গল্প: অপূর্ণতা |লেখা... Jahedul Hoque Subon


এক
.
এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছি আনিলার শ্বশুড় বাড়ির গেটের সামনে। এখন সন্ধ্যা ৭:২৫ মিনিট। এই জায়গাটায় আমি এই নিয়ে তৃতীয় বার আসলাম। এখানে আসলে অন্যরকম একটা আভা আমার সমস্ত দেহে ছুয়ে যায়। সেই আভাটার স্পর্শ যেন আমাকে বলে বেড়ায় তুমি কি একা থাকতে পছন্দ করো? একাকীত্বকে ভালোবাসো? চিন্তায় পড়ে যাই, চিন্তায় চুপ হয়ে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটতে থাকি। মাঝে মাঝে অনুধাবন করি এখানে আসলেই কেন এই উদ্ভট একটা প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়? আমি ভেবে এর ধাধা মিলাতে পারি না। তবে দ্বিতীয় বার যখন এসেছিলাম তখন কিছুটা অনুমান করতে পেরেছি জায়াগাটার চারপাশটাকে যেন নিরব/শান্ত বা একাকীত্ব এই জাতীয় কিছু দু হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেন এখানে চিৎকার বা জোড়ে কথা বলা নিষেধ। জায়গাটা এতোটা নিরব যে হয়তবা এখানে আসলেই এই উদ্ভট প্রশ্নটা আমার হৃদয়ে শিহরিত হয়ে জেগে ওঠে আর বলে একাকীত্ব ভালোবাসো? পাঁচ তলা ভবনের তিন তলায় আনিলারা থাকে। আমার চোখ দুটোকে ভবনের ৩য় তলার দিকে তাক করালাম। আদনান ও তাকিয়ে আছে। ওকে দেখলে আমার মায়া হয়, খারাপ লাগে। কোন বুঝ দিতে পারি না। বার বার আমি ব্যার্থ হই। ভবনের দিকে তাকিয়ে থেকেই ও আমাকে বললো...
.
”দোস্ত ভিতরে যাই?
”না খবরদার । দ্বিতীয়বার এই শব্দটা উচ্চারনও করবি না। 
”একটু দেখে চলে আসবো। প্লিজ না করিস না? আয় না আমার সাথে।
.
আমি চুপ হয়ে গেলাম। কোন কথা খুঁজে পেলাম না। হয়তো আমার কথার ঝুলিতে কোন শব্দ নেই। যে শব্দ দিয়ে আমি ওকে কিছু বলবো। যে শব্দ শুনে ওর মনকে শান্তনা দিতে পারবো। কিন্তু আমি পারি না। আমি পারি না বলতে তুই জানিস না ভালোবাসার মুদ্রার অপর পিঠের অক্ষর গুলো কি? কিভাবে বলবো? আমিও যে সেই ভালোবাসার মুদ্রার সাথে সংমিশ্রিত। আমি ওর হাতটা ধরলাম তারপর বললাম...
.
”তুই এতো অসাধু চরিত্রের কেন রে? তুই জানিস আনিলার বিয়ে হয়েছে। ওর একটা সংসার হয়েছে। জীবনে একটা তীর খুঁজে পেয়েছে। কত স্বপ্ন নিয়ে পথ অতিক্রম করার আলো ভুনছে। আর তুই কিনা সাইক্লোন হয়ে সে জীবনের তীর লন্ডভন্ড করতে যাচ্ছিস? সে আলো নিভোতে চাইছিস?
.
ও আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেই দীর্ঘশ্বাসের নিশ্বাসটা আমার হৃদয়ে স্পর্শ করলো। স্পর্শে আমার দেহের প্রতিটা অংশ শীতল হয়ে গিয়েছে। ওর নিশ্বাসটা আমার শ্রবনে বাজে দোস্ত অনেক কষ্ট হয়রে। ভিতরটা জ্বলেপুড়ে যায়। তীব্র যন্ত্রনার মাঝে হাবুডাবু খাচ্ছি। আমার যে একদম ভালো লাগে না। ... ওর নিশ্বাসের শব্দে আমার চোখে কান্না চলে আসে। ওর চোখের দিকে তাকাতে আমার ভয় লাগে। এই চোখের মাঝে না পাওয়ার অর্থ ভেসে বেড়ায়। পাঁচ বছরের রিলেশন এক একটা স্মৃতি এক একটা মুহুর্ত ধমকা বাতাসে ধুলোর সহিত বিলিন হয়ে গেছে। আমি ওকে জড়িয়ে আমার বুকের সাথে আকড়ে ধরি। তারচেয়ে আরো বেশি শক্ত করে জড়িয়ে চোখে বর্ষার আগমন ঘটিয়ে ও বলে.. জানিস আমার ভিতরে কি চলছে? বুকটা ছিড়ে যদি তোকে দেখাতে পারতাম তুই বুঝতি।
.
আমি নিশ্চুপ হয়ে থাকি আর অনুধাবন করি পৃথিবীতে শুধু একটা শব্দের কারনে হাজার হাজার স্বপ্ন আধাঁরের মাঝে তলিয়ে যায়। সেই শব্দটা একজন ছেলে হয়ে জন্মের সাথে সাথে তার শরীরের সাথে মিশে যায়। জন্মের পর একটু একটু করে যতই বড় হয় সেই শব্দটা তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এই শহরের হাজার হাজার শব্দের মধ্যে আমি এই একটা মাত্র শব্দকে ভয় পাই। খুব ভয়ংকর সেই শব্দটা। আমি খুব ভাল করেই এই শব্দটার সাথে পরিচিত। আর এই শব্দটা হলো "বেকার" এটা মানুষের সাথে ছায়ার মত লেগে থাকে। কত অদ্ভুত একটা শব্দ। কত অদ্ভুত ভাবে এই বেকার শব্দটা আদনান আর আনিলার মাঝে বিশাল দেয়াল তৈরি করেছে। আমার বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ও বললো...
.
"ভেবেছিলাম একবার দেখতে পাব। কিন্তু তা আর হলো নারে। তুই ঠিকি বলছিস আমি একটা অসাধু চরিত্রের লোক। না হলে বিয়ে হওয়ার পরও ক্যান তাকে দেখার জন্য মন কাদেঁ। তাকে দেখার জন্য ছুটে আসি। আমি ওর শ্বশুড় বাড়ির ভিতরে গেলে অনেক কেলেংকারি হয়ে যাবে। কিন্তু মন মানে নারে। 
.
স্তব্দ হয়ে ভবনের তৃতীয় তলার দিকে এক নজর দেখে হাটতে থাকি। আদনান সিগারেট ধরিয়ে ফু ফু করে টানতে টানতে উপরের দিকে ধোয়া গুলা ছেড়ে দেয়। মাঝে মাঝে ভাবি এই ধোয়ার মতন যদি উড়ে আকাশের সাথে মিশে যেতাম। আমি জানি আদনানের ভিতর এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সে শূন্যতা অনন্তকাল বিরাজ করবে। জীবনে যদি দ্বিতীয়বার এসে কেউ কড়া নাড়ে তারপরও সে শূন্যতা হুট করে উকি দিয়ে বলবে... আমাকে চিন্তে পেরেছো? আমি হাসি, জীবনটা কত নোনা স্বপ্নে তৈরি করা।
.
দুই
.
জন্মের পর থেকেই আমি আমার মামা মামির কাছে বড় হয়েছি। মার চেহারাটা কখনো দেখিনি। তবে মামা একটা ফটো দিয়েছিল । যখনি আমার খুব মন খারাপ থাকে মানিব্যাগ থেকে ফটোটা বের করে চেয়ে থাকি। আমার মা খুব সুন্দর ছিল। চুল গুলো ছিল কত লম্বা। আমার বাবাকে নাকি অনেকে বলতো... জীবনে আর কিছু না পাও জাফর মিয়া তবে একটা হীরা পেয়েছো। কখনো হারিও না। এটা যে কত মূল্যবান। কিন্তু আমার বাবা আমার মাকে আকড়ে ধরে রাখতে পারে নি। পারে নি সেই হীরাটুকুকে নিজের কাছে রেখে দিতে। আমার জন্মের কয়েক ঘন্টা পর নাকি আমার মা উপারে চলে যায়। বাবা এটা মেনে নিতে পারে নি। সেই শূণ্যতা বাবাকে গ্রাস করে ফেলে, উন্মাদ হয়ে যায়, শিকড় দিয়ে বাবাকে বেধে রাখে। যেমনটা মামা আমাকে বলেছে। অনেকে বলতো আমি একটা কাল বৈশাখী ঝড়, আমি আমার মাকে কেড়ে নিয়েছি। মা বাবার আদর কি রকম সেটা আমি এখনো উপলব্দি করতে পারি নি। পারি নি তাদের আদর শরীরে মাখতে। জন্মের দু দিন পরেই আমাকে মামা নিয়ে যায়। মামার বিয়ে করতে অনেক কষ্ট হয়েছিল। যখনি কোন প্রস্তাব নিয়ে যেত একটা ঝামেলা বেধে যেত যে, মামার একটা ছেলে আছে। পরে অবশ্য অনেক ঝামেলার পর বিয়ে হয়েছিল। 
.
প্রথম প্রথম মামার মত মামিও আমাকে আদর স্নেহ করত। কিন্তু একটা সময়ে মামির কোলে যখন নিতু আসে তখন আমার আদরের দুরুত্ব বাড়তে থাকে। সময়ের সাথে সাথে মামির আদর থেকে ব্যবচ্ছেদ হয়ে যাই। মাথার উপর থেকে ছাদটা ভেঙ্গে পড়বে এমন মনে হয়। নিতু যখন একটু একটু করে হাটতে শিকল আর আমাকে প্রথম ভায়া বলে ডাকলো আমার যে কি একটা অনুভূতি তৈরি হলো সেটা এখনো আমি অনুভব করি। আমি ওকে কাধে নিয়ে ঘুরি, আমি ঘোড়া সাজি ও আমার পিঠের ওপর চড়ে টগবগ টগবগ করে চলতে থাকে। আমার দেয়ালের চারপাশে ভালোবাসা কড়া নাড়ে। একদিন যখন ওকে আমার কোল থেকে ফেলে দেই ও কি কান্নাটাই না করেছিল। মামি দৌড়ে এসে নিতুকে কোলে নিয়ে আমার গালে দুটো চড় মেরে বলেছিল...
”হতচ্ছড়া মরতে পারিস নাহ? তোকে না বলছি আমার মেয়েকে ধরবি না। মাকে খেয়েছিস। বাবাকে পাগল বানিয়েছিস। খবরদার ফের যদি আমার মেয়েকে ধরিস তোর একদিন কি আমার একদিন।
.
ঐদিন আমি খুব কান্না করেছিলাম। কালো বিষাদ ছায়া আমাকে ঘিরে ধরেছিল। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। জানালার ফাকে মার ফটোটা হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে খুব বলেছিলাম.. আমাকে নিয়ে যাও না ওমা। তোমার ছায়ার নিচে আমাকে একটু জায়গা দাও। আমার যে এখানে একদম ভাল্লাগেনা। আমি খুব একা।... কান্না করতে করতে কখন যে জানালার পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি মামি আমার সমস্ত জামা কাপড় ঘুছিয়ে একটা ব্যাগে রেখেছে। তারপর পাঠিয়ে দেয় হোস্টেলে। হোস্টেলে যাওয়ার আগে আমি বার বার মামাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলাম। মামা অসহায়ের মত চুপ করেছিল। মামির পায়ে ধরে বলেছিলাম... আমাকে কোথাও পাঠিও না। আমি আর নিতুকে কোলে নিব না। ওর কাছে যাব না। তবু একটু থাকতে দাও। কিন্তু আমার কান্নার শব্দ মামির হৃদয়ে স্পর্শ করতে পারে নি। মামির হৃদয়ে আমার চোখের জল টুকুর কষ্ট পৌছাতে অক্ষম ছিলাম। অবশ্য এই দিকে উনাদের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ, আমার ভাসির্টি আসা পর্যন্ত পড়ালেখার খরচ, খাওয়ার খরচ, পৃথিবীতে আলো দেখার সুযোগ কিংবা বাঁচার জন্য পাশে ছিল এর চেয়ে আর কি বা আশা করা যায়। 
.
আদনানের অবস্থা তেমন একটা সুবিধা মনে হয় না আমার কাছে। দিন দিন কেমন শুকিয়ে গেছে। কেমন যেন অন্ধাকার হয়ে যাচ্ছে ওর চারপাশ। ওর মা বাবা হয়তো জানে না ওর এই অবস্থার ধরন। আমি ওকে বলি...
.
”তুই এই রকম ভাবে থাকিস ক্যান? এই ভাবে তো দিন চলবে না। একটু স্বাভাবিক হ।
”কি রকম থাকতে বলছিস?
”আগের মত। তোর মা বাবার কথা ভাব। আমাকে দেখ। আমার তো তেমন কেউ নেই রে। তোর তো মা বাবা হলেও আছে। তাঁদের কথা ভেবে না হয় একটু স্বাভাবিক হ। তুই জানিস তুই আমার কি? তুই আমার বন্ধু নারে, আমার ভাই। সেই কলেজ লাইফ থেকে তোকে পাশে পেয়েছি। তোর ভালোবাসা পেয়েছি। এইভাবে থাকলে আমারো যে খারাপ লাগে। আর খাতায় কি আজেবাজে এগুলা লিখছিস? সুসাইড করার নোট লিখছিস? থাপড়াইয়া তোর দাঁত ফেলে দিব আমি। আমার সোজা কথা আমি মা হারিয়েছি, বাবা থাকা সত্ত্বেও বাবার স্নেহ ভালোবাসা পাই নি। কিন্তু আমি তোকে হারাতে চাই না। আমার ভাই আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে এটা মানবো না কক্ষনো না। 
.
ও আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। ওর কান্নার স্পন্দন গুলো দেয়ালের চারপাশে ছড়িয়ে যায়। আমি ওকে থামতে বলি না। কান্না করলে মানুষ হালকা হয়। আমিও মাঝে মাঝে কান্না করি, কাউকে দেখতে দেই না। কাউকে অনুভব করতে দেই না। আমার শরীরে ক্লান্তি ফিরে আসে। ভালোবাসার ক্লান্তি। ভালোবাসার সন্ধান খুঁজতে খুঁজতে আমার শরীরে অলস গ্রাস করেছে। অলস শরীর নিয়ে নির্জন রাত্রিতে আমি জোৎস্নার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে অনুধাবন করি একমুঠো ভালোবাসা আছে কি আমার জন্য? 
.
তিন
.
ক্লাসে ঢুকেই যখন ক্যাম্পাসের দিকে আসলাম ওমনি ফিউনা আমার সমুক্ষে এসে ইহা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো..
.
”এই যে কি খবর তোমার? কেমন আছো তুমি?
.
আমি হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে ইঙ্গিত দিলাম ভালো আছি, খারাপ না। উদ্বেগপূর্ণ হয়ে ফিউনার দিকে তাকাই। কি চাঞ্চল্য প্রকৃতির একটা মেয়ে। আমার দুই ব্যাচের জুনিয়র। চোখ গুলা কেমন অদ্ভুত দিব্যাঙ্গনা। ওর সন্নিকটে আমার ছায়া থাকলে আমি স্তব্দ হয়ে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। ওর আখিঁর চাউনিতে মাঝে মধ্যে আমি হারিয়ে যাই। চোখের প্রতিটা পলকে আমার হৃদয় শিহরিত হয়। সাদা পোশাকে ওকে খুব মানায়। ভদ্রতার সহিত আমিও বললাম...
.
”তুমি কেমন আছো? 
”হ্যাঁ আমি তো সব সময় ভালো থাকি জনাব। জনাব তো আমার খোঁজ খবর রাখেই না। অনেক ব্যাস্ত মানুষ। তার ব্যাস্তার মাঝে আমার ছায়া পড়ার একটু জায়গাও পায় না।
.
আমি হাসি। আমার হাসিতে মনোহর নেই । তবুও ফিউনা প্রায় বলে জানো জাহেদ তোমার হাসিটা বড় অদ্ভুত। কি যেন একটা থাকে। প্রথম প্রথম ভার্সিটিতে ওর দিকে তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। চুল গুলা কুকড়া। 
সব সময় চোখে মুখে প্রফুল্লতা বিরাজ করে। আমি বেশ কিছুদিন ওর দিকে মনোস্ক ছিলাম। এটা আদনান টের পেয়ছিল। একদিন আমার কাধে হাত রেখে বলেছিল...
.
"কিরে ইদানিং তুই মনে হয় নিজের মাঝে নেই। কোন এক সমুদ্রের তীরে আটকে গেছিস। লক্ষন কিন্তু সুবিধার না।
.
আমি খোঁচা খোঁচা গালের দাঁড়ি গুলা চুলকাই। একটু হাসি। হাসতে হাসতেই বলি...
.
"কি বলিস আমি তো কিছুই বুঝি না। সহজ ভাষায় বল।
.
ও হাসতে থাকে। আমার দিকে চোখ টিপ মেরে বলে...
.
"দোস্ত লুকাই লাভ নেই। আমি তোর বন্ধু আমি সব বুজি। তোর ভালোলাগে মেয়েটাকে? দেখ সংকোচবোধ করবি না। 
.
আমি মাথা দিয়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। আদনান বলে.. তাইলে চল আমার সাথে। আমি ভ্যাবাচিকা হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকি। আমি নিষেধ করি এইভাবে যাওয়াটা মানায় না। মনোহর দেখায় না। কিন্তু আদনান এক রোখা হয়ে এক প্রকার আমাকে ফিউনার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। আমার শরীরটাকে যেন তখন শীতল হাওয়া ছুয়ে গেছে। ওর নিশ্বাসের শব্দ আমি শুনতে পেয়েছিলাম। শরীরটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। আদনান বললো...
.
”আপনি কি নিউ এই ভার্সিটিতে? না মানে আগে কখনো দেখি নি তো।
.
এই বাক্যটার জন্য হয়ত ও প্রশ্তুত ছিল না। ড্যাবরা ড্যাবরা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর বললো..
.
”জ্বি ভাইয়া। কেন? 
”না তেমন কিছু না। আমি আদনান। আর ও জাহেদ। আমাদের একটা বিশেষ গুন আছে জানেন?
”বারে আমি কিভাবে জানবো?
.
আমি আদনানের হাত চেপে ধরি। ওকে ইশারা দিয়ে বুঝাই চুপ যা। কি করেতেছিস এই গুলা। ও আামার দিকে তাকালো , ওর তাকানোতে এমন একটা ছিল যেন আমাকে বলছিল.. তুই চুপ কর হারামজাদা। এতো অস্বস্থিবোধ করতেছিস ক্যান? এই রকম বলদের মত থাকলে কিছুই পাবা না। তারপর ও ফিউনার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো..
.
”আমরা খুব তাড়াতাড়ি মানুষের সাথে মিশে যাই। মানে ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ড আরকি। এই যেমন আপনার সহিত ফ্রেন্ড হতে আসলাম। 
.
ফিউনা একটু চুপ করে ছিল। চুলগুলা কানে গুজে নিয়েছিল। তখন আমার জগৎটা আরেকটাবার থমকে গিয়েছিল। কোমড়ে হাত রেখে বললো...
.
”আমি আপনাদের ফ্রেন্ড কেন হবো?
.
আদনান আমার দিকে তাকায় আমিও আদনানের দিকে তাকাই। কথা ভেবে পাই না। আদনান মাথার চুল চুলকায়। আমাকে বললো..
.
”কিরে আসলেই তো ফ্রেন্ড হবো কেন? 
.
আমি চুপ হয়ে থাকি। ফিউনা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। আদনান আমার চুপ থাকা দেখে ও যা বললো সেটার জন্য আমি প্রশ্তুত ছিলাম না।
.
”আসলে ও খুব ভাল কবিতা লিখে। ও কবিতা লিখে যাবে আর আপনি ওর কবিতা গুলা পড়বেন। পড়ে বলবেন কেমন হয়েছে। সে কারনেই ফ্রেন্ড হবো।
.
ফিউনা হাসতে থাকে। আর আমি চেয়ে থাকি। কিন্তু আদনান পুরো মিথ্যে বলেছে। আমি কবিতার ক কি সেটাও বুঝিনা। ফিউনা হাসতে হাসতে বলেছিল আগে কবিতা লিখে দেখাক তারপর ভেবে দেখবো ফ্রেন্ড হবো কি হবো না কেমন ভাইয়া। একবার বলতে চেয়েছিলাম আমাকে দিয়ে এসব হয় না। ও কথাটা মিথ্যে বলেছে। কিন্তু কথাটা বলি নি। মন সায় দেয় নি। আমি রাত জাগি, ফিউনা কে নিয়ে ভাবি, কিছু লিখবো বলে। পৃষ্টার পর পৃষ্টা নষ্ট করি আমার রঙ তুলিতে কোন শব্দ শোভা পায় না। সারা রাত ভেবে কবিতা না, রচনা লিখেছিলাম। তার শেষের কয়েক লাইন....
.
অনেক দুর পর্যন্ত হাটতে চাই, মাঝ পথে কালো বিষাদ ছায়া যখন আয়নায় বন্ধী করবে,
তখন কোন এক লাভণ্য তার আলোর ছায়ায় সমুক্ষে এনে আমার চারপাশের বিষাদ ছায়াকে ঢেকে দিবে। বৃষ্টিবাদলে সমুদ্রের তীরে আমায় ভিজিয়ে দিবে ঢেউ,
তুমি এসে হস্ত স্পর্শ করবে আমি নিষ্পলক তাকিয়ে বলবো এমন করে ছুয়ে দেয় নি আগে কখনো কেউ।
অচেতন মনে যদি ইচ্ছা জাগে, তোমার জন্য বানাবো একটা পাহাড়,
অন্ধকার রাত্রিতে পাহাড়ী হাওয়ায় জানালার পাশে, শাল গায়ে, হাতে কফির মগ নিয়ে তাঁরা নিংড়ানো আলোয় ছড়াবে তোমার বাহার।
তার আগে বলো তো তুমি কি নাক ডাকো ঘুমের মধ্যে?
তবে ধসে পড়বে আমার বানানো পাহাড় তোমার নাক ডাকার শব্দে...
.
আমার এই লেখাটা পড়ে ফিউনা অদ্ভুত নেত্রে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল...
.
"জ্বী না আমি ঘুমের মাঝে নাক ডাকি না। আর ডাকলেও নাক ডাকার শব্দে কি পাহাড় ধসে পড়ে? আমার নাক ডাকা কি আপনার কাছে এতোই ভয়ংকর মনে হয়?
.
আমি চুপ হয়ে মাথা নিচু করে মিট মিট করে হাসতে থাকি। সেদিনের পর থেকে আমার সহজ সরল ভাষায় কবিতা লিখার কাজ শুরু করি। ফিউনার জন্য লিখি। ওকে নিয়ে ঘুরি, হাটি, লেকের পাশে বসে থাকি কখনো কখনো পা ডুবিয়ে রাখি। আমি আশায় বুক বাধি। ভালোবাসা কড়া নেড়েছে আমার দরজায়। আমার বেলা শেষ হয়ে যায় ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে। ততোদিনে আমরা "তুমি" শব্দটায় আসি। আমার লেখার মাঝে ফিউনা কিছু একটা আচঁ করতে পেরছিল একদিন বলেছিল..
.
"আচ্ছা তোমার লেখা গুলা যেন কেমন জানি। প্রতিটা শব্দেই যেন আমাকে ঘিরে। যেন মনে হয় খুব গভীর ভাবে একদম মন থেকে লিখা।
.
আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। ভেবে পাই না। তারপর ও ইতস্তত হয়ে বললো...
.
"বেশি গভীরে যেও না জাহেদ। শেষে অনেক কষ্ট পাবা। তোমাকে তো একটা কথা বলা হয় নি।
.
আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে শোনার জন্য অপেক্ষা করি। ও মাথাটা নিচু করে বলতে লাগলো...
.
"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সাদমান দেশের বাহিরে। আগামী ইয়ারে আসবে। ওখানে পড়াশেষ করে এসে ওর বাবার অফিসে বসবে। আমাদের বিয়ের কথা আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তবে কি জানো তুমি অনেক ভালো। আমার সবচেয়ে কাছের ভালো বন্ধু হয়ে থেকো কেমন? জানো তোমার কয়েকটা লেখা সাদমানকে শুনিয়েছিলাম। ও কি বলে জানো? বলে ফিউনা, তোমাকে কিন্তু তোমার এই বন্ধুটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে। প্লিজ আমাকে নিসঙ্গ করো না মহারানী।
.
এইটা বলেই ফিউনা হাসতে থাকে। আমি চুপ করে চেয়ে থাকি। বুকের গভীরে অতল ঢেউ এর যুদ্ধ চলে। প্রানহীন জীবনে আমার তেমন চাহিদা ছিল না। ছিল একটু ভালোবাসা পাওয়ার আশংকা। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার অন্ধকার জীবনের স্মৃতির কথা। এক মুঠো আলো না পাওয়ার কথা। আমি ভুলে গিয়েছিলাম না বলা অব্যক্ত কান্না গুলোর প্রত্যেকটি ব্যাথা। ভিতরটা মুচর দিয়ে উঠে। মামির কথাটা মনে পড়ে ... মরতে পারিস না হতচ্ছড়া। আমার চোখে বৃষ্টি আসে। আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টি।
.
"আরে কি হলো কি ভাবো তুমি? 
.
ফিউনার কথায় সজগে ফিরি। সেদিনের পর থেকে তবুও ওর জন্য আমি লিখি। ফিউনার ভালো লাগে। কেন যেন ওর ভালো লাগাতে আমার মাঝে প্রফুল্লতা ফিরে পায়। কি চমত্কার একটা মেয়ে। মনে মনে সাদমানের প্রতি ঈর্ষায়িত হই বেটা পূথিবীতে আর কোন মেয়ে ছিল না বুঝি? একটু নেড়ে চড়ে বললাম তেমন কিছু ভাবছি না। বাবার শরীরটা ভালো না। তাছাড়া নিতু, আমার মামাতো বোন বাড়িতে গিয়েছে। রোজা আসছে তো ওর কলেজ বন্ধ থাকবে। তাই একবার যেতে বলেছে।
.
পরিশিষ্ট
.
গরমে প্রায় ভিজে গিয়েছি। ইদানিং গরম পড়ছে বেশি। সকালে ফোন করেছে, জরুরি বাড়িতে যাওয়ার জন্য। বাবার বাড়ি। আমার বাবার বাড়িতে তেমন যাওয়া হয় না। তাও বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম বাবাকে দেখতে। গত ঈদে বাবাকে একটা পাঞ্জাবী কিনে নিজ হাতে পড়িয়ে দিয়েছিলাম। বাবা আমার দিকে চুপ করে তাকিয়েছিল আমার গালে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু আমায় চিনে নি। এবারো বাবাকে একটা পাঞ্জাবী দিব। আর একটা শাল দিব। টিউশনির টাকা থেকে বেশ কিছু টাকা আলাদা করে রেখেছি। দাদা দাদি , চাচা চাচীর আদর কি সেটাও আমার ধারনার বাহিরে। উনারা ভাবে আমিই এই সমস্ত পরিস্হিতির কারন। 
.
গ্রামে পা রাখতেই আমার কেমন অস্বস্তি লাখছে। লোকজন আমাকে কিভাবে যেন দেখছে। মনে হচ্ছে আমাকে কেউ দেখে নি। অবশ্য আমি তেমন আসিও না এখানে। বাড়ির গেট ভর্তি মানুষ। ভিতরে ডুকতেই আমাকে সবাই জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে যেন আমি কোন এমপি সবাই সরে যাচ্ছে। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। বাবার কিছু হয় নি তো। আরেকটু ভিতরের দিকে গিয়ে দেখি বাবাকে সাদা কাপড়ে শুইয়ে রেখেছে। বাবাও চোখ বন্ধ করে আছে। আমার কি করা উচিত্ আমি বুঝতে পারছি না। স্তব্দ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার বাবা কত শান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে। কতকাল ধরে আমার বাবা এই রকম শান্তিতে ঘুমাই নি। আমার চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে, আমি একটুও শব্দ করছি না। বাবা যে জেগে যাবে। হাটু গেড়ে বসে বাবার মাথার সামনে বসে কাপা কাপা হাতে বাবার গালে ছুয়ে দিলাম। আমার ভিতরটা শিহরিত হয়ে গেছে। বাবাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। একবার বলতে ছিয়েছিলাম আমাকে কি এখনো চিন্তে পারো নি? আমি তোমার ছেলে। 
.
জানাজা আর মাটি দিয়ে রাতের ট্রেনে নিতুদের বাসায় চলে আসি। আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে। আমার রাত কাটে না, দিন কাটে না, আমি ঘরের কোনে আবদ্ধ হয়ে জল ফেলি। আদনানের কথা মনে পড়ছে ও আমায় একবার বলেছিল দোস্ত আমার বুকটা যদি ছিড়ে দেখাতাম বুঝতি কি চলছে আমার বুকে। আমিও যে আদনানকে জড়িয়ে বলতে চাই.. আমার ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছেরে। সেই ছোট কাল থেকেই পুড়তেছে। দুইটা রাত অতিক্রম করে চলে যায়। এদিকে ফিউনা আমায় মেসেজ দিয়েছে সাদমান দেশে ফিরেছে ঈদের পরেই ওদের বিয়ে। আমার চোখে জল আসে না, এতো জল বয়ে গেছে এই চোখে সব যে শুকিয়ে গেছে। ছাদে যাই আকাশ দেখি। তারার দিকে তাকিয়ে বলি.. ওমা, কত করে বলি আমাকে নিয়ে যাও না, আমার কথা কি শুনতে পাও না। বাবাকে তো নিলে আমাকে নিবে না? ওখানে আমরা একসঙ্গে থাকবো। নিয়ে যাও না আমায়। আমার ভাল্লাগেনা সত্যি বলছি একটুও ভাল্লাগেনা।
.
বাসায় ঢুকেই দেখি মামি নিতুকে বলছে..
.
’ভাল করে খা মা, ওখানে কি খাস আর না খাস কে জানে। শোন ওখানেও ঠিক মত খাবি কিন্তু।
.
আমি কাশির শব্দ দিয়ে ভিতরে চলে আসি। নিতু দেখতে পায়। এসেই শরীরটাকে বিছানায় তলিয়ে দেই। কয়েক সেকেন্ডের পর দরজায় টোকা দিয়ে নিতু ভিতরে ঢুকে। হাতে খাবারের প্লেট। আমি উঠে বসি। ও আমার পাশে বসতে বসতে বললো..
.
”তোর অনেক কষ্ট নারে ভাইয়া?
.
আমি চুপ করে থাকি। ছোট বেলা থেকেই যেন চুপ করে থাকতে থাকতে আমাকে নিশ্চুপতা আকড়ে ধরেছে। নিতু আবার বললো..
” আমাকে একটু কষ্ট দিবি? তোর থেকে কিছুটা কষ্ট আমায় দিয়ে দে না। আমি একটু উপলব্দি করতে চাই কষ্টগুলো কেমন। দিবি?
.
আমি কি বলবো ভেবে পাই না। আমার মাথায় কিছু আসে না। নিতু ভাত গুলো মেখে বলবো..
.
”আমি তোকে খাইয়ে দি?
.
আমার চোখে পানি চলে আসে। আমার মনের ক্যানভাসে সমুদ্রের স্রোত উত্তাল হয়ে আছে। আমার কি বলা উচিৎ আমি বুঝি না। নিতু আমার কান্না দেখে প্লেট টা এক পাশে রেখে বাম হাতে আমার চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো.. এই গাধা কাঁদিস ক্যান? ছেলেরা কি কান্না করে? কাদঁবি না কিন্তু। আমি খাইয়ে দিব চুপচুপ খাবি। আমি বললাম.. জানিস নিতু আমাকে এমন করে কেউ বলে নি আগে। নিতু আমাকে খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। আর বলে যায়.. ভাইয়া ঘুমিয়ে পর। আমি কিছু বলি না। হ্যাঁ আমি নিদ্রা যাব। অনেক দিন যে ঠিক মত ঘুমাই নি। আমার অনুভূতি গুলো যে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আমার দেয়ালে কারো ছায়া নেই। আমার শহরে ভোরে কাক ডাকে না, যার শব্দে আমার নিদ্রার কোন ক্ষতি হবে। আমার নিদ্রার যে কোন অসুবিধা হবে না....
.
গল্প: অপূর্ণতা
.
লেখা... Jahedul Hoque Subon

Post a Comment

Previous Post Next Post