গল্পঃ মায়ের অভাবলেখকঃ বিবেকানন্দ দাস।
মা বড় ভাইয়ের বাসায় গেছেন,আমার কি যে ভালো লাগছে,কয়টা দিন প্যাড়া আর বিরক্তি থেকে রেহাই মিলবে।
বার বার বলে গেছেন রান্না তো পারিস না,হোটেলে সময় মতো গিয়ে খেয়ে নিস।আমার সাথে যেতে তো রাজি নয়,আমি বেশিদিন থাকবো না,নিজের যত্ন নিস,ঘুমানোর আগে মশারি টানাই নিস।সবাই বলতেছে,এলাকায় ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বাড়ছে। আর কোনো সমস্যা হলে ফোন দিস আমায়।
নানাভাবে বিরক্ত করেন তিনি আমাকে,সে কারনে তিনি যাওয়ায় আমি খুশি।এইতো সেদিন প্রাইভেটে যাবো,ধেরী হয়ে যাচ্ছে, তিনি বলছেন চা'টা অন্তত খেয়ে যেতে,জোরাজুরিতে টেবিলে বসলাম।কিন্তু পাঁচ মিনিট হয়ে গেলো চা'য়ের খবর নেই।মা'কে ডাক দিয়ে বললাম
--আজকের সারাদিন লাগিয়ে দিবে নাকি?
--আগুন জ্বালাতে পারছি নারে,একটু দাঁড়া।
আরো পাঁচ মিনিট পর ব্যাপার কি দেখতে রান্না ঘরে গেলাম,গিয়ে দেখি পুরো ঘর ধোঁয়াময়,আর চুলোয় মা আগুন তোলার চেষ্টা করছেন চোঙে ফুঁ দিয়ে।আমি বললাম
--এতো ফালতু কাজকর্ম করো কেন?গ্যাসের চুলো রেখে মাটির চুলোয় চা রান্না করতেছো কেন?
--একটু গ্যাস বাঁচবে বাবা।
--আমার হাতে ওতো সময় নাই,তোমার চা তুমি খেও।
--দাঁড়া বাবা,সকাল বেলা খালিমুখে কোথাও যেতে নেই।
আমি বেরিয়ে পড়েছি,মা আমার পিছু পিছু এসে জোর করে দু-খানা টোস্ট বিস্কুট হাতে ধরিয়ে দিয়ে,ওনার সামনে খেতে বলেন।বিরক্ত লাগলেও খেয়ে প্রাইভেটে চলে গেলাম।
আমার রুমে আসলেই মা'য়ের চুলকানি শুরু হয়,আলনায় কাপড়ের এই অবস্থা কেন?বিছানাটা নিজে গোছাই না কেন?বিরক্ত লাগে, অনেকসময় বাজে কথা বলি,অনেকসময় বলি না।তিনি আলনায় কাপড়গুলো সুন্দর করে রেখে,বিছানা গুছিয়ে চলে যান।
এইতো ৭/৮দিন আগে এক রাত্রে হঠাৎ ডাক দিয়ে বলেন দরজা খুলতে,আমি খুললাম।
খুলে দেখি ওনার হাতে মশারী।বললাম
-- ব্যাপার কি?এতো রাত্রে মশারী দিয়ে আমি কি করবো?তুমি তো জানোই প্রতিদিন মশারি টানানো আবার সকালে গোছানো আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে।
--রতনের বাড়ির দুজনের ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে মশার কামড়ে।তোর ঘরেও তো ডেঙ্গু মশা আসতে পারে।
--ওসব ফালতু কথাবার্তা বলো নাতো,তুমি যাও।
মা আর কিছু বললেন না, চুপচাপ মশারি টানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন।এরপরের দিনগুলোতেও তিনি মশারি টানাই দিতেন,কারন তিনি জানেন আমি অগোছালো,অলস।মরে গেলেও মশারি টানাবো না।
ওনি ভাইয়ের বাসায় চলে যাওয়ার তিনদিনের মাথায় গ্রামের এক চাচি আসেন আমাদের বাড়ি,অন্যরুমে সাড়াশব্দ না পেয়ে আমার রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন
--তোর মা কইরে?কোথাও দেখি না!
আমি খুশিমনে বললাম
--সিলেটে গেছে,ভাইয়ের বাসায়।
--ওহ,তাইতো বলি ঘরের এই অবস্থা কেন!এই ঘরে গরু থাকে না মানুষ থাকে পরিবেশ দেখে যাচাই করা মুশকিল।
আমি কথা বাড়ালাম না,তিনি চলে গেলেন,আসলেই তো আমার ঘর আর গরুর ঘরের মধ্যে পার্থক্য নেই।মনে মনে ভাবলাম,যদি মা বাড়িতে থাকতেন, তাহলে তিনি সবকিছু গোছাই রাখতেন,আর আমাকেও এতো অপমান হতে হতো না।
আরেকদিন সকালে চা খেতে ভীষন হচ্ছে হলো,ওদিকে বাজারে যেতেও ইচ্ছে করছে না।যেহেতু চা বানাতে জানি সেহেতু নিজের ঘরেই বানানো যায়।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি গ্যাসের চুলোয় গ্যাস নেই,মাটির চুলোয় চা বানাতে হবে।
অনেক কষ্ট করেও আগুন জ্বালাতে পারলাম না,শেষমেশ চুলোয় কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালালাম,কিন্তু পানি গরম হওয়ার আগে আগুন নিভে গেলো,চোঙ দিয়ে ফুঁ দিয়ে অনেক চেষ্টা করলাম পুনরায় আগুন তোলার,কিন্ত এর বিপরীতে চুলোর ভেতরের ছাঁই উড়তে লাগলো।বুঝলাম ফুঁ দেয়া হচ্ছে না।ব্যর্থ হয়ে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
মনে মনে ভাবলাম,মা বাড়িতে থাকলে বলার সাথে সাথেই চা-বিস্কুট পেয়ে যেতাম।
আরেকদিন সকালে উঠে দেখি আমার শরীর গরম।হাত পাঁয়ে জোর শক্তি পাচ্ছি না।ওসব হতেই পারে,ঘুম থেকে উঠার পর এমন হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু বিকেলের দিকে জ্বরটা বেড়ে গেলো,সাথে সর্দি।ঠান্ডাও লাগছে।
সন্ধ্যার একটু আগে পাশের বাড়ির চাচি এসে হলুদ গুঁড়ো চাইলেন,বললাম
--রান্না ঘর থেকে নিয়ে নেন।
তিনি রান্না ঘর থেকে হলুদ গুঁড়ো নিয়ে ঘরের পরিবেশের উপহাস করে চলে গেলেন।
একবারও জানতে চাইলেন না গ্রীষ্মের দিনে আমি কম্বল গাঁয় জড়িয়ে শুয়ে আছি কেন?কেন বা এমন স্বরে কথা বলছি।আমার মা হলে গলার স্বর শুনলেই বুঝতে পারতেনই আমি অসুস্থ।
হঠাৎ মাথায় এলো গত রাত্রে অন্যসব রাত্রের মতোই মশারি টানিয়ে ঘুমাইনি।ভয় পেয়ে গেলাম,আমারে ডেঙ্গু মশা কামড়ায় নি তো!
মা'কে ফোন দিয়ে ঘটনাটা বললাম।এক ঘন্টার মধ্যে তিনি শহর থেকে বাড়িতে হাজির,তাও একা নয়,সাথে নিয়ে এসেছেন ডাক্তার,ওনাকে চিনি,আমাদের বাজারে ওনার চেম্বার।ভাইয়া আসেননি দেখে একটু খারাপ লাগছিল।
আমার অগোছালো স্বভাবের জন্যে খুব বকছেন মা,কিন্তু আমার আজ আর কোনো বিরক্ত লাগছে না,ভালোই লাগছে।
ডাক্তার আমাকে ভালো করে দেখে ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন।মা আমায় ওষুধ খাইয়ে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন।
আমি শুনেছি অতিরুক্ত জ্বর হলে মানুষ নকি আবোল-তাবোল কথা বলে।আজ আমাকে আবোল-তাবোল কথা বলার অভিনয় করতে হবে।আজ আমাকে আবোল-তাবোল কথা বলতেই হবে।উঠার শক্তি পাচ্ছি না তারপরেও অনেক কষ্টে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
--আমার উপর তোমার অনেক রাগ তাই না মা?আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি,গুরুত্ব দেই না।
--দুর পাগল,কি বলিস ওসব! তুই আমার ছেলে,ছেলের উপর কি মায়ের রাগ থাকে?
আমি কিছু বললাম না,হাতে জোর শক্তি কম তারপরেও যথাসাধ্য শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলাম।এতে করে শরীরের বাহিরের অংশ শীতল না হলেও ভেতরে শীতলতা বয়ে যাচ্ছে।মা বললেন
--ছাড় আমায়, তোর জন্যে কিছু রান্না করি।
--না মা আমি কিছু খাবো না,খেতে ইচ্ছে করছে না।আমি তোমাকে এভাবেই জড়িয়ে ধরে থাকি,আর কিছুই লাগবে না।
মা আমাকে আস্তে আস্তে শুইয়ে দিয়ে বললেন
--পাগলামি করিস না,তুই চুপচাপ শুয়ে থাক,আমি তোর জন্যে তোর প্রিয় নুডুলস বানাবো।ঘর-দোরও পরিষ্কার করতে হবে।
--না মা,ঘরদোর তুমি পরিষ্কার করতে যেওনা, সুস্থ হয়ে আমিই পরিষ্কার করবো।
--তোর মুখে এমন কথা শুনে জীবন স্বার্থক,এতোদিন তো এভাবে থাকতে দেয়া যায় না। জ্বর হওয়ায় এমন বলতেছিস,সুস্থ হলেই তো এসব ভুলে যাবি।
আমি লজ্জা পেলাম,কিছু বললাম না,কিন্তু এটা নিশ্চিত আমি আবোল-তাবোল বলছি না।সজ্ঞানে কথা বলছি।
ডাক্তার বলে গেছেন ডেঙ্গুর লক্ষণ নেই,সাধারন সর্দি-জ্বর।দু-তিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবো।
আমি মনে মনে স্থির করলাম দু-তিন দিনের মধ্যে সুস্থ হওয়ার পর ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করবো,ওনাকে গুরুত্ব দিবো,ওনার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবো।জানিনা সুস্থ হলে এই মন মানসিকতা থাকবে কি? না!
ট্যাগ-
বাংলা ছোট গল্প
অনু গল্প বাংলা
বাংলা শিক্ষামূলক গল্প
বাংলা গল্প
Post a Comment