। ভাইব্রেশন এর সেন্সটিভিটি কম থাকায় আমি টের পেয়েছি শুধু৷ কয়েকবার কল দেয়ার পর ধরছি না দেখে শুরু হলো এস এম এস। বেশ কয়েকবার এস এম এস এসেছে আমার ফোনে।
আরো কিছুক্ষন বোটে ভাসার ইচ্ছে ছিলো। ইচ্ছেটা মাটিচাপা দিয়ে দ্রুত প্যাডেল মেরে চলে আসলাম। বোট ছেড়ে উঠে একটা খোলা রেস্তোরায় বসে বিফ চাপের অর্ডার দিলাম।
সুপ্তি আর আমি মুখোমুখি চেয়ারর বসা। ফোনটা টেবিলের নিচে নিয়ে আমি ভাবির এস এম এস এমম ভাবে ওপেন করি যেন সুপ্তি না দেখে।
তার মেসেজগুলো ছিলো এমন,
" ফোন ধরছোনা কেনো! কোন সমস্যা হয়েছে?"
" তুমি কি আমার ডায়েরীটা পড়োনি রোহান?"
" আমার জন্য কি তোমার একটুও সময় নেই? "
চলবে..

Post a Comment

Previous Post Next Post