গল্পঃ এ উইজার্ড ,পর্ব -৪। লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।

গল্পঃ এ উইজার্ড
পর্ব -৪
লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।

_____________
রাতুল চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে, আসোলেই কি এমনটা সম্ভব!! মৃত মানুষকে জীবিত রাখা যায়!!
তিং মাং কথাটার উত্তর না দিয়ে অনেক্ষন কি নিয়ে যেন চিন্তা করে। তারপর রাতুল ও আয়েশা কে শয়তানের পূজা এবং বলি দেয়ার প্রথার ব্যাপারে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। সব শেষে ওরা তিনজন অনেক্ষন আলোচনা ও চিন্তা করে একটা বাস্তব সত্য উদঘাটন করে।তা হলো," বলি দেয়ার প্রথা কিংবা শয়তানের পূজো ছিলো নিছক একটা লোক দেখানো ঘটনা বা নাটক।"
বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা হচ্ছে লকেটের ভিতর ; কিন্তু লকেট চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সর্দার বলি প্রথা চালু করে লকেটের ব্যাপারটা আড়ালে নিয়ে যায় ও লুসাই গোত্রের লোকজনদেরকে বোকা বানায়। যাতে কেউ আসল রহস্য বুঝতে না পারে, এবং লকেটটাও কোন ঝুঁকি ছাড়াই নিরাপদে সর্দারের কাছেই থাকে।
" দ্যা ওল্ড ম্যান ওয়াজ সাচ এ ডেভিল" শায়লা ঘৃণাভাজন কন্ঠে বলে উঠে।
সামনে পড়ো তিং মাং, লকেটটা সম্পর্কে আর কি কি লেখা আছে, উদ্বিগ্ন কন্ঠে রাতুল তিং মাং কে আদেশ দেয়।
তিং মাং চামড়ার উপর খোদাই করা লেখাগুলো আবার পড়া শুরু করে,
ওদের ভাষায় যা লেখা ছিল, সেটার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এমন:
" লকেটটার শুধু মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতাই নেই, আছে বয়স আটকে রাখার ক্ষমতাও। কেউ যদি ২৫ বছর বয়সে লকেট পরিহিত অবস্থায় কোন কারণে মারা যায়, তবে সে লকেটের প্রভাবে কিছুক্ষনের মধ্যেই জীবিত হয়ে উঠবে এবং তার বয়স বাকি জীবন ২৫ এই আটকে থাকবে। লকেট খোলার সাথে সাথেই সে মারা যাবে এবং তার দেহ প্রকৃত বয়সের অবস্থায় ফিরে যাবে।
এজন্যই লুসাইদের সর্দার মারা যাওয়ার পর তার চুল; দাঁত সবকিছু পরে গিয়েছিল চামড়া হাড়ের সাথে লেগে গিয়ে মানব কংকালের মত দেখাচ্ছিল। উপস্থিত পুলিশ এবং উমর লাশটা দেখে খুবই অবাক হয়েছিলেন সেদিন। একটা মানুষ এতটা বৃদ্ধ হয়েও কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে!!
আবারও নথি পড়া শুরু করে তিং মাং,
লকেট পড়া অবস্থায় কেউ যদি মারা যায়, এবং তার দেহ সম্পূর্ন রূপে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে কয়েকঘন্টা পর দেহ থেকে তার আত্মাটা বের হয়ে আসবে, তারপর কেউ মারা গিয়েছে এমন একটা অক্ষত দেহে ঐ আত্মা প্রবেশ করতে পারবে, তবে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার ভিতর, আগের দেহ থেকে লকেকটা সংগ্রহ করতে হবে; না করতে পারলে তার আত্মা ২৪ ঘন্টা পরে এ পৃথিবী ত্যাগ করে অপর পাশে মৃত লোকদের পৃথিবীতে পাড়ি জমাবে।
ব্যাপারটা অনেকটা এমন;
ধরা যাক লকেট পরিহিত অবস্থায় কেউ একজন ট্রেনের নিচে কাটা পরে মারা গেল এবং তার দেহ মাঝখান থেকে দু টুকরো হয়ে গেল; কিছুক্ষন পর তার আত্মা ঐ অকেজো দেহ থেকে বেরিয়ে আসবে এবং মৃত কোন অক্ষত লাশের সন্ধান করতে থাকবে। পেয়ে যাওয়া মাত্রই ঐ লাশের ভিতরে আত্মাটা ঢুকে পরবে ; তবে ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আগের ক্ষতবিক্ষত লাশ থেকে লকেট টি নিয়ে নিজের গলায় ঝুলাতে হবে। অন্যথায় একদম স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মৃত্যুর পর আত্মা যেমন ওপারে চলে যায়, তেমন ভাবেই চলে যাবে।
এতটুকু ছিলো নথিতে লকেট নিয়ে লেখা মূল অংশ। বাকি গুলোয় লুসাইদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস নিয়ে লেখা ছিল।
লুসাইরা তাদের গোত্রে প্রতিবছর ই কুস্তি খেলার আয়োজন করত। যে হেরে যেত তার শাস্তি হত মৃত্যুদণ্ড। একের পর এক রাউন্ড খেলে যে ব্যক্তি বিজয়ী হত, তার পরিবারকে সর্দারের পক্ষ থেকে অনেক দামী দামী পুরষ্কার ও কয়েক মাসের জন্য খাবার উপহার দেয়া হত। এরপর কুস্তিতে বিজয়ী শক্তিশালী লোকটাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ফেলত সর্দারের লোক।
পরবর্তীতে লকেটের শক্তি ব্যাবহার করে সর্দারের আত্মা শক্তিশালী লোকটার শরীরে ঢুকে যেত। এভাবেই লুসাইদের সর্দার রা বছরের পর বছর শাসন ও অত্যাচার করে চলছিল।
.
.
.
তিং মাং নথি থেকে এগুলো সম্পর্কে জেনে নিজেও রাতুল ও শায়লার মত সমান অবাক হয়েছিল সেদিন। কারণ সে এগুলো আগে কিছুই জানত না।তবে তিং মাং খুব খুশিও হয় এবং গর্ব করে রাতুল ও শায়লাকে জানায়, সেই বিখ্যাত লকেটটা এখন তার একমাত্র ছেলের কাছে। সে আরো জানায়, ফাহাদ এগুলো সম্পর্কে কিছুই জানে না। তিং মাং আজকেই ফাহাদকে সব কিছু খুলে বলবে; যাতে করে এই মহাশক্তিশালী লকেটটাকে অসাবধানতাবশত কোথাও আবার হারিয়ে না ফেলে।
.
.
এক হাতে একটা কাচের গ্লাস নিয়ে ক্যাচ খেলতে খেলতে রাতুল তিং মাং কে উপদেশ দেয়;
ফাহাদকে এখনি এসব জানালে ও যদি লকেটের শক্তি ব্যাবহার করে খারাপ কাজ করা শুরু করে??
" নাহ, আমি ফাহাদকে চিনি। ও এমন কিছুই করবে না। " জবাব দেয় তিং মাং।
.
হঠাৎ করে হাত থেকে কাচের গ্লাসটা নিচে পরে যায় রাতুলের। গ্লাসটা ভেংগে গিয়ে আঘাত হানে আয়েশার বা পায়ে। তাৎক্ষণিক ভাবেই ওর পা থেকে রক্ত ঝরা শুরু হয়।
রাতুল কিছুই বুঝতে পারে নি। লকেটের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। সে হতভম্ভ হয়ে তিং মাং এর মুখের দিকে তাকায়।
" আপনার বাসায় ফাস্ট এইড কিট আছে ভাবী?" রাতুল শশব্যস্ত কন্ঠে জানতে চায় ।
হ্যাঁ আছে আমি এনে দিচ্ছি', বলেই তিং মাং ফাস্ট এইড বক্স আনতে বাসার ভিতরে ছুটে যায়।
পা হাত দিয়ে ধরে গোঙাতে থাকা আয়েশার কপালে চুমু খেয়ে একটা ক্রুর হাসি হাসে রাতুল।
.
.
সেদিন বিকেলে স্কুল ছুটির পর ফাহাদ যখন বাসায় ফিরে, দেখতে পায় তার মা ফ্লোরের উপর লুটিয়ে পরে আছে। ফাহাদ দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পরে তিং মাং এর উপর। খুব ঠান্ডা হয়ে আছে তিং মাং এর শরীর টা। কি করতে হবে বুঝতে না পেরে বাসার টেলিফোন থেকে সে উমরকে ফোন দেয় ফাহাদ।অফিস ফেলে উমর বাসায় ছুটে আসে, এসে দেখতে পায় তিং মাং কে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে তার ছেলে। হতভম্ভ উমরও একসময় তিং মাং নেই বুঝতে পারার পর ফাহাদের মতই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। হার্ট এট্যাকের কারণে মারা গিয়েছে তিং মাং, ডাক্তারী রিপোর্টএ এমনটাই লেখা এসেছিল।
তিং মাং এর মৃত্যুর পর বেশ কিছুদিন কেটে যায়।
রাতুল ও আয়েশা প্রায় ই উমরের বাসায় আসে। মা হারা ফাহাদের প্রতি যেন তাদের আদর অনেক বেড়ে গিয়েছে।
ফাহাদকে এটা ওটা রান্না করে এনে খাওয়াত আয়েশা। রাতুল ও বেশ স্নেহ করত তাকে।
কিন্তু একদিন আয়েশা কি ভেবে যেন ফাহাদের গলা থেকে এক টানে নীল লকেটটা ছিড়ে হাতের মুঠির ভিতর ঢুকিয়ে নেয়।
ফাহাদের বয়স তখন ১৬ ছুঁই ছুঁই। ফাহাদ সাথে সাথেই ভীষন চিৎকার করে উঠে,
" আমার গলা থেলে লকেট নিলেন কেন?? এক্ষুনি দিয়ে দেন।"
আয়েশা: এটা পরলে তোমার শরীরের ক্ষতি হবে সোনা। আমি রেখে দিচ্ছি। বড় হলে নিও।
ফাহাদ সাথে সাথে ছুটে যায় আয়েশার কাছে;"এটা আমার মায়ের দেয়া লকেট। এতবছর আমার সাথে ছিল কিছু হয়নি!! এখনও কিছু হবে না। আমার মায়ের লকেট দিয়ে দিন বলছি!!"
আয়েশা লকেট দিতে নারাজ। ফাহাদের সাথে তার একটা ছোট্ট হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে হঠাৎ করেই ভুলবশত ফাহাদের এক হাত গিয়ে আয়েশার একটি স্তনের উপর লেগে যায়। আয়েশা সাথে সাথে ফাহাদের নিচপেটে একটা লাথি বসিয়ে দেয়। ফাহাদ ছিটে দু তিন হাত পেছনে গিয়ে লুটিয়ে পরে। পেটে হাত দিয়ে ব্যাথায় কোঁকাতে থাকে সে।আয়েশা লকেট নিয়ে এক রকম ছুটেই দরজার দিকে চলে যায়।
টেবিলের উপরে একটা কাচের ফুলদানি রাখা ছিল। পেটে প্রচন্ড ব্যাথা পাওয়া সত্ত্বেও ফাহাদ আস্তে আস্তে কোন রকমে টেবিলের কাছে গিয়ে ফুলদানিটা তুলে ছুড়ে মারে আয়েশার দিকে। ফুলদানি আয়েশার একদম মাথার পিছনে উড়ে গিয়ে পরে। ধুপ করে দরজার সামনেই লুটিয়ে পরে আয়েশা। ফুলদানি টা ফ্লোরের উপর আছাড় খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
ফাহাদের মুখ থেকে একটা প্রশান্তিময় আওয়াজ বের হয়;
" বিচ"!!
তলপেটে সজোরে লাথি খাওয়ার পর ফাহাদের মনে হচ্ছিল,নাড়িভুঁড়ি সব ফেটে গিয়েছে। ব্যাথায় পেট টন টন করছিল তাও আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে আয়েশার লুটিয়ে থাকা দেহের কাছে যায় সে। লকেট টা হাতে নিয়ে পরম মমতায় বুকে চেপে ধরে কান্না শুরু করে ফাহাদ। ওপারে থাকা মায়ের কাছে অভীমান নিয়ে কিছুক্ষন নালিশ জানায়।
জ্ঞান ফিরতে বেশ কিছুক্ষন সময় লাগে আয়েশার।জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই ফাহাদের বাসা থেকে বেরিয়ে যায় সে।
সেদিন রাতে উমর বাসায় ফিরলে সবকিছু বাবার কাছে বলে দেয় ফাহাদ। উমর শুধু চুপচাপ শুনে।
তার যেন কথাটা বিশ্বাস হয়না। রাতুলদের টাকা পয়সার অভাব নেই। আবার মনে মনে এটাও ভাবে, মেয়ে মানুষ। তাই হয়ত একটা গোল্ডেন চেইনের লোভ সামলাতে পারে নি।ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নেয় উমর।
তবে এ ঘটনার পর থেকে আয়েশা ও রাতুলকে একদম ই দেখতে পারত না ফাহাদ।বেশ কয়েকদিন কেটে যায় অগোছালো ভাবে। উমর বাহিরে থাকে, বাসায় রান্না হয়না। এদিকে আজকাল কাজের বুয়া পাওয়াও দায়।সবমিলিয়ে ভাল যাচ্ছিল না ওদের দিনকাল।
ফাহাদের তার বাবার সাথে সমস্যাটা তখন ই শুরু হয় যখন ফাহাদ জানতে পারে রাতুলের শালিকে বিয়ে করবে উমর। রাতুল এবং আয়েশাকে অসহ্য লাগে ফাহাদের। আর তাদের মাঝের একজ ন এসে ফাহদের নিজের মায়ের সব কিছু ব্যাবহার করবে মালিকানা করবে,এ জিনিসটা কিছুতেই মানতে পারছিলো না সে।বাবার সাথে এসব নিয়ে অনেক তর্ক হলেও ফাহাদ ছোট থাকার কারণে ওর কথার তেমন দাম দিতো না উমর।
আপন মা নিজের কাছেই সবচেয়ে যত্নে থাকে। উমর তিং মাং কে ছাড়া সবকিছু গুছিয়ে নিতে শুরু করলেও ফাহাদ ভেতর থেকে ভেংগেচুরেই ছিলো। মায়ের দেয়া লকেট মুঠো করে ধরে কান্না করতে করতে সে ঘুমিয়ে যেত রাতে।
এদিকে ষড়যন্ত্র করে নিজের শালির সাথে উমরের বিয়ে দিয়ে দেয় রাতুল।
রাতুলের শালি ছিল একটা কলগার্ল। বড় বড় হোটেলে বিজনেসম্যানদের সাথে রাত কাটিয়ে টাকা উপার্জন করত সে। একমাত্র লকেটটা পাওয়ার জন্য উমরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে শালিকাকে উমরের ঘরে ঢোকায় রাতুল।
রাতুলের শালিকা কখনোই এক পুরুষে সন্তুষ্ট না। তাই উমরের সাথে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে সেও রাজী হয়নি প্রথমে। তবে ধূর্ত রাতুল বুদ্ধি দিয়েছিল লকেটটা হাতে আসার পর, অন্য পুরুষের সাথে করা কিছু আপত্তিকর ভিডিও উমরের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। উমর সবকিছু জানার পর ডিভোর্স দিতে এক মুহূর্ত ও দেরী করবে না।ব্যাস, সাপ মড়বে ঠিকই কিন্তু লাঠি ভাংবে না।
( চলবে)
.
.

Post a Comment

Previous Post Next Post