গল্পঃ এ উইজার্ড।লেখক : হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।পর্ব - ৭



মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে নীল নদ ধরে ১১০০ কিমি দক্ষিণে গেলেই আসওয়ান শহর।
আসওয়ান শহরে পা দিতে বেশ কয়েকঘন্টা বাসে কাটাতে হয় ফাহাদের।
শহরে পৌঁছেই বেশ অবাক হয় সে। এই কয়েক বছরে বেশ বদলে গিয়েছে প্রিয় শৈশবের আসওয়ান শহরটি।
শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে ফাহাদের বাসায় যেতে আরো ৪৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হবে। এ শহরটা মিশরের সবচেয়ে শুষ্ক এলাকা বলে বিবেচিত। আসওয়ানে বছরে মাত্র .০২ ইঞ্চি
বৃষ্টি হয় । হঠাৎ করে এমন আবহাওয়ায় এসে ফাহাদকে তাই ঘন পানি পান করতে হচ্ছে। সাথে করে বেশ কিছু টাকা পয়সাও নিয়ে এসেছে সে।যত দ্রুত সম্ভব একটা আবাসিক হোটেল ভাড়া নিয়ে উঠে পরতে হবে।
কায়রো আমাদের ঢাকার চেয়েও ব্যাস্ত শহর। কেউ কাউকে খুন করলেও আশেপাশের মানুষ ফিরে তাকায় না। নেহাত-ই যদি পুলিশের চোখে না পরে তবে সে অনায়াসেই পার পেয়ে যায়। তবে আসওয়ান মোটেই তেমন নয়। এখানের মানুষদের ব্যাস্ততা কম। কাজের চাপ কম থাকায় অন্য মানুষের ব্যাপারে এরা নাক গলানোর সময় পায় অনেক। তাই সতর্ক থাকতে হবে এখানে।
ফাহাদরা ভাড়া বাসা নিয়ে থাকত। বাসার মালিক তাদের জিনিসপত্র এখনো বাসায় রেখেছে নাকি বাইরে ফেলে দিয়েছে সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
তবে যেটাই হোক না কেন!! বাবা-মায়ের ঘরে একবার যেতেই হবে তার। সুবাতা কোন ক্লু হয়ত রেখে গিয়েছে ঘরটায়।
ঘুরেফিরে ফাহাদ মোটামুটি টাইপের একটা আবাসিক হোটেলে উঠে পরে।
পাক্কা ২০০ পাউন্ড ভাড়া এক দিন ও এক রাতের জন্য। টাকায় হিসেব করলে ১০০০ টাকা। মিশরীয় ১ পাউন্ড= ৫ টাকা।
হোটেল রুমটা বেশ ভালো ই। সফেদ-শুভ্র বিছানার চাদর,টি-টেবিলের উপর রাখা একটা কাঁচের ফুলদানীতে প্লাস্টিকের ফুল, টিভি দেখার সিস্টেম আছে,মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে ।
ফ্যানের বাতাস অনেক দিন পর গায়ে লাগছে ফাহাদের। তাতেও কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গরম ভাব আছে।
.
কাল পুরোনো বাবা মায়ের ঘরে যেতে হবে একবার, বাড়ির মালিক কি চিনবে তাকে? এসব ভাবতে ভাবতে ই ঘুমিয়ে পরে সে।
.
.
.
আসওয়ান শহর থেকে ১২০ কি.মি দূরে ইদফো নামক ছোট শহরে রয়েছে একটা বিখ্যাত গ্রাম।গ্রামটি বিখ্যাত হওয়ার পিছনে একটা কারণও রয়েছে। গ্রামজুড়ে শুধুই নারীদের বাস। এ গ্রামে অনুমতি নেই কোনো পুরুষ প্রবেশের। তিন শতাধিক নারী এবং শিশু বসবাস করেন সেখানে। কেউ কোনো পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চাইলে তাকে তৎক্ষণাৎ গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়। সরকার এখানে বসবাসরত নারীদের ঋণ এবং ভুখন্ড দিয়ে থাকেন কৃষিকাজের জন্য।সুবাতার গা ঢাকা দেওয়ার জন্য এমন একটা গ্রাম ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। সুবাতা সবার অগোচরেই সে গ্রামে বসবাস করতে শুরু করে। উমরের ভালোবাসা তার জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল, সুবাতা এখনো উমরের জন্য প্রতিদিন রাতেই কান্নাকাটি করে। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, রাতুলকে যেদিন সামনে পাবে, সেদিন ই উপরওয়ালার হেফাজতে পাঠিয়ে দিবে। সেটা যে করেই হোক।
.
.
.
পরদিন সকালে নিজেদের ভাড়া করা পুরোনো বাসায় পৌঁছায় ফাহাদ।বাসার গেটে মস্ত বড় একটা তালা ঝুলানো।
বাসার সামনে পৌঁছাতেই ফাহাদের হ্যালুসিনেশন শুরু হয়, চোখের সামনে সে দেখতে থাকে, বাসার সামনের ফাঁকা জায়গাটায় তিং মাং, উমর ও ৭/৮ বছরের ফাহাদ খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলা করছে। তিন জনের মুখেই হাসি। এটা দেখে ফাহাদের নিজের মুখেও হাসি ফুটে। কিন্তু একটু পর ই তারা তিনজন ফাহাদের চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যায়, তবে হাসির শব্দগুলো উধাও হয়না,ফাহাদের কানে বাজতে থাকে বারংবার।
বাড়ির মালিকের সাথে যোগাযোগ করে বাসায় প্রবেশ করবে কিনা, তা নিয়ে একটা দ্বিধাবোধ কাজ করতে থাকে তার।
পরক্ষনেই আবার সিদ্ধান্ত নেয়,
না,
বাড়ির মালিকের সাথে সে দেখা করবে না।
ফাহাদদের বাসাটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে ছিল। এ বাসাটার সব কোনা কানচি ফাহাদের পরিচিত। তালা না ভেংগেও শুধু কয়েকটা কাঁচ ভেংগে যে বাসার ভিতরে ঢোকা যাবে তা সে ভালো ভাবেই জানতো। বাসার ভিতরে প্রবেশের একটাই কারণ ছিল তার, সুবাতাকে খুঁজে পাওয়ার কোন ক্লু পাওয়া যায় কিনা!!
সবার অগোচরে দেয়াল ডিংগিয়ে ফাহাদ, বাসার এড়িয়ায় প্রবেশ করে। তারপর ধীরে সুস্থে বাসার পেছনের অংশে যায়। কিচেনের জানালায় শুধুমাত্র গ্লাস লাগানো ছিল, যার ভিতরের অংশে কোন প্রকার গ্রিল দেয়া ছিল না। অর্থাৎ গ্লাস ভাংলেই সোজা কিচেনে ঢোকা যাবে। কিন্তু গ্লাস ভাংগার শব্দ আসলেই সমস্যা। ধরা পরার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। কিন্তু ফাহাদ যেহেতু কাঁচা কাজ করে না, সেহেতু পূর্ব প্রস্তুতি সে আগে ই নিয়ে রেখেছিল। জানালার সম্পূর্ন কাঁচ কে সে স্কচটেপ দিয়ে ভালো ভাবে আবৃত করে। যাতে গ্লাস ভেংগে পরে ঝন ঝন শব্দ না আসে।এরপর সে একটা ইটের ভাংগা অংশ সংগ্রহ করে।সাথে করে নিয়ে আসা পাতলা টি শার্টের ভিতর ইটের অংশটা পুরে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নেয়। কাচের উপর সে টিশার্ট মোড়ানো ইট টা ঠেকিয়ে ভিতরের দিকে ধাক্কা দেয়।মচ মচ শব্দে খুবি আস্তে কয়েক জায়গা থেকে ফাঁটল ধরে। এভাবে কয়েকবার প্রেসার দেয়ার পর ই অনেকটা নি:শব্দে ভেংগে আলাদা হয়ে যায় কাঁচাগুল। কিন্তু স্কচটেপ লাগানো থাকায় অতিরিক্ত শব্দ ও হয়না এবং ভেংগে ফ্লোরেও পরে না।
সাবধানে নিজের গা বাঁচিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে।
ভিতরে ঢুকেই পূর্বপরিচিত সেই গন্ধটা নাকে লাগে তার। এটা তার বাসার স্মেল। একেকটা বাসায় আবার একেক রকমের স্মেল থাকে। এখন পুরোনো স্মৃতিপটে ঢোকার সুযোগ নেই তার কাছে,কাজে এসেছে সে,বলে ফাহদ নিজেকেই ধমক দেয়।
বাসার সব জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। ফাহাদ বুঝতে পারে আগেও বাসায় পুলিশ এসেছিল সার্চিং এর জন্য।সবকিছু বিছিয়ে রেখেছে চারদিকে।হতাশ হয় ফাহাদ। এখানে এখন হয়ত তেমন কিছু নেই, যা খুঁজলে কোন ক্লু পাওয়া যেতে পারে। হঠাৎ ফাহাদের চোখ যায়, বাসার ডেক্সটপ এর দিকে। এই পিসির সাথে তো ওয়াইফাই কানেক্ট করা আছে। খুশি হয় ফাহাদ। ডেক্সটপ ওপেন করতে গিয়ে ঝামেলা পোহাতে হয়না ফাহাদের। পাসওয়ার্ড সেই আগের টা ই আছে।কিন্তু আবার ও হতাশ হতে হয় তাকে। ডেক্সটপ থেকে হিস্ট্রি চেক করেও তেমন কোন তথ্য পাওয়া গেল না। অন্য কি কি উপায় আছে!! ভাবতে ভাবতে একসময় একটা পথ পেয়ে যায় সে। ওয়াইফাই রাউটার!! ইয়েস!! ওয়াইফাই রাউটারের পাসোয়ার্ড না জানলেও পুশ বটম ট্যাপ করে নিজের ল্যাপটপের সাথে ফাহাদ ওয়াইফাই কানেক্ট করে।কানেক্ট হওয়ার পর ওয়াইফাই এর এডমিন প্যানেল এ লগ ইন করে ফাহাদ। এডমিন প্যানেলে ইউজার নেম থাকে Admin এবং পাসওয়ার্ডও থাকে 1234 এট কমনভাবে সব রাউটারেই থাকে। যেহেতু ফাহাদের বাবা উমর কিংবা সুবাতা এত কিছু জানেনা, তাই চেঞ্জ ও করতে পারে নি।
এডমিন প্যানেলে লগ ইন করার পর কানক্টেড থাকা ৫ টি মোবাইল ও দুটি কম্পিউটারের আইপি এড্রেস পায় ফাহাদ।
৫ টি মোবাইলের ভিতরে নিশ্চয় ই রাতুল এবং সুবাতার মোবাইল রয়েছে।
কম্পিউটার দুটির একটি ফাহাদের ও একটি বাসার।
সুতরাং ঐ ৫ টি আইপি এড্রেস গুলো নিয়ে ঘাটলেই অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। আইপি এড্রেস গুলো নিয়ে ফাহাদ নিজের ল্যাপটপে বসে চেস্টা করতে থাকে ঐ ৫ টি ফোনের ব্রাউজিং হিস্ট্রি চেক করার।
ঘন্টার পর ঘন্টা চেস্টা করতে করতে একসময় সে সফল হয়।তবে শুধুমাত্র গুগলে সার্চ দেয়ার হিস্ট্রিগুলো ই বের করা যায়। বাকিগুলো প্রাইভেসি সিকিউরিটি ব্রেক করে বের করা সম্ভব হয়না ফাহাদের। কারণ সে কোন প্রফেশনাল হ্যাকার নয়।
তবুও যা পেরেছে তার জন্য ই মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে গুগল সার্চএর হিস্ট্রিগুলো চেক করা শুরু করে সে। প্রথম আইপি এড্রেসটি দেয়ার পর ই সে পায় উক্ত ফোন থেকে গুগলে বেশ কয়েকবার ইদফো নামের শহরটার সার্চ করা হয়েছে। প্রায় ১৭ ১৮ বার। পরবর্তী ফোন টার হিস্ট্রি চেক করে সে পায় গুগল এ সার্চ করা হয়েছে কিভাবে বন্ধ্যাত্ব দূর করা যায় সে সম্পর্কে, কিভাবে বাচ্চা ধারণের জন্য সক্ষম হওয়া যায় তা জানতে চেয়ে, ফাহাদ বুঝতে পারে এটা রাতুলের বউ এর ফোন। কারণ রাতুল এখন পর্যন্ত নি:সন্তান।পরবর্তী ফোনে সে পায় গুগলে সার্চ দেয়া হয়েছে facebook id of hasibul islam fahad লিখে, বাংলা এবং ইংরেজী দুভাবেই এ নাম লিখে কয়েকবার সার্চ করা হয়েছে। বুঝতে পারল ফাহাদ, এ ফোন টা তার বাবার, পরবর্তী আইপি এড্রেস ইনপুট করার পর ই ফাহাদ দেখল সেখানে পর্ণ ওয়েবসাইট এর লিংক সার্চ করা হয়েছে এবং কিভাবে যৌনমিলন দীর্ঘায়িত করা যায় সে সম্পর্কে সার্চ করা হয়েছে, ফাহাদ বুঝতে পারে এটা কুলাংগার রাতুলের মোবাইল, সুবাতার ও হতে পারে। শেষ আইপি এড্রেস সার্চ দিয়ে দেখে সেটায় ও ইদফো শহরের ম্যাপ সহ সেখানকার তথ্য জানতে চেয়ে সার্চ করা হয়েছে।
তার মানে সুবাতা বা রাতুল ইদফো লিখে সার্চ করেছিল। তবে ৫ম মোবাইল টা কার!! ফাহাদের মা তো এন্ড্রোয়েড-ই ইউস করত না।
যাই হোক ইদফোর সাথে সুবাতা কিংবা রাতুলের একট সংযোগ রয়েছে।
বেশ ভালো ই তথ্যা পাওয়া গিয়েছে। এবার বের হওয়ার সময়। বের হবার আগে প্রাণভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজের পরিচিত বাসাটার চারদিকে আবারও চোখ বুলাল ফাহাদ। কত যে মায়া জমে আছে প্রতিটা এ বাসআর প্রতিটা দেয়ালের ইটে!!
হঠাৎ নিচে ছড়ানো ছিটানো মেঝের দিকে চোখ যায় ফাহাদের। সেখানে ফাহাদের প্রিয় একটা জিনিস পরে আছে।
একটা ধুলোমাখা ফাস্ট এইড টুলকিট। অনেকটা আগ্রহ নিয়েই সে এগিয়ে যায় টুলকিটের কাছে। লক নম্বর গুলো জানা ছিল তার।তিনটা ০ দিতেই বক্স টা খুলে যায়। বক্সের ভিতরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য অনেকগুল টুলস রয়েছে। তবে একটা ব্যাপার তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।টুলকিটে থাকা সিরিঞ্জের প্যাকেটের ভিতর একটা প্যাকেট খালি। সেখানে কোন সিরিঞ্জ নেই। প্যাকের গায়ের উপর ডেট দেখে ফাহাদ। চার বছর আগেই ডেট ওভার হয়েছে। বোঝা যায় সর্বশেষ ব্যাবহার করা হয়েছিল চার বছর আগে।নইলে ডেট ওভার সিরিঞ্জ থাকত না টুল বক্সে। তিং মাং মারা যাওয়ার এক বছর পর ই সিরিঞ্জের ডেট ওভার হয়ে গিয়েছে। তার মানে এ টুলকিট আর ব্যাবহার ই করা হয়নি। হয়ত সর্বশেষ একটা সিরিঞ্জ ই বের করা হয়েছিল বক্স টা থেকে, ইঞ্জেকশন এর ছোট শিশি গুলো দেখে ফাহাদ। সবগুলো ইন্টেক করা। তবে খালি একটা সিরিঞ্জ বের করে কি করা হয়েছিল!
তিং মাং অসুস্থ ছিলেন না। হঠাৎ করে হার্ট এট্যাকের কারণ তবে কি ছিল??
দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে কষ্ট হয়না তার।
হাতের মুঠোয় টুলকিট থেকে স্কাপল টা বের করে সেটা চোখের সামনে তুলে ধরে ফাহাদ,
তারপর মনে মনে বলে..
.
- চমৎকার,
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।
.
.
.
ফাহাদ মোটামুটি শিওর হয়ে যায় তার মা অর্থাৎ তিং মাং কে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সেই সাথে তার ভিতর একটা ভুল ধারণার ও জন্ম নেয়। ফাহাদ ভাবে সুবাতাকে বিয়ে করার লোভে তার বাবা ই তিং মাং কে হত্যা করেছে হয়ত। বাবার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তিং মাং এর চেয়ে কাউকেই বেশি ভালো বাসত না ফাহাদ। যখন তার ভিতরে ভুল ধারণা ডুকে যায় যে নতুনত্বের লোভে তার বাবা তার মাকে খুন করতে পারে, তখন রাতুলের উপর অনেকাংশ রাগ কমে আসে ফাহাদের । সে ভাবে এমন একটা পরিণতির দরকার ই ছিল উমরের। তবে সুবাতা অবশ্যই দোষী। হয়ত মেয়েটার সাথে উমরের পরকীয়া ছিলো। এজন্য ই উমর তিং মাং কে সরিয়ে দিয়ে আরো বেশি সহজ করে নেয় পথ টা।
সুবাতাকে আপাতত খুঁজে বের করতে হবে। ৫ম ফোন টা কার ছিল সে হিসেব ও ফাহাদ সঠিক ভাবে মিলিয়ে ফেলে। সুবাতা বাসা থেকে পালানোর আগে তার পুরাতন ফোনটা সিমকার্ড সহ ফেলে যায়, যাতে পুলিশ তার ফোন নম্বর ট্রাক করতে না পারে। নতুন ফোন এবং সিমকার্ড কিনে সেটা নিয়েই বাসা থেকে পালায় সে। কিন্তু একটা জিনিস তার মনে খটকা লাগে, পালানোর সময় নিউ ফোন কিনে ই পালাতে পারত,কিন্তু নতুন ফোন কিনে বাসায় এসে ওয়াইফাই এর সাথে কানেক্ট করার উদ্দেশ্য কি ছিল। চিন্তাটাকে মাথার এক কোণায় সযত্নে রেখে দেয় সে। ছোট কোন ক্লু ও অবহেলা করার মত না।
যেহেতু দুটো ফোন থেকেই ইদফো শহরের ম্যাপ এবং বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হয়েছিল, সেহেতু সুবাতার গন্তব্য যে ইদফো শহর ছিলো দিকে তা বুঝতে অসুবিধে হয়না ফাহাদের।
আসওয়ান এ ইদফোর চেয়ে উন্নতমানের, নিম্নমানের এবং সম পর্যায়ের শহর ও রয়েছে। সুবাতার যদি ইচ্ছে থাকত পালিয়ে আপাতত যে কোন একটা শহরে যাওয়া, তবে ইদফোর পাশা পাশি অন্যান্য শহরের নাম লিখেও সার্চ দেয়ার কথা ছিলো তার।কিন্তু শুধুমাত্র ইদফোর নামে সার্চ করার মানেটা হচ্ছে কোন একটা অংশে ইদফো শহর অন্যান্য শহর থেকে আলাদা এবং ঐ আলাদা জিনিসটাই সুবাতাকে আকর্ষন করেছে।
ফাহাদ নিজেও শহরটার নাম লিখে রিসার্চ করে এবং চমকপ্রদ কিছু তথ্য পায়।
.
.
.
.
.
রাতুল এদিকে পালিয়ে এসে উঠেছে পরিচিত এক বন্ধুর বাসায়। ওর বন্ধু স্থানীয় একজন মিশরী,নাম শাফায়ত। এই শাফায়ত রাতুলের সব অপকর্মের ব্যাপারেই জানে শুধু কিন্তু তিং মাং কে খুন করার ব্যাপারটা ছাড়া। শাফায়ত নিজেও রাতুলের সাথে মিলে কয়েকবার মদ্যপান এবং সুবাতাকে নিয়ে নিষিদ্ধ আনন্দে মেতেছিলো। সেজন্য অবশ্য শাফায়তের কোন টাকা গুনতে হয়নি। রাতুলের পক্ষ থেকে সুবাতা ছিলো শাফায়তের জন্য উপঢৌকন স্বরূপ। রাতুল ওর সব কাজে সুবাতাকে অপব্যবহার করতো। বন্ধু থেকে শুরু করে অফিসের বস পর্যন্ত বাদ যায় নি। শেষমেস লকেট টা উদ্ধারের কাজেও সুবাতাকে ব্যাবহার করতে গিয়েই ঘটলো সব বিপত্তি।
সবকিছু শাফায়তের কাছে খুলে বলায় শাফায়ত রাতুলের প্রতি সদয় হয় এবং নিজের কাছে থাকতে বলে।
শাফায়তের ছিলো উটের খামার। রাতুল আপাতত সে উটের খামারে কাজ করে শাফায়তের ঋণ পরিশোধ করার চেস্টা করছে। কিন্তু রাতুলের এ জীবন আর পছন্দ হচ্ছে না। দাঁড়ি কামানো বন্ধ করে দিয়েছে রাতুল। চেহারায় অন্যরকম একটা লুকিং এনে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার প্লান করতে থাকে সে।
তবে শাফায়তের খামারে প্রচুর কাজ করতে হলেও রাতে মদের আড্ডা ভালো ই জমে ওদের। আর মাঝে মাঝে উটের দুধ বেশি বিক্রি হলে রাত পার করার জন্য নিতান্ত-ই সস্তা এবং বেশি বয়সী মহিলা ভাগ্যে জুটে।
তখন রাতুল তার বিলাসী জীবনের কথা মনে করে ভিতরে ভিতরে হাহাকার করতে থাকে।
কয়েকদিন এভাবে যেতে না যেতেই রাতুলের জীবনে আবার খারাপ দিন চলে আসে।
একদিন সকালে খামারের উটদের খাবার দিতে গিয়ে শাফায়তের বৃদ্ধ মা উটের গোবরের উপর পা পিছলে পরে যায় এবং মাথায় গুরুতর আঘাত পায়।মাথা ফেটে রক্তক্ষরণ শুরু হলে সেখানেই সে জ্ঞান হারায়।শাফায়ত বাজার থেকে ফিরে তার মাকে গোবর ও রক্ত মাখা অবস্থায় খামারে পরে থাকতে দেখে স্থানীয় একটা হাসপাতালে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যায়। সেখানের ডাক্তার রা তার মা কে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়, রক্ত বন্ধ করে মাথায় ব্যান্ডেজ করলেও ক্রমেই তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রিক হসপলিটালে ট্রান্সফার করার নির্দেশ দেয়। সেখান থেকেই এম্বুলেন্স ভাড়া করে জ্ঞানহীন মা কে নিয়ে রাজধানী কায়রোর গ্রিক হসপিটাল এর দিকে যাত্রা শুরু করে শাফায়ত। রাতুল কিছুতেই রাজী হয় নি যাওয়ার জন্য, শেষমেস বন্ধুর জোরাজুরির কারণে হুডিতে মাথা ঢেকে শাফায়তের সাথে রওনা দেয় মিশরের রাজধানী কায়রোর উদ্দেশ্যে। রাতুলের মনে অবশ্য অতটা ভয় ও ছিল না। ও এম্বুলেন্স এর ভিতরে বসা ছিল। সাথে রোগীর কাগজপত্রও ছিল। পুলিশ এসব এম্বুলেন্স চেক করে না বেশি।করলেও কাগজ দেখে ছেড়ে দেয়। তবুও চোরের মনে পুলিশ পুলিশ । রাতুল সব সময় ই একটু বেশি বেশি রিয়াক্ট করছিলো। গ্রিক হসপলিটাল এ পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এম্বুলেন্স এ ১০ ঘন্টার মত সময় লেগেছে তাদের। গ্রিক হসপিটাল এ পৌঁছতেই অক্সিজেন মাস্ক সহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শাফায়তের মা কে চেকাপ এর জন্য ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। চেকাপের পর ডাক্তার শাফায়তকে জানায় রোগী অচেতন অবস্থায় আছে। যত দ্রুত সম্ভব সার্জারী করতে হবে। নইলে কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ ভাগ। এবং অপারেশনের জন্য গুনে গুনে ১০ লাখ পাউন্ড খরচ করতে হবে।
কথাটা শোনা মাত্রই মাথায় আকাশ ভেংগে পরে শাফায়তের। ঘটি বাটি যা আছে সব কিছু বিক্রি করে দিলেও ৭/৮ লাখ পাউন্ডের বেশি হবে না তার কাছে। কিন্তু সেখানে ১০ লাখ পাউন্ড!! কিভাবে সম্ভব সংগ্রহ করা!!
এই পৃথিবীতে শাফায়তের মা ছাড়া আর কেউ ই নেই। সুতরাং যে কোন উপায়েই হোক না কেন বাঁচাতে হবে তার মা কে! ঘটি বাটি সব কিছু বিক্রি করে হলেও!
এ সিদ্ধান্ত রাতুলকে জানাতেই রাতুলের মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পরে। এমন যদি হয় তবে রাতুল এখন কোথায় আশ্রয় নিবে!! মিশরে রাতুল একজন প্রবাসী। শাফায়ত ছাড়া এদেশে তার বিশ্বস্ত কেউ ই নেই।
রাতুল উদ্বিগ্ন হয়ে শাফায়ত কে বলে অন্য কোন উপায় ভাবো!! যদি সাহায্যের প্রয়োজন হয়, আমি তোমাকে সাহায্য করব শাফায়ত!!
মুখে এ কথা বললেও, মনে মনে শাফায়তের মায়ের উপর ভীষন চটে যায় রাতুল!
' আমার সাথে এমন হলে আমি তো গলা টিপেই মেরে ফেলতাম। বুড়ো মানুষ আর কতদিন ই বা বাঁচত!!' আপন মনে ভাবতে থাকে সে।
অনেক্ষন চিন্তা করার পর শাফায়ত একটা উপায় বের করে।
চোখে অনেক আশা নিয়ে শাফায়ত বলে : " কায়রোতে আমার এক বন্ধু আছে, প্রচুর টাকা পয়সার মালিক!! ও চাইলে টাকাটা দিতে পারবে। কিন্তু ওকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওর মত মানুষ এত টাকা দিতে চাইবে না।
রাতুল: তাও একবার সাহায্য চেয়ে দেখা উচিৎ।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শাফায়ত রাতুলের কথায় সায় দেয়। শাফায়ত মানিব্যাগ থেকে একটা চিরকুট বের করে হাসপাতালের ফ্রন্ট ডেস্ক ম্যানেজারের কাছে দেয়। চিরকুটে একটা ঠিকানা লেখা। শাফায়ত ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে নেয় কিভাবে উক্ত ঠিকানায় পৌঁছানো যাবে।
দু ঘন্টা জার্নি করার পরে রাতুল ও শাফায়ত তার সেই বন্ধুর বাসায় পৌঁছে। নিজের পরিচয় দিয়ে আরো অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর ওরা ভিতরে ঢোকার অনুমতি পায়। শাফায়তের বন্ধু বহুবছর পর শাফায়তের দেখা পেয়ে যেন অনেকটাই উচ্ছাসিত হয়ে পরে। বন্ধু আব্দুল ফারাহ এর সাথে রাতুলকে ভিন্ন একটা নামে পরিচয় করিয়ে দেয় শাফায়ত।
দীর্ঘ অনেক্ষন আলাপ আআলোচনার পর রাতুল এবং শাফায়ত সবিনয়ে ফারাহ কে তার মায়ের দুর্ঘটনার কথা জানায়। ফারাহ খুব দু:খ প্রকাশ করে এবং রাতুল ও শাফায়তকে আশ্বস্ত করে, সে সাহায্য করবে।
শাফায়ত ফারাহ এর কথা শুনে প্রচন্ড পরিমাণ খুশি হয়। কথাও দেয় সুস্থ হওয়ার পর ও ওর মাকে নিয়ে প্রথমে ফারাহ এর সাথে দেখা করতে আসবে। ফারাহ শাফায়ত এর কথা শুনে মুচকি হাসি দেয়।
তারপর মুখের ভিতর পান দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলে, দেখো শাফায়ত , আমি তোমাকে এ উপকার টা করব। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।
শাফায়তের উচ্ছাসিত মুখ হঠাৎ ই অন্ধকার হয়ে আসে। সে ফারাহ কে জিজ্ঞেস করে, " কি শর্ত ফারাহ?"
পানের পিক ফেলে আমতা আমতা করে ফারাহ জবাব দেয়,তোমাদের আসওয়ানের দক্ষিন দিকে লেক নাসের আছে। চিনো তো?? শাফায়ত জবাব দেয়, হুম!! চিনি।
- বেশ!! লেক নাসের থেকে আরো দক্ষিণ-পশ্চিমে গেলে একটা জায়গা পাওয়া যাবে। জায়গাটার নাম বির তাওয়িল। ওখানটাকে বলা হয়, নো ম্যানস ল্যান্ড। খুব দুর্গম পথ। ম্যাপ দিয়ে দিব। ম্যাপ অনুযায়ী গেলে সেখানে একটা কটেজ দেখতে পাবে। ঐ কটেজে আমার কিছু জিনিস একটা গাড়ি দিয়ে ডেলিভারি দিয়ে দিবা। জিনিসগুলো খুলে দেখতে পারবে না, ভিতরে কি আছে,বক্স খুললে অপর পার্টি তা গ্রহণ করবে না। ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছে দিতে পারলেই টাকা গুলো পেয়ে যাবে।
শাফায়তের মুখ শুকিয়ে আসে। টানা দুদিন গাড়ি চালালে ওখানে পৌঁছানো যাবে। এদিকে মায়ের সার্জারী করতে হবে খুব দ্রুত। এমন কিছু একটা ঘটবে সেটা আগেই ধারণা করেছিল শাফায়ত। এই ফারহকে তো আর আজ থেকে চিনে না!!
রাতুল পাশ থেকে শাফায়ত কে আশ্বস্ত করে, " আমি ভালো গাড়ি চালাতে পারি। খুব জোরে চালাব। অর্ধেক সময়ে পৌঁছে যাব। চিন্তা করিস না। তুই রাজি হয়ে যা। ফারাহ ও হাসতে হাসতে বলে, তোমরা ওখানে ঠিক ভাবে পৌঁছে গেলেই আমাকে ওরা জানাবে। আমি দরকার হলে গিয়ে তোমার মায়ের হাসপাতালে টাকা দিয়ে আসলাম!!
শাফায়ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবেই রাজি হয়।এ ছাড়া আর কোনো উপায় ও যে নেই!!
.
. নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই। গাড়ি রেডি করতে বলে শাফায়ত। ফারাহ তার লোকদের একটা ফোন দেয়।
আধাঘণ্টার ভিতর তাদের জন্য একটা টয়োটা কম্পানির হাইব্রিড প্রাইভেট কার রেডি হয়ে যায়। পিছনের সিট গুলোতে কিছু কাঠের বক্স রাখা আছে। রাতুল হুডি মাথায় দিয়ে নিজের চেহারা যতটা সম্ভব আড়াল করে রওনা দেয় বির তাওয়িল এর উদ্দেশ্যে।
.
.
.
ডিনার সাথে নিয়ে রওনা দেয় দুজনেই।
টানা ৯ ঘন্টা দ্রুত গাড়ি চালানোর পরে তারা এসে পৌঁছে আসওয়ান শহরে। আসওয়ানে তখন সকাল হতে চলেছে। রাতুল নির্ঘুম গাড়ি চালাতে চালাতে অনেকটাই ক্লান্ত।
এখান থেকে লেক নাসের আরো তিন ঘন্টার পথ।
কিন্তু রাস্তা দুর্গম।
রাতুল চোখে প্রচন্ড ঘুম নিয়েও সাবধানে গাড়ি চালাতে চালাতে উপস্থতি হয় লেক নাসের এ।
সেখান থেকে শুরু দক্ষিন পশ্চিম এ ধু ধু মরুভূমি। তার একদম শেষ মাথায় বির তাওয়িল। রাতুল ও শাফায়ত গাড়ি থেকে নেমে লেক নাসেরের একদম শেষ পেট্রোল পাম্প থেকে, যাওয়া এবং আসার মত পেট্রোল লোড করে নেয়।
এরপর কিছুদূর এগোতেই তাদের চোখে পরে একটা পুলিশ স্টেশন।
হঠাৎ করেই সামনে পুলিশ স্টেশন পরে যাবে কল্পনাও করতে পারে নি রাতুল।গাড়িতে ব্রেক করে সে। গাড়ি ইউ টার্ন মেরে ঘুরাতে যাবে, এমন সময় দুজন পুলিশ এসে তারা কোথাত যাচ্ছে জানতে চায়।
শাফায়ত নরমালি জবাব দেয় ডেসার্ট এর ভিতরে ঘুরতে যাচ্ছে তারা। সন্ধ্যার আগেই এসে পরবে। একজন পুলিশ পিছনের সিটের বক্স গুলো দেখে বক্সে কি আছে, তা জানতে চায়। ভাগ্য হয়ত সহায় ছিলো। একজন বড় মোচ ওয়ালা পুলিশ অন্য দুজন কে ডাক দিয়ে বলে, একটা এমার্জেন্সি ফোন এসেছে, ফোর্স রেডী করতে, তাদের এক্ষুনি লেক নাসের এ যেতে হবে।
পুলিশ দুজন রাতুলদের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে " ইয়েস স্যার" বলে চলে যায়। রাতুল এ যাত্রায় বড় বাঁচা বেঁচে গেল। তার ভিতর যে ঘুম ঘুম ভাবটা ছিল তা একদম ই চলে গিয়েছে।
এরপর গাড়ি মমরুভূমির ভিতর ঢুকিয়ে দেয় তারা। বালির ভিতর কাঠফাটা রৌদ্রতেজ তাদের যেন নিষ্পেষিত করে দিচ্ছিল। পানি খেতে খেতে আরো দু ঘন্টা গাড়ি চালায় রাতুল। বোতলের পানি সব শেষ। সাদা হাইব্রিড টয়োটা এখন নষ্ট হয়ে গেলে এখানেই মরে পরে থাকতে হবে তাদের। মাথায় কাজ করছে না রাতুলের। মরুভূমিতে গাড়ি চালানো তেমন কঠিন না।চারদিকেই ফাঁকা। রাতুল শাফায়ত কে গাড়ির সিটে বসিয়ে দেয়। শাফায়তের গাড়ি চালানোর অভ্যেস নেই। কিন্তু ড্রাইভ করতে পারে। শাফায়ত গাড়ি চালাতে থাকে।
একটা সময় আর ম্যাপ দেখার প্রয়োজন পরে না শাফায়াতের। অন্য একটা গাড়ির চাকার ছাপ অনেক্ষন ধরেই তাদের ম্যাপের সাথে মিলে যাচ্ছিল।শাফায়াতের সিক্সথ সেন্স এর ধারণা বলছিল ঐ চাকার দাগ ফলো করলেই হবে।
আরো কয়েকঘন্টা গাড়ি চালানোর পর সন্ধ্যা নাগাদ শাফায়ত গন্তব্যে এসে পৌঁছে। একটা সুসজ্জিত দোতলা বিল্ডিং বাড়ি। চারদিকে ক্যাকটাস গাছ। বাড়ির পাশেই সুগভীর একটা কূপ। শাফায়ত গাড়ি থামিয়ে কূপের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু সেখান থেকে পানি উঠানোর কোন ব্যাবস্থা পায় না সে। এমন সময় একটা মেয়ে কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে তাদের কানে। " আপনাদের কি ফারাহ পাঠিয়েছে?? " সেদিকে ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় একটা মেয়ে ও বৃদ্ধলোক যেন তাদের পথ চেয়েই দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। রাতুলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে শাফায়ত। বক্সগুলো নামিয়ে তাদের বাসার সামনে রাখে। বৃদ্ধ লোকটি ফারাহ কে ফোন দিয়ে বলে, বক্স পেয়ে গিয়েছি। ফারাহ শাফায়তকে ধন্যবাদ জানায় এবং বলে তোমার মায়ের বন্দোবস্ত আমি করে ফেলছি একটু পরেই। চিন্তা করো না।
রাতুল ও শাফায়ত গাড়িতে ফেরৎ যেতে চাইলেই বৃদ্ধ এবং মেয়েটি ওদের অনুরোধ করে আজ রাত টা ওদের সাথে কাটিয়ে যেতে।
দুজনেই বেশ ক্লান্ত ছিলো।
বিশেষ করে শাফায়ত। ও এতক্ষন একটু ও ঘুমায় নি। মায়ের চিন্তায় ঘুম আসে নি চোখে।কিন্তু রাতুল ৪/৫ ঘন্টা ঘুমিয়ে নিয়েছে। তবে দুজনের পেটেই ছিল ভয়ানক ক্ষুধা। সাথে করে নিয়ে আসা খাবার থাকলেও, পানি ছিল না। তাই ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও খেতেও পারে নি এতক্ষন। দুবার চিন্তা না করে তারা বাড়িটায় থেকে যেতে রাজি হয়। ঐদিকে শাফায়তের মায়ের বন্দোবস্ত তো হয়েই গিয়েছে চিন্তার কোন কারণ নেই। বাসার ভিতরে ঢুকে খুব সাধারণ মানের রুটি এবং শুকনা গোশত দেখে খেতে অনীহা প্রকাশ করে রাতুল ও শাফায়ত। তাদের সাথে আনা খাবার খায় এবং বৃদ্ধ ও মেয়েটাকেও আমন্ত্রন জানায়। কৃতজ্ঞতামূলক হাসি দিয়ে তারা ধন্যবাদ জানায় রাতুল এবং শাফায়ত কে।তারা বাইরের খাবার খায় না। কথা বলে রাতুল জানতে পারে বৃদ্ধ লোকটা মেয়েটার শ্বশুর। তার দুই ছেলে শহরে কাজ করে।বড় ছেলে বিবাহিত। টাকা পয়সার সমস্যার কারণেই তারা এখানে বসবাস করে। বক্স গুলোতে কি আছে তা তারা জানেনা। আগামীকাল বা তার পরদিন এই বক্স গুলো অন্য লোক এসে আবার নিয়ে যাবে।
.
.
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মেয়ে ও বৃদ্ধ লোক টি শাফায়ত ও রাতুল কে ঘুমানোর জন্য জায়গা দেখিয়ে দেয়। শাফায়ত কোন রকম গিয়েই গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পরে। কিন্তু রাতুল আগেই ঘুমিয়ে নেয়ায় ও আর ঘুমায় না।
মনে মনে ভাবতে থাকে এই আধামরা বুড়োর ঘরে কত রূপবতী একটা মেয়ে, চাইলেই ও আর শাফায়ত বুড়োকে বেঁধে মেয়েটার সাথে ফূর্তী করতে পারে। আশেপাশে কোন লোক জন ও নেই। মেয়েটির চিৎকার কোন কাজে তো আসবেই না বরং একটা বিকৃত আনন্দ জোগাবে।
ভাবতে ভাবতে ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে পরে রাতুল। কিভাবে কি করবে তা চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে থাকে সে। অপেক্ষা করতে থাকে কখন শাফায়ত একটু ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করে নিবে,নিজের অজান্তেই রাতুল ও একসময় ঘুমিয়ে পরে।
তবে তার ঘুমটা একটু পরেই ভেংগে যায় কিছু অদ্ভুত শব্দে। চোখ খুলে তাকায় সে। রুমে টিম টিমে একটা ল্যাম্প জ্বলছে। তবে পাশে শাফায়ত নেই।শেষ পর্যায়ে শাফায়ত ও বেঈমানি করলো!! একাই হয়ত চলে গিয়েছে মেয়েটাকে উপভোগ করতে। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রাগ হয় রাতুল!! ওর জন্য রাতুল কত কষ্ট ই না করেছে আর ও শেষমেস রাতুলকে না জানিয়েই.....
নাহ, দেখা দরকার ও কি করছে। পা টিপে টিপে এ ঘর ও ঘর খুঁজে রাতুল হাজির হয় বাড়ির পিছনের দিকে। সেখানে যা দেখে, তা দেখে রাতুলের গায়ের প্রতিটা লোম দাঁড়িয়ে যায়, পেট্রল পাম্প থেকে যে ছেলেটার কাছ থেকে গাড়ির জন্য জ্বালানি কিনেছিল সে ছেলেটা, বৃদ্ধ লোকটা আর মেয়েটা মিলে শাফায়তের দেহ টুকরা টুকরা করে কাটছে।মাথাটা তাদের পাশেই রাখা। অক্ষত। যেন রাতুলের দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃশ্যটা দেখা মাত্রই রাতুল দৌঁড়ে বাসার সামনের দিকে চলে আসে এবং বাসা থেকে বের হয়ে যায়। গিয়ে দেখে বাসার সামনে আরো একটা গাড়ি। রাতুল ও শাফায়ত যে গাড়িতে এসেছিলো সে গাড়িতে উঠে রাতুল গাড়ি স্টার্ট দেয়ার চেস্টা করে। কিন্তু গাড়ি আর স্টার্ট নেয় না। বুঝতে পারে সে ফেঁসে গিয়েছে। তাহলে ওরা যে বক্স এনেছিল তাতে কি আছে!! বক্স গুল বাসার সামনেই পরেছিল। একটা বক্সের মুখ টেনে খুলে ফেলে রাতুল! কিন্তু দেখে সেই বক্সের ভিতর শুধু তুলো। আরো কয়েকটা বক্স খোলার পর সেখানেও শুধু তুলো দেখতে পেয়ে রাতুল শিওর হয়, এসব বক্সের কাহিনী সব সাজানো, আসোলে ওদের জন্য একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল।আর ও এখন সেই ফাঁদে ফেঁসে গিয়েছে। কি করতে হবে তা বুঝতে না পেরে রাতুল ঝেড়ে দৌড় মারে, কিছুদুর যাওয়ার পর ই সে দেখতে পায় একটা পুলিশের গাড়ি সাউন্ড করতে করতে এ বাড়ির দিকেই আসছে। কোন রকম দৌড়ে সে গাড়িটার সামনে চলে যায়। গিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে থামানোর জন্য সংকেত দেয়। গাড়ি ব্রেক করে একজন পুলিশ অফিসার বেড়িয়ে আসে। বিকেলবেলা দেখা সেই মোঁচ ওয়ালা লোক টা। সন্ধ্যায় ফেরার কথা থাকলেও এখনো ফেরেনি দেখে খুঁজতে এসেছে তাদের। মিশরের পুলিশ কত সেন্সিয়ার ভেবেই রাতুলের চোখে কৃতজ্ঞতার পানি চলে আসল। হাপাতে হাপাতে রাতুল ঐ ঘরের ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলল অফিসারটি কে। পুলিশ অফিসার তার সাথে থাকা গানটি লোড করে রাতুলকে বলল কোথায় দেখেছে ও এমন ঘর, সেখানে নিয়ে চলতে।
.
.
।রাতুল অফিসারটিকে পথ দেখিয়ে বাড়িটায় নিয়ে আসে। এবং দুজনেই চুপিসারে বাড়ির পিছনের দিকে যায়। গিয়ে দেখতে পায় তখনো তারা কাজে ব্যাস্ত। শাফায়তের মুন্ডীটা পরে আছে পাশেই।
সাথে সাথে পুলিশ অফিসারটি তাদের মাঝে উদ্দেশ্যে বলে!! ধরা পরে গেলে??
তোমরা কি কর না কি না কর তা সব ফাঁস হয়ে গেলো!! এই ছোকড়া সব দেখে নিলো!!
বলেই রাতুলের পা বরাবর গুলি চালায় অফিসারটি।
রাতুল পা ধরে মাটিতে লুটিয়ে পরে।
" পাক্কা ৮ লাখ টাকা দিতে হয়েছে ফারাহ কে।এই একটা তো পালিয়েই গিয়েছিল প্রায়!! কাণ্ডজ্ঞান নেই নাকি তোমাদের??" পুলিশ অফিসারটি বাকি কজন কে ধমকাতে থাকে।
ওকে বেঁধে রেখে আয় এটাকে খাওয়া শেষ করে ওটাকে খাব। ততদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
অন্য ছেলেটা ও মেয়েটা উঠে গিয়ে রাতুলকে বেঁধে রেখে আসে একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার কামড়ায়।রাতুল জানে, এখানে চিৎকার করেও কোন লাভ নেই। পায়ে যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকে সে।
.
.
.
.
রাতুল অনুমান করতে পারে এখন মাঝরাত।
পাশের রুমেই হাসি ঠাট্টা চলছে।
মাংস রান্নার ঘ্রাণ টা আসছে বেশ করা ভাবেই। পেটের ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে। কিন্তু রাতুল জানে যে মাংস রান্না হয়েছে তা রাতুলের বন্ধু শাফায়তের -ই।
ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে রাতুল!! এ যন্ত্রনার চেয়ে যেন মারা যাওয়াও অনেক ভাল।
হঠাৎ আস্তে আস্তে ক্যাচ ক্যাচ করে রাতুলের রুমের দরজাটা খুলে যায়।
রাতুল সেদিকে তাকাতেই দেখতে পাশাপাশি দুটো নীল রঙ এর লাইট জ্বলছে।
চোখ বুজে আবার ভালো করে তাকায় সে। এবার বুঝতে পারে, ও দুটো লাইট না। কারো নীল রঙ এর চোখ।
.
.
.
.
চলবে..
গল্পঃ এ উইজার্ড
পর্ব - ৭
লেখক : হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।

Post a Comment

Previous Post Next Post