গল্পঃ ব্লাক ক্যাফেটেরিয়া
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ
পর্বঃ ২
বিকেল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যের আযানের ঠিক পরেই রাস্তার মোরের টিম টিমে হলুদ রোডলাইট টা জ্বলে উঠে, লাইটের আলো ভেজা পিচঢালা রাস্তার উপর বিকৃত ভাবে প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত এক আবেশ সৃষ্টি করেছে চারদিকে। নির্জন সন্ধ্যে বেলার হালকা বৃষ্টির শব্দটা বেশ অন্যরকম। এই শব্দের সাথে বেশ গরম, ধুমায়িত এক কাপ ঘন দুধের চা হলে পরিবেশ টা খুব বেশিই উপভোগ করা যায়। আজকে আশেপাশের কোনো দোকানপাট খুলে নি কেউ, এ সময়টাতে মফস্বল এড়িয়ার মানুষরা বাসা থেকে বের হয়না। মহিলারা ঘরে ইলিশ খিচুড়ি রান্না করে। যাদের বাসায় ইলিশ থাকে না তারা ডিম দিয়ে কাজ চালায়।
কারো কারো তো আবার বাসাই থাকে না। ঠিক এমন একজনের জন্যই আজ ক্রুইফ সাহেবের ক্যাফেটেরিয়াটা খোলা রাখতে হয়েছে। বিকেল থেকেই একজন দুজন এসে এসে চা-কফি সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিলো।
কিন্তু এ দু'এক জন খদ্দেরকে দিয়ে কি পোষায়! এ আবহাওয়ায় বৃদ্ধ ক্রুইফ সাহেবের এখন বাসায় বসে আরাম করাটাই সবথেকে যথার্থ কাজ ছিলো, কিন্তু তাও তাকে ক্যাফেটেরিয়াটা খোলা রাখতে হয়েছে। কারণ সে জানে সন্ধ্যের অন্ধকার একটু গাঢ় হলেই একজন আসবে। এ দোকানের ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের নিয়মিত কাস্টমার। কাস্টমার শব্দটা আসলে লোকটার সাথে যায় না। মফস্বলে লোকজন ক্যাফেটেরিয়ার সাথে কম পরিচিত। উন্নত শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে ক্রুইফ দম্পতি চলে আসেন এই মফস্বল এলাকায়। সারাজীবনের জমানো টাকা দিয়ে একটা ছোট্ট জায়গা রাখেন ঠিক রাস্তার পাশেই। সেখানেই গড়ে তুলেন সুসজ্জিত মাঝারি মানের একটি ক্যাফেটেরিয়া। রাস্তার একটা ভবঘুরে ছোকরাকে ক্রুইফ দম্পতি তাদের নিজেদের সাথে রাখতে শুরু করেন। সেই ছেলেটাই ক্যাফেতে চা-কফি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করতো। ক্রুইফ সাহেব ছিলেন শান্তি প্রিয়। সে ভাবতেন মানুষ হাজার দুঃখ কষ্ট মাথায় বয়ে নিয়ে এসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়, কিছু সময়ের জন্য হলেও পরম দুঃখী মানুষটাও চায়ের কাপের সাথে কিছু শান্তির সময় কাটায়। মানুষের এই শান্তি মাখা মুখ দেখতে বৃদ্ধ ক্রুইফের ভীষণ ভালো লাগতো।
তার আচরণ ব্যবহারও ছিল সত্যিই অনেক নরম ও সুন্দর। কিন্ত সব জায়গাতেই কিছু খারাপ লোক থাকে। ক্যাফেটেরিয়া খুলে কয়েক মাস যেতে না যেতেই এলাকার কিছু উৎকট ছেলেরা ক্রুইফ সাহেবের ক্যাফেতে এসে আড্ডা দিতে শুরু করে। অন্যান্য কাস্টমারকে প্রচন্ড বিরক্ত করতো এরা ক'জন। নরমভাষী ক্রুইফ সাহেব তাদের বেশ কয়েকবার সুন্দর কথায় বোঝাতে চেয়েও ব্যর্থ হন। তার নরম স্বভাবে ছেলেগুলো আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। যে ছেলেটা সার্ভিস বয় হিসেবে কাজ করত, সে বেশ কয়েকবার মার খেয়েছে ছেলেগুলোর হাতে। ক্রুইফ ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতো আদর করতেন। এমন সব ঘটনায় একদমই বিমর্ষ হয়ে পরেন তিনি৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন ক্যাফেটেরিয়াটা বন্ধ করে দিবেন।
এরকম দুরবস্থার ভিতরে গালে হাত দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ অবস্থায় বসে ছিলেন তিনি। বদ প্রকৃতির ছেলেগুলো টেবিলের উপর পা তুলে হাসি ঠাট্টা করছিলো। এরা সবাই ড্রাগস নেয়। ড্রাগ গ্রহণ করার জন্য এই ক্যাফেটেরিয়ার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর দুটো হয় না। এর অবশ্য একটা কারণ ও রয়েছে, ক্রুইফ সাহেব ক্যাফেটেরিরার ভেতরটায় অন্ধকারকে একটু বেশিই প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষ অন্ধকারে বসে চা খেলে মনের সব দুশ্চিন্তা গুলো চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাটিয়ে উঠতে পারে।
খুবই কম পাওয়ারযুক্ত নীল রঙ এর কিছু লাইট লাগানো আছে মাঝে মধ্যে। কিন্তু অন্ধকারকে পরাজিত করার মত আলো তাতে ছিল না। বখাটেরা এ সুযোগটাই বেশি করে কাজে লাগাচ্ছিলো।
বিষন্নতা নিয়ে গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে করতে একটা ঘোরের ভিতর চলে গিয়েছিলেন ক্রুইফ।
হুশ ফিরে একটা ভরাট কঠস্বরে..
এক কাপ গরম চা দিবেন।
লোকটির গলায় দৃঢ়ভাবে আদেশ দেয়ার ভাব ফুটে উঠেছে। মাথা উঠিয়ে লোকটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলায় ক্রুইফ। আগে দেখেনি কখনো এদিকে। চোখ দুটো লম্বা চুলের আড়ালে ঢাকা পরে আছে। নাকসহ হাঁটুর একটু নিচ পর্যন্ত চাদর দিয়ে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখা। পরনে জিন্স, পায়ে একজোড়া স্নিকারস। চায়ের অর্ডার দিয়ে লোকটা ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। বদ ছেলেগুলোর মধ্যে কোনো একটা ছেলে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বাজে কিছু একটা বলে উঠে। লোকটি ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তাদের দিকে। তারপর শোনা যায় বিকট এক আওয়াজ। বৃদ্ধ চোখে ক্যাফেটেরিয়ার শেষ প্রান্তে কি হচ্ছে তা দেখতে পায়না ক্রুইফ। কয়েক সেকেন্ড পর ছ'জন ছেলে চিৎকার করতে করতে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়ে যায়। ক্রুইফ এ ঘটনায় বেশ অবাক হন। তবে অবাক হওয়ার জন্য আরো অনেক কিছুই বাকি ছিল সেদিন। একটু পর সার্ভিস বয়টাও চা দিতে গিয়ে বিকট আকারে চিৎকার করতে করতে ফিরে আসে। হাত থেকে চা পরে যাওয়ায় পা ও পুড়ে যায় তার।
ক্রুইফ নিজে উঠে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে কি হয়েছে দেখার জন্য। আসার পরে উৎকট দৃশ্য দেখে, পারলে সে ও একটা চিৎকার দিয়ে দৌড় দিত এমন অবস্থা হয়। কিন্তু বয়সের ভাবমূর্তি রক্ষায় হাসি চাপার মত করে ভয় টা চেপে রাখে ক্রুইফ।
চাদর পরা লোকটা যেখানে বসে আছে,সেই একই জায়গায় তার মুখোমুখি হয়ে মুখ থুবড়ে টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে পরে আছে একটি নিথর দেহ। মাথাটা কেউ যেন বড় ১০০ কেজির একটি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে টেবিলের সাথে থেতলে দিয়েছে, এমন লাগছে। মাথার খুলি ভেংগে টেবিলের আশেপাশে মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রক্ত গড়িয়ে এসে চাদর দিয়ে ঢাকা লোকটার সাদা স্নিকারস লাল করে দিয়েছে। যে ছেলেটির মৃতদেহ পরে আছে সে ছিল ঐ এলাকার বদ ছেলেগুলোদের লিডার। ক্রুইফ হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কি করতে হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
চা আর আজ পাওয়া যাবে না। বুঝতে পারে লোকটি। উঠে দাড়ায় সে। নিথর হয়ে পরে থাকা ছেলেটির শার্টের কলার ধরে টেনে বের করে টেবিলের বাইরে। এক হাত দিয়ে মৃতদেহটি ট্রলি ব্যাগের মত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে সে। রক্তমাখা জুতোর ছাপের সাথে লম্বা আরো একটি গাঢ় লাল রেখা তৈরি হয় ফ্লোরে। এ ঘটনার পর-পরই ক্যাফেটেরিয়াটি বন্ধ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু অদ্ভুত এক কারণে বন্ধ হয়নি। ক্রুইফ নিজের হাত দিয়ে সব কিছু খুব ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে ফেলেন। পুলিশি ঝামেলা হতে পারে এমন কিছুও মাথায় আসে নি তার।
পরদিন সন্ধ্যায় আবার সেই লোকটি আসে। সার্ভিস বয় আসেনি সেদিন। গতদিনের ভয়ানক দৃশ্য দেখে জ্বর উঠে গিয়েছিলো তার। লোকটি ক্যাফেটেরিয়ায় ঢোকার পরে আগের দিনের জায়গায় গিয়ে বসে। একদম শেষ টেবিলে। সেদিন আর কোন অর্ডার দেয় না। ক্রুইফ বুঝতে পারে, তাকে এখন টাটকা গরম ধুমায়িত দুধ চা দিতে হবে।
এক কাপ চা বানিয়ে ভয়ে ভয়ে টেবিলের উপর দিয়ে চলে আসে সে।
প্রায় এক ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরে লোকটি টাকা না দিয়েই বের হয়ে যাহ। ক্রুইফ চায়ের কাপ আনতে গিয়ে আবার ও ছোট খাট একটা শক খায়। খালি কাপের ভিতরে একটা পুরানো আমলের স্বর্ণমুদ্রা।
এরপর যেদিন যেদিন ক্রুইফের চা বানানো ভালো হয়েছে সে দিন ই সে একটা করে স্বর্ণমুদ্রা পেত।তবে ক্রুইফ মোটেই লোভী ছিল না। সে মুদ্রাগুলোকে যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিতো একটি বক্সে। সেই থেকেই প্রতিদিন আসে অদ্ভুত লোকটি। এসে বসে, চা খায়। ঘন্টা খানেক থাকে। তারপর চলে যায়। কোথায় যায় কেউ জানে না। এর ভিতরে আর একটা কথাও হয়নি তার সাথে। অথচ চোখের সামনে একটি বছর অতিবাহিত ও হয়ে গেল। ক্রুইফের কাছে সে একজন সাধারণ নিয়মিত কাস্টমারের থেকেও একটু বেশি কিছু। সেজন্যই, আজ ও আসবে বলে সন্ধ্যার এ অলস-বৃষ্টির মাঝেও ক্যাফেটেরিয়া খোলা রেখে বসে আছে ক্রুইফ।
অদ্ভুতুড়ে লোকটির আসার সময় হয়ে এলো প্রায়। ক্রুইফের এ অপেক্ষার ভিতরেই হুড়মুড় করে দৌড়ে ক্যাফেটেরিয়ার ভিতরে প্রবেশ করে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া মুখে কারুকার্য যুক্ত মুখোশ লাগানো একটি মেয়ে।
তার কয়েক সেকেন্ড পরই পেছনে পেছনে মেয়েটিকে অনুসরণ করে ছুটে আসে পাঁচজন বলিষ্ঠ পুরুষ। বৃদ্ধ ক্রুইফকে উপেক্ষা করেই তারা মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। ক্রুইফ বুঝতে পারে এখন কি হতে চলেছে। প্রতিরোধ করার শক্তি না থাকায় সে নিরব হয়ে থাকে। মেয়েটি ক্যাফেটেরিয়ার শেষ প্রান্তে গিয়ে খাঁচায় আটকে পরা কবুতরের মত ছটফট করতে শুরু করে। পাঁচজনের ভিতরে থাকা একজন খপ করে মেয়েটির হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলে। প্রথমেই তার হাত চলে যায় মেয়েটির শরীর আবৃত করে রাখা খানদানী পোশাকের দিকে।
মেয়েটির আর্তচিৎকারের সাথে সাথে ছেলেগুলোর কানে ভেসে আসে
ক্রুইফের আনন্দের চিৎকারও!
পাঁচজনই অবাক হয়ে পেছনে ফিরে তাকায়।হালকা বৃষ্টির মাঝেও হঠাৎ বিজলী চমকে ওঠে। সেই আলোতেই সব ক'জন দেখতে পায় ক্যাফেটেরিয়ার দরজায় লম্বা চাদর পরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। দেহের অবয়ব ছাড়া যার আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
...
চলবে...
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ
পর্বঃ ২
বিকেল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যের আযানের ঠিক পরেই রাস্তার মোরের টিম টিমে হলুদ রোডলাইট টা জ্বলে উঠে, লাইটের আলো ভেজা পিচঢালা রাস্তার উপর বিকৃত ভাবে প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত এক আবেশ সৃষ্টি করেছে চারদিকে। নির্জন সন্ধ্যে বেলার হালকা বৃষ্টির শব্দটা বেশ অন্যরকম। এই শব্দের সাথে বেশ গরম, ধুমায়িত এক কাপ ঘন দুধের চা হলে পরিবেশ টা খুব বেশিই উপভোগ করা যায়। আজকে আশেপাশের কোনো দোকানপাট খুলে নি কেউ, এ সময়টাতে মফস্বল এড়িয়ার মানুষরা বাসা থেকে বের হয়না। মহিলারা ঘরে ইলিশ খিচুড়ি রান্না করে। যাদের বাসায় ইলিশ থাকে না তারা ডিম দিয়ে কাজ চালায়।
কারো কারো তো আবার বাসাই থাকে না। ঠিক এমন একজনের জন্যই আজ ক্রুইফ সাহেবের ক্যাফেটেরিয়াটা খোলা রাখতে হয়েছে। বিকেল থেকেই একজন দুজন এসে এসে চা-কফি সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিলো।
কিন্তু এ দু'এক জন খদ্দেরকে দিয়ে কি পোষায়! এ আবহাওয়ায় বৃদ্ধ ক্রুইফ সাহেবের এখন বাসায় বসে আরাম করাটাই সবথেকে যথার্থ কাজ ছিলো, কিন্তু তাও তাকে ক্যাফেটেরিয়াটা খোলা রাখতে হয়েছে। কারণ সে জানে সন্ধ্যের অন্ধকার একটু গাঢ় হলেই একজন আসবে। এ দোকানের ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের নিয়মিত কাস্টমার। কাস্টমার শব্দটা আসলে লোকটার সাথে যায় না। মফস্বলে লোকজন ক্যাফেটেরিয়ার সাথে কম পরিচিত। উন্নত শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে ক্রুইফ দম্পতি চলে আসেন এই মফস্বল এলাকায়। সারাজীবনের জমানো টাকা দিয়ে একটা ছোট্ট জায়গা রাখেন ঠিক রাস্তার পাশেই। সেখানেই গড়ে তুলেন সুসজ্জিত মাঝারি মানের একটি ক্যাফেটেরিয়া। রাস্তার একটা ভবঘুরে ছোকরাকে ক্রুইফ দম্পতি তাদের নিজেদের সাথে রাখতে শুরু করেন। সেই ছেলেটাই ক্যাফেতে চা-কফি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ করতো। ক্রুইফ সাহেব ছিলেন শান্তি প্রিয়। সে ভাবতেন মানুষ হাজার দুঃখ কষ্ট মাথায় বয়ে নিয়ে এসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়, কিছু সময়ের জন্য হলেও পরম দুঃখী মানুষটাও চায়ের কাপের সাথে কিছু শান্তির সময় কাটায়। মানুষের এই শান্তি মাখা মুখ দেখতে বৃদ্ধ ক্রুইফের ভীষণ ভালো লাগতো।
তার আচরণ ব্যবহারও ছিল সত্যিই অনেক নরম ও সুন্দর। কিন্ত সব জায়গাতেই কিছু খারাপ লোক থাকে। ক্যাফেটেরিয়া খুলে কয়েক মাস যেতে না যেতেই এলাকার কিছু উৎকট ছেলেরা ক্রুইফ সাহেবের ক্যাফেতে এসে আড্ডা দিতে শুরু করে। অন্যান্য কাস্টমারকে প্রচন্ড বিরক্ত করতো এরা ক'জন। নরমভাষী ক্রুইফ সাহেব তাদের বেশ কয়েকবার সুন্দর কথায় বোঝাতে চেয়েও ব্যর্থ হন। তার নরম স্বভাবে ছেলেগুলো আরো বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। যে ছেলেটা সার্ভিস বয় হিসেবে কাজ করত, সে বেশ কয়েকবার মার খেয়েছে ছেলেগুলোর হাতে। ক্রুইফ ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতো আদর করতেন। এমন সব ঘটনায় একদমই বিমর্ষ হয়ে পরেন তিনি৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন ক্যাফেটেরিয়াটা বন্ধ করে দিবেন।
এরকম দুরবস্থার ভিতরে গালে হাত দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ অবস্থায় বসে ছিলেন তিনি। বদ প্রকৃতির ছেলেগুলো টেবিলের উপর পা তুলে হাসি ঠাট্টা করছিলো। এরা সবাই ড্রাগস নেয়। ড্রাগ গ্রহণ করার জন্য এই ক্যাফেটেরিয়ার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর দুটো হয় না। এর অবশ্য একটা কারণ ও রয়েছে, ক্রুইফ সাহেব ক্যাফেটেরিরার ভেতরটায় অন্ধকারকে একটু বেশিই প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষ অন্ধকারে বসে চা খেলে মনের সব দুশ্চিন্তা গুলো চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাটিয়ে উঠতে পারে।
খুবই কম পাওয়ারযুক্ত নীল রঙ এর কিছু লাইট লাগানো আছে মাঝে মধ্যে। কিন্তু অন্ধকারকে পরাজিত করার মত আলো তাতে ছিল না। বখাটেরা এ সুযোগটাই বেশি করে কাজে লাগাচ্ছিলো।
বিষন্নতা নিয়ে গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে করতে একটা ঘোরের ভিতর চলে গিয়েছিলেন ক্রুইফ।
হুশ ফিরে একটা ভরাট কঠস্বরে..
এক কাপ গরম চা দিবেন।
লোকটির গলায় দৃঢ়ভাবে আদেশ দেয়ার ভাব ফুটে উঠেছে। মাথা উঠিয়ে লোকটির পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলায় ক্রুইফ। আগে দেখেনি কখনো এদিকে। চোখ দুটো লম্বা চুলের আড়ালে ঢাকা পরে আছে। নাকসহ হাঁটুর একটু নিচ পর্যন্ত চাদর দিয়ে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখা। পরনে জিন্স, পায়ে একজোড়া স্নিকারস। চায়ের অর্ডার দিয়ে লোকটা ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। বদ ছেলেগুলোর মধ্যে কোনো একটা ছেলে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বাজে কিছু একটা বলে উঠে। লোকটি ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তাদের দিকে। তারপর শোনা যায় বিকট এক আওয়াজ। বৃদ্ধ চোখে ক্যাফেটেরিয়ার শেষ প্রান্তে কি হচ্ছে তা দেখতে পায়না ক্রুইফ। কয়েক সেকেন্ড পর ছ'জন ছেলে চিৎকার করতে করতে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়ে যায়। ক্রুইফ এ ঘটনায় বেশ অবাক হন। তবে অবাক হওয়ার জন্য আরো অনেক কিছুই বাকি ছিল সেদিন। একটু পর সার্ভিস বয়টাও চা দিতে গিয়ে বিকট আকারে চিৎকার করতে করতে ফিরে আসে। হাত থেকে চা পরে যাওয়ায় পা ও পুড়ে যায় তার।
ক্রুইফ নিজে উঠে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে কি হয়েছে দেখার জন্য। আসার পরে উৎকট দৃশ্য দেখে, পারলে সে ও একটা চিৎকার দিয়ে দৌড় দিত এমন অবস্থা হয়। কিন্তু বয়সের ভাবমূর্তি রক্ষায় হাসি চাপার মত করে ভয় টা চেপে রাখে ক্রুইফ।
চাদর পরা লোকটা যেখানে বসে আছে,সেই একই জায়গায় তার মুখোমুখি হয়ে মুখ থুবড়ে টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে পরে আছে একটি নিথর দেহ। মাথাটা কেউ যেন বড় ১০০ কেজির একটি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে টেবিলের সাথে থেতলে দিয়েছে, এমন লাগছে। মাথার খুলি ভেংগে টেবিলের আশেপাশে মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রক্ত গড়িয়ে এসে চাদর দিয়ে ঢাকা লোকটার সাদা স্নিকারস লাল করে দিয়েছে। যে ছেলেটির মৃতদেহ পরে আছে সে ছিল ঐ এলাকার বদ ছেলেগুলোদের লিডার। ক্রুইফ হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কি করতে হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
চা আর আজ পাওয়া যাবে না। বুঝতে পারে লোকটি। উঠে দাড়ায় সে। নিথর হয়ে পরে থাকা ছেলেটির শার্টের কলার ধরে টেনে বের করে টেবিলের বাইরে। এক হাত দিয়ে মৃতদেহটি ট্রলি ব্যাগের মত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে সে। রক্তমাখা জুতোর ছাপের সাথে লম্বা আরো একটি গাঢ় লাল রেখা তৈরি হয় ফ্লোরে। এ ঘটনার পর-পরই ক্যাফেটেরিয়াটি বন্ধ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু অদ্ভুত এক কারণে বন্ধ হয়নি। ক্রুইফ নিজের হাত দিয়ে সব কিছু খুব ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে ফেলেন। পুলিশি ঝামেলা হতে পারে এমন কিছুও মাথায় আসে নি তার।
পরদিন সন্ধ্যায় আবার সেই লোকটি আসে। সার্ভিস বয় আসেনি সেদিন। গতদিনের ভয়ানক দৃশ্য দেখে জ্বর উঠে গিয়েছিলো তার। লোকটি ক্যাফেটেরিয়ায় ঢোকার পরে আগের দিনের জায়গায় গিয়ে বসে। একদম শেষ টেবিলে। সেদিন আর কোন অর্ডার দেয় না। ক্রুইফ বুঝতে পারে, তাকে এখন টাটকা গরম ধুমায়িত দুধ চা দিতে হবে।
এক কাপ চা বানিয়ে ভয়ে ভয়ে টেবিলের উপর দিয়ে চলে আসে সে।
প্রায় এক ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরে লোকটি টাকা না দিয়েই বের হয়ে যাহ। ক্রুইফ চায়ের কাপ আনতে গিয়ে আবার ও ছোট খাট একটা শক খায়। খালি কাপের ভিতরে একটা পুরানো আমলের স্বর্ণমুদ্রা।
এরপর যেদিন যেদিন ক্রুইফের চা বানানো ভালো হয়েছে সে দিন ই সে একটা করে স্বর্ণমুদ্রা পেত।তবে ক্রুইফ মোটেই লোভী ছিল না। সে মুদ্রাগুলোকে যত্ন করে সাজিয়ে রেখে দিতো একটি বক্সে। সেই থেকেই প্রতিদিন আসে অদ্ভুত লোকটি। এসে বসে, চা খায়। ঘন্টা খানেক থাকে। তারপর চলে যায়। কোথায় যায় কেউ জানে না। এর ভিতরে আর একটা কথাও হয়নি তার সাথে। অথচ চোখের সামনে একটি বছর অতিবাহিত ও হয়ে গেল। ক্রুইফের কাছে সে একজন সাধারণ নিয়মিত কাস্টমারের থেকেও একটু বেশি কিছু। সেজন্যই, আজ ও আসবে বলে সন্ধ্যার এ অলস-বৃষ্টির মাঝেও ক্যাফেটেরিয়া খোলা রেখে বসে আছে ক্রুইফ।
অদ্ভুতুড়ে লোকটির আসার সময় হয়ে এলো প্রায়। ক্রুইফের এ অপেক্ষার ভিতরেই হুড়মুড় করে দৌড়ে ক্যাফেটেরিয়ার ভিতরে প্রবেশ করে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া মুখে কারুকার্য যুক্ত মুখোশ লাগানো একটি মেয়ে।
তার কয়েক সেকেন্ড পরই পেছনে পেছনে মেয়েটিকে অনুসরণ করে ছুটে আসে পাঁচজন বলিষ্ঠ পুরুষ। বৃদ্ধ ক্রুইফকে উপেক্ষা করেই তারা মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। ক্রুইফ বুঝতে পারে এখন কি হতে চলেছে। প্রতিরোধ করার শক্তি না থাকায় সে নিরব হয়ে থাকে। মেয়েটি ক্যাফেটেরিয়ার শেষ প্রান্তে গিয়ে খাঁচায় আটকে পরা কবুতরের মত ছটফট করতে শুরু করে। পাঁচজনের ভিতরে থাকা একজন খপ করে মেয়েটির হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলে। প্রথমেই তার হাত চলে যায় মেয়েটির শরীর আবৃত করে রাখা খানদানী পোশাকের দিকে।
মেয়েটির আর্তচিৎকারের সাথে সাথে ছেলেগুলোর কানে ভেসে আসে
ক্রুইফের আনন্দের চিৎকারও!
পাঁচজনই অবাক হয়ে পেছনে ফিরে তাকায়।হালকা বৃষ্টির মাঝেও হঠাৎ বিজলী চমকে ওঠে। সেই আলোতেই সব ক'জন দেখতে পায় ক্যাফেটেরিয়ার দরজায় লম্বা চাদর পরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। দেহের অবয়ব ছাড়া যার আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
...
চলবে...

Post a Comment