রম্য গল্পঃ পিওর লাভ । লেখাঃ Maruf Al amin


গল্পঃ পিওর লাভ
লেখাঃ Maruf Al amin

এই আধুনিক  যুগে একটা কবুতর চিঠি নিয়ে আসবে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। জারিফেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। সে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। গোধুলীর সোনালী আলোয় জারিফের মুখটাও ঈষৎ লাল দেখাচ্ছে। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। সে থাকে পুরান ঢাকায়। নিরুপমার বাসা সেই উত্তরা। কোন কবুতর যদি সত্যিই চিঠি নিয়ে রওনা দেয়, পথ ভুল করবে নিশ্চিত।  সে এই বাড়িতে আছে ছাব্বিশ বছর। শুকনো সবজি খাওয়ার পর সে নিজেই মাঝে মাঝে বাড়ি খুঁজে পায় না। গুগল ম্যাপ দেখেও যেখানে পুরান ঢাকার এড্রেস বের করা যায় না, সেখানে মাত্র দুই-তিনের ট্রেনিংয়ে একটা কবুতর ঘ্রাণ আর বাতাসের গতি বিচার করে ঠিকানা বের করে ফেলবে- এটা বিশ্বাস না হওয়ারই কথা।

তবু জারিফ তাকিয়ে থাকে। আকাশ থেকে দৃষ্টি সরায় না সে। সে কবুতরের জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

নিরুপমা ইচ্ছা করেই এই কাজটা করছে। বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। ছোট থেকে ছোট তর্কগুলো শেষ হচ্ছে বড়সড় ঝগড়ায়। নিরুপমার ধারণা – জারিফ তাকে ভুল বুঝতে শুরু করেছে। সেই ভুল ভাঙানোর জন্য আজ সে বিশেষ চিঠি পাঠাচ্ছে বিশেষ মাধ্যমে। অনেক কষ্ট করে সে ট্রেইনিং প্রাপ্ত অভিজ্ঞ একটা কবুতর জোগাড় করেছে। যেই কবুতর তার মনের কথাগুলো নিয়ে উড়ে চলে যাবে তার মনের মানুষের কাছে।

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সত্যি সত্যিই একটা কবুতর উড়ে এসে ঠিক জারিফের সামনে বসলো। জারিফ প্রবল বিস্ময় নিয়ে দেখতে পেল কবুতরের পায়ে এক টুকরো কাগজ বাঁধা আছে। কাগজের ভাঁজ খোলার পর দেখা গেল সেটি বড় একটা চিঠি। রঙিন কাগজে লেখা চিঠিটা দ্রুত পড়তে শুরু করলো জারিফ।

“আমার জানবাচ্চাটা,

জানি রাগ করে আছো। এত দূর থেকে কিভাবে তোমার রাগ ভাঙাবো বলো। আগে তো মেসেঞ্জারে আমার ছবি পাঠালেই তোমার রাগ কমে যেতো। কিন্তু এখন তো তোমার ডিমান্ড বেড়ে গেছে। নরমাল ছবি দিলে হয় না। সব সময় কি আর টি-শার্ট পরে ছবি তোলা যায় বলো।

যাইহোক শোন, তুমি মিছেমিছি আমার সাথে রাগ করে আছো। আমার কারো সাথেই রিলেশনশিপ নেই। নাহ্ মানে তুমি ছাড়া আর কারো সাথেই রিলেশনশিপ নেই আমার। তুমি শুরুতে টগরকে সন্দেহ করতে। কিন্তু তোমাকে তো বলেছি ও আমার আপন ভাই। প্রথম দিন মুখ ফসকে কাজিন বলে ফেলেছিলাম। এরপর তুমি রিন্টুর সাথে আমাকে এক রিকশায় দেখে রাগ করলে। বিশেষ ছবি পাঠানোর পরও তোমার রাগ কমলো না। পরদিন সত্যটা জানার পর ঠিকই তোমার রাগ কমে গেল। রিন্টু আমার বয়ফ্রেন্ড না। রিন্টুও আমার আপন ভাই। এতদিন বিদেশ ছিলো বলে তুমি দেখো নাই। আমার দুই ভাই। প্রথমে যে বলেছিলাম আমার কোন ভাই-বোন নেই সেটা প্রাঙ্ক ছিলো। আর তুমি এত বোকা – আমি মজা করে কিছু বললেও বিশ্বাস করে ফেলো। 

আর শাফিনের সাথে আজ দেখেছো তুমি আমাকে। তুমি কি ভেবেছো? আমি তোমাকে মিথ্যা বলবো? বলবো যে শাফিনও আমার আপন ভাই? নাহ্, তোমার সাথে আমি কখনোই মিথ্যা বলি নাই,  আর বলবোও না। শোন, শাফিন আমার আপন ভাই না। ও আমার সৎ ভাই। বাপ এক আমাদের, মা দুজনের আলাদা। 

এখন তুমিই বলো। সৎ ভাইয়ের সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া কি অন্যায়? সৎ ভাইয়ের সাথে ঘুরাঘুরি করা কি পাপ? সৎ ভাইয়ের কাধে কি বোন মাথা রাখতে পারে না? তোমার বিবেকের কাছে প্রশ্ন রইলো। 

তুমি আমাকে এত খারাপ মেয়ে কেন ভাবো বলো তো! কী এমন করেছি আমি। রিলেশনের শুরু থেকেই শুধু তোমাকেই ভালোবেসে গেছি। বিকেল, সন্ধ্যা, আগ রাত, মাঝ রাত, শেষ রাত কোন সময়ে তোমাকে ভালোবাসা দেইনি বলো তো।

এতকিছুর পরও তুমি আমাকে সন্দেহ করো। গত পরশু তুমি আমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত চেয়েছো। এটা শোনার আগে আমার মরণ হলো না কেন? আমি কী এমন করি ফেসবুকে! রাত জেগে দশ-বারোটা ছেলের সাথে চ্যাট করলেই কি খারাপ মেয়ে হয়ে যায়? আমি যদি বন্ধু ভেবে কারো সাথে চ্যাট করি তাহলেই কি আমি খারাপ মেয়ে হয়ে যাব?                   তোমার বিবেকের কাছে প্রশ্ন রইলো(২)।

তাছাড়া এমন তো না যে আমি যার সাথে চ্যাট করি তার সাথেই ভিডিও কলে কথা বলি। রোজ মাত্র তিন-চার জনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলি- এটাও তোমার সহ্য হয় না? এত ছোট মন কেন তোমার। তুমি যখন কাজের বুয়ার সাথে ধরা খেলে- আমি কি তোমাকে খারাপ বলেছি? কোন গালি দিয়েছি তোমাকে?

জুতা দিয়ে মাত্র তিনটা বাড়ি দিয়ে তোমাকে ক্ষমা করে দেইনি বলো? তাহলে আমার বেলায় এত পসেসিভ কেন তুমি? ভিডিও কলে কথা বললেই কি খারাপ মেয়ে হয়ে যায়?

তোমার বিবেকের কাছে প্রশ্ন রইলো(৩)।

আর হ্যাঁ, যাদের সাথে কথা বলি আমি কি সবার সাথেই দেখা করি? এই সপ্তাহে মাত্র তিনটা ছেলের সাথে দেখা করেছি। তাও আবার পাবলিক রেস্টুরেন্টে। যেখানে সামান্য কিসও করা যায় না। তবু তুমি আমাকে সন্দেহ করো?

আচ্ছা ভালোবাসা কি এত সস্তা বলো তো? রাত জেগে কারো সাথে ভিডিও কলে কথা বললে, রেস্টুরেন্টে দেখা করলে, রিকশার হুড তুলে দিয়ে হাত ধরে পাশাপাশি বসলে, এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজলেই কি খারাপ হয়ে যায় মানুষ? ভালোবাসার মূল্য  কি এত কম বলো তো! ভালোবাসার কী বোঝো তুমি? ভালোবাসা হলো মনের ব্যাপার। পবিত্র । আত্মার বন্ধন।  এই সহজ ব্যাপারটা তুমি কেন বোঝ না।

আমি মন দিয়ে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। অন্যদেরও ভালোবাসি। তবে সেটা মানুষ হিসেবে। একজন মানুষ কি অন্য একজন মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না?

আচ্ছা, অন্য কোন ছেলের সাথে ডেটে গেলেও আমি যে তোমার ফোন রিসিভ করি, এতেই কি প্রমাণ হয় না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি? 

তোমার বিবেকের কাছে…. না থাক আজ আর কোন প্রশ্ন করবো না জান বাচ্চা।

আমার দুঃখ একটাই তোমাকে এত ভালোবাসার পরও আমি তোমার মন পেলাম না। তুমি অন্য মানুষের কথা বিশ্বাস করো। অথচ আমার কোন কথাই তোমার বিশ্বাস হয় না। সবার ধারণা- তোমার টাকা পয়সা আছে এজন্য আমি তোমাকে ভালোবাসি। আসলে কিন্তু তা না। তোমাকে ভালোবাসি তার কারণ একটাই- তোমাদের বিশাল বাড়িটা। নাহ্ মানে, যেই বাড়িতে তোমার শৈশব কেটেছে, সেই বাড়িতে আমিও থাকবো এটা আমার বহুদিনের শখ। আগের মতো এক রাত, দুই রাত থাকার কথা বলছি না কিন্তু। তোমাকে বিয়ে করে সারাজীবন থাকতে চাই।

চিঠি লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আজ আর লিখবো না। শোন, তুমি আবার ভেবে বসো না যে- কবুতর দিয়ে চিঠি আমি সব বড়লোকের ছেলেকেই পাঠাই। এই স্পেশাল চিঠি শুধুই তোমার জন্য। 

চিঠি পড়া শেষ হলেই সুন্দর করে একটা জবাব লিখে পাঠিয়ে দাও। এখনই লিখে পাঠাও। কবুতর না আসা পর্যন্ত আমি ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকবো। তোমার চিঠির আশায়। আদর নিও।

ইতি তোমার 

পিওর লাভ। 

চিঠির নিচে লাভ সাইন দেয়া। 

তার ভেতর বড় বড় করে লেখা – (নিরুপমা+ ফারদিন)

পরে সেই ফারদিন কেটে, জারিফ লেখা হয়েছে।

#পরিশিষ্টঃ রাত এগারোটার পর জারিফ বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। তার দুচোখ বেয়ে তখনো পানি ঝরছে। নতুন বুয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবকিছুই সুন্দর। তবে তার রান্নাটা একদম বাজে। কবুতরের মাংসে কেউ কি এত ঝাল দেয়? ঝালে জারিফের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। ( সমাপ্ত) 


Post a Comment

Previous Post Next Post