গল্প-অবলম্বন,লিখা-প্রিয়ন্তি মুনা (শেষ পর্ব)

--অবলম্বন (শেষ পর্ব)

--প্রিয়ন্তি মুনা


মায়ের বাঁচার অবলম্বনের খোজঁ পেলেও জানা হয়নি সেই অবলম্বনের ব্যক্তিগত ইতিহাস।জানা হয়নি মায়ের এমন গুনগুনিয়ে গান গাওয়া আর ঘুঙুর পড়ে নাচের কারন। জানা হয়নি কেনো এই বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষের ছায়াও পড়েনি মায়ের স্বামীর মৃত্যুর পর।
রুমে এসে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।প্রতিদিনের মতো সকালে ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের ঘুঙুরের আওয়াজে। সেই চিরচেনা স্বর্গীয় রুপে মাকে যেন আজ আরো বেশি সুন্দর লাগছে।
মায়ের গুনগুনিয়ে গান শোনাটা যেন মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর অনুভূতি।
সকাল সকাল কলেজের মেয়েগুলো চলে আসে বাড়িতে নাচের প্রাকটিস করতে।মা আমাদেরকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে, গুছিয়ে প্রাকটিস করায়।মেয়েদের নাচের সাথে সাথে ঘুঙুরের আওয়াজ যেন সারা বাড়ি মাতিয়ে তোলে। নাচের প্রাকটিস করতে করতে দুপুর হয়ে যায়।আমরা সবাই হাঁপিয়ে উঠলেও মা হাঁপায় না।হঠাৎই এক ব্যক্তি বাড়ির গেটের সামনে এসে নিপা নিপা বলে ডাকতে থাকে।মা লোকটার কথা শুনেই দৌড়ে যেয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়।আমি ভাবলাম হয়তো মা লজ্জা পেয়ে চলে গেছে।
মেয়েরা সবাই চলে গেলে মায়ের রুমে ঢুকতেই দেখি মা ভয়ে চুপ করে খাটের পাশে বসে আসে আর কাদতেঁ কাদতেঁ বলছে আমাকে আর মারবেন না, আমাকে আর ব্যাথা দিয়েন না,আমি আপনার কথা শুনবো।মা চোখ বন্ধ করে এসব বলছে আর কান্না করেই চলছে।আমি তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে যেয়ে মাকে জরিয়ে ধরি।মায়ের এমন আচরণের কূলকিনারা করতে পারি না।
মাকে কোন ভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করলাম যে, দেখো মা আমি অন্তি ।তোমার মেয়ে।তোমার বেঁচে থাকার অবলম্বন।তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? মা আমার কথা শুনে আমাকে জরিয়ে ধরে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো।আমিও মাকে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আমাদের কান্না শুনে তুলি খালা দৌড়ে রুমে এসে আমাদের কান্না দেখে সেও কাঁদতে থাকে।মাকে কোনো ভাবে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।
মা ঘুমিয়ে পড়লে তুলি খালাকে মায়ের অতীত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।প্রথমে তুলি খালা বলতে রাজি না হলেও আমার জোরাজুরিতে রাজি হলেন। তুলি খালা বলতে লাগলেন, যখন মাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করা হয় তখন এক ছেলে নাকি মাকে ভালোবাসতো।মায়ের বিয়ে হয়েছে জেনেও প্রতিদিন একটা করে চিঠি দিয়ে যেত মায়ের জন্য বাড়ির বিশ্বস্ত এক কাজের লোকের হাতে।মা চিঠিগুলো না পড়ে একটা বক্সের মধ্যে লুকিয়ে রাখতো।আর এদিকে মায়ের উপর প্রতিরাতে জানোয়ারের মতো হামলে পড়তো তার স্বামী। মায়ের চিৎকারে এই বাড়ির প্রতিটি ইট কাঁদতো।প্রতিদিন শরীরের একেক জায়গায় নতুন আঘাত নিয়ে সকালের আলোতে নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন। একদিন একটা চিঠি মায়ের স্বামীর হাতে পড়লে সেদিন থেকে শুরু হয় মায়ের উপর আরো বিভৎস নির্যাতন।
বাহির থেকে কয়েকজন পুরুষ এনে তাদের মাঝে নাকি মাকে ছেড়ে দেওয়া হতো।মায়ের পায়ে ঘুঙুর বেধেঁ নাচতে আর গাইতে বলা হতো। মা না করলেই মায়ের শরীরের অঙ্গ গুলো কামড়িয়ে,আছড়িয়ে ছিন্নভিন্ন করতো ওই পাষন্ডগুলো।মায়ের হাতে, গলায়, পিঠে, কোমড়ে, নাভিতে যে ভয়ংকর দাগ গুলো দেখেছি মায়ের উপর অমানুষিক নির্যাতনের চিহ্ন।মায়ের আর্তনাদ বাড়ির বাহির থেকেও শোনা যেতো।সবাই চুপ থাকলেও চুপ থাকেনি সেই ছেলেটা। একদিন ওই লোকগুলোর সাথে বাড়িতে ঢুকে তাদের খাবারে বিষ মিশিয়ে জানোয়ারগুলোকে মেরে ফেলে। মাকে নিয়ে যেতে চাইলে মা ভয়ে তার রুমে বসে কাঁদতে থাকে।ছেলেটাকেও দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে।
আশালতার কাছে তখন প্রতিটি পুরুষ মানুষই একই রকম। মনে মনে ছেলেটাকেও অন্য পুরুষদের মতো মনে করতো।ছেলেটা সেদিন চলে যায়।পরদিন আবার আসে আশালতাকে নিতে কিন্তু আশালতা তাকে দেখেও আবার ভয় পেয়ে নিজের রুমে যেয়ে দরজা আটকে রাখে।
ছেলেটি দরজার কাছে যেয়ে অনেক বুঝায় যে আশালতাকে সে সত্যিই ভালোবাসে। কিন্তু মা নাকি কোনো উওরই দেয়নি।শুধু একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলো, "আমি বাজারে বিক্রি হওয়া এক পন্য যার চূড়ান্ত ভোগ শেষ।যা আছে শুধু বাহিরের আবরন। "
আমি জানতে চাইলাম, তুলি খালা তুমি কি সেই ছেলেটাকে চিনতে?তুলি খালা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে তুমিও তাকে চেনো অন্তি।আমি খালাকে বললাম আমার যদি ভুল না হয় তবে সেই ছেলেটা হলো ডাক্তার আশিক।তুলি খালা বললো হ্যাঁ।আশিক তখন মেডিকেল এর ছাএ।
আকাশ বারবার চেষ্টা করেও আশালতাকে বুঝাতে পারেনি তার ভালোবাসার আকুলতা। আশিকর পরিবার এই ঘটনা জানার পরে আশিককে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।আশিক আজ পর্যন্ত বিয়ে করেনি, শুধুমাএ আশালতাকেই ভালোবেসে ছিলো আর আজও আশালতাকেই ভালোবাসে।
খালার কথাগুলো শুনতে শুনতেই হঠাৎই আমার শরীর কেমন যেন লাগলো।মনে হচ্ছিল এখনই চোখ বন্ধ হয়ে আসবে। মুখ ভরে বমি চলে আসলে দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে বেসিনে বমি করতেই দেখি রক্ত। রক্তের লাল রঙে সাদা বেসিন লাল হয়ে গেল।বুঝতে পারলাম হয়তো খুব বেশি সময় নেই হাতে।যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।তুলি খালাও আমার পিছে পিছে এসে বাথরুমের বাইরে বসে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?আমি কিছু হয়নি বলে সারামুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বের হয়ে তুলি খালাকে আমার প্লান বললাম। খালাও রাজি হয়ে গেলো আমার কথা শুনে।
রাতে মা একটু স্বাভাবিক হলে মাকে বললাম যে কলেজের অনুষ্ঠানে মাকে যেতে হবে।আমার প্রথম স্টেজ পার্রফমেন্স আমি মায়ের সামনেই করতে চাই। মাকে বললাম তুমি না গেলে আমি কখনোই যাবো না। এটাই আমার ইচ্ছা। মা কিছু বলছে না।মায়ের সামনে বসে কান্না করছি।মা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো ঠিক আছে। শুধুমাএ তোর জন্য অন্তি,শুধু তোর জন্য,তুই ছাড়া তো আমার কেউ নেই রে। মায়ের কথা শুনে আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে।একজন অনাথের জন্য মায়ের এতো মায়াদয়া!
মাকে নিয়ে মাঝে ছবি দেখি টিভিতে। মায়ের মনের উপর কেমন প্রভাব তা বোঝার জন্য। মাকে দেখলাম ভালোই রেসপন্স করতে। ভাবলাম তা হলে আর কষ্ট হবে না মায়ের শেষ অবলম্বনের কাছে তাকে পৌছে দিতে।
পরদিন সকালে কলেজে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই আবার ডাক্তার আশিকের সাথে দেখা। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাড়ির দিকে মাকে দেখার আশায়।আমাকে দেখেই হকচকিয়ে উঠলেন। আমি কেমন আছি আর শারীরিক অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, আশালতা মা ভালো নেই।তার বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছি কিন্তু কাউকে তো জিজ্ঞেস করাই হয়নি যে মাকেও কি সে তার অবলম্বন করে বাঁচবে? আমার এমন প্রশ্নের জন্য হয়তো তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। আমি তার হাতে কলেজের অনুষ্ঠানের একটা কার্ড ধরিয়ে বললাম,কেউ যদি আপনাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চায় তাহলে কি সুযোগ দিবেন?অপেক্ষায় থাকবো আপনার। এই কথা বলেই চলে আসলাম।
আজ পুরো কলেজ ভর্তি মানুষ। অনুষ্ঠান শুরু হতে বেশি দেরি নাই।মাকে নিয়ে আসছি আমি।মা আমার জামা আকড়ে ধরে আছে হয়তো খুব ভয় পাচ্ছে এতো পুরুষ মানুষ দেখে। আমি মায়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে বললাম,মা তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?তোমার কোনো ক্ষতি হয় এমন কিছু করবো না,একটু বিশ্বাস রেখো আমার উপরে।মা আমার কথায় স্বাভাবিক হবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। চোখ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।মায়ের হাত ধরে এনে সামনের দিকে একটা সিটে বসালাম।পাশেই বসা ডাক্তার আশিক।আমি মায়ের হাত আমার হাত থেকে সরিয়ে ডাক্তার আশিকের হাতে দিলাম। মাকে বললাম এই তোমার অবলম্বন। বলেই স্টেজে চলে গেলাম।আমি আর পিছনে ফিরে তাকাইনি,দেখতে চাইনি মায়ের অবাক চাহনি।শুধু চেয়েছি মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে।
স্টেজে নাচছি আমি মায়ের শেখানে নাচে আর দেখছি মায়ের হাত এখনো ডাক্তার আশিকের হাতে। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মূহুর্ত এই দৃশ্যটি।মা তার ভয়কে জয় করে ডাক্তার আশিকের পাশে বসে আছে।
হঠাৎই চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসছে সব,মুখ থেকে রক্ত পড়তে লাগলে আর কিছু মনে নেই। যখন চোখ খুললাম তখন মায়ের পাশে ডাক্তার আশিক দাঁড়িয়ে আছে। মা আর তুলি খালা কাঁদছে।আমার চোখ খোলা দেখে মা কাছে এসেই আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন, তুই তো আমার অবলম্বন আমার আর কিছু চাইনা।আমার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না। হাতের ইশারায় ডাক্তার আশিককে কাছে ডেকে আবারও তার হাতে মায়ের হাত দিলাম। আর মাকে বুঝিয়ে দিলাম এই আশিক হচ্ছে তোমার অবলম্বন।
চোখ নিভে আসছে আর ভাবছি, মাকে তার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু দিতে পেরেছি, এখন হয়তো একটু শান্তির ঘুম হবে,,,
গল্প-অবলম্বন,লিখা-প্রিয়ন্তি মুনা (২য় পর্ব)
গল্প- অবলম্বন ,লিখা-প্রিয়ন্তি মুনা (১ম পর্ব)

Post a Comment

أحدث أقدم