গল্পঃ এ উইজার্ড ,পর্ব -৬। লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।


গল্পঃ এ উইজার্ড ,পর্ব -৬। 
লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।
দালালদের কাতারে আজ একটা নতুন লোক এসে দাঁড়ায়, লোকটার জামার উপরে সাদা এপ্রোন পরা, মুখ অপারেশনের সময় ডাক্তাররা যেমন মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখেন তেমনি ভাবেই ঢাকা, হাতে সাদা গ্লাভস, চোখের উপর দিয়ে চুল নেমে এসে পরেছে নাক পর্যন্ত। হাতে ফাস্ট এইড কিট।
এসেই চুপচাপ বসে পরে একটা চেয়ারে।
যে কেউ দেখলেই তাকে ডাক্তার বলে ভুল করে ফেলতে পারে।
সেদিন তেমন কেউ ই আসে না নতুন কন্ট্রাক্ট নিয়ে। অনেক ডেথ-ব্রোকার-ই মদ খেতে খেতে নিজেদের খেই হারিয়ে ফেলেছে। এমন সময় একটা কালো শার্ট পরিহিত লোক প্রবেশ করে সেখানে। এসেই অনুসন্ধানী চোখে সবার দিকে তাকায়। এক কোনে রোবটের মত ফাস্ট এইড কিট দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই।
দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে হয়ত পরিচিত কাউকে খুঁজছে। কিন্তু ভীড়ের মাঝে পরিচিত কাউকে না পেয়ে সে আশেপাশের লোকদের কাছে খোঁজ করতে থাকে।তবে মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কেউ ই তাকে সঠিক উত্তর দিতে পারে না।
এবার তার চোখ যায় সেই ছেলেটির দিকে। কি মনে করে যেন তার এগিয়ে যায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, এই ছোকরা!! শোরেন্স কে দেখেছো!!
.
ডেথ-ব্রোকার দের ভিতর শোরেন্স হচ্ছে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নেয়া একজন।আইভানহোর বিশ্বস্ত দালাল। ফাহাদ খুব ভালোভাবেই তাকে চিনত।
সে একটু ভেবে উত্তর দেয়,
- আপনি যদি কাউকে খুন করানোর জন্য এখানে এসে থাকেন, তবে আপনি সঠিক মানুষটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।
- ছোকরা! এখানের সবাই ই ব্রোকার। তবে আমি আইভানহোকে ই চাই।
.
- বেশ! তবে শুনে রাখুন, আইভানহো আপনার জন্য বেশি দুর্লভ এবং খরচবহুল। আমি যার হয়ে কাজ করি, তার পারিশ্রমিক কম।
.
- তুমি আমাকে চিনো? আইভানহোর মত কয়েকটা খুনীকে ভাড়া করার মত টাকা পয়সা আমার আছে।
কিন্তু তুমি কার হয়ে কাজ করো?
.
- "রিভার্স ডক্টর" এর হয়ে কাজ করি।
.
- আজকাল ডাক্তার রাও এ পেশায় নেমেছে?
.
- আপনি কাজ করাতে চাইলে পে-মেন্ট এর অর্ধেক পাউন্ড আগেই পে করতে হবে।
.
- সময় নষ্ট করলে তুমি আমার।
বলেই লোকটা ভিড়ের মাঝে ঢুকে যায়।
ফাহাদ নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনভাবে প্রথম একটা সাকসেসফুল ডিল হলে, সেই টাকায় সে একটা স্নাইপার কিনবে। ভাবতে থাকে সে।ফাহাদ হঠাৎ দেখতে পায় দরজা দিয়ে হেলতে দুলতে ভিতরে ঢুকছে শোরেন্স।
এই শালা শোরেন্স এর দেখা ঐ ভদ্রলোক পেয়ে গেলে এই কন্ট্রাক্ট টাও আইভানহোর দখলে যাবে। কিছু একটা তো করার দরকার।
ফাহাদ বাম দিক থেকে সরে বারটেন্ডারের ডেস্কের সামনে চলে যায়।বারটেন্ডার হাসিমুখে ওর দিকে তাকাতেই ও দু গ্লাস শেম্পেইন অর্ডার করল। যথাসময়ে ড্রিংকস চলে আসল। নিজে ঢক ঢক করে এক গ্লাস খেয়ে নিয়ে অন্য গ্লাসটা একটা অল্পবয়সী মেয়ে ওয়েটার কে দিয়ে আংগুলের ইশারায় শোরেন্স কে দেখিয়ে ইংলিশে বলল, There's a black nigga guy.. you see him??
- yes, majesty.
- go and give that motherfucker the glass.. tell him that's a gift.
বারে সবাই এভাবেই কথা বলে, ফাহাদ শ্যাম্পেইন এর গ্লাসে সবার অগোচরে একটা ড্রপিন মিশিয়ে দিয়েছিল। ড্রপিন ঔষধ টা তৈরি করা হয়েছে ৫০ গ্রাম ড্রোপেরিডল ও ২৫০ গ্রাম ইউটোরপিন এর মিশ্রন দিয়ে। এটা মূলত বন্য জীব জানোয়ারকে অপারেশনের সময় শান্ত রাখতে প্রানীচিকিৎসকরা ব্যাবহার করে থাকেন।
মেয়েটি শোরেন্স এর সামনে শ্যাম্পেন এর গ্লাস নিয়ে রাখতেই শোরেন্স বলে উঠে, আই ডোন্ট অর্ডারড ফর শ্যাম্পেইন।
মেয়েটি হেসে উত্তর দেয়, ইটস এ গিফট।
- হু সেন্ড ইট?
- মে বি ইউর ফ্রেন্ড।
শোরেন্স মেয়েটির পিছনের নিতম্বে হালকা একটা চাপ দিয়ে বলে, থ্যাংক ইউ ইয়ং লেডী।
মেয়েটি চলে যায়। শোরেন্স ভাবে হয়ত মেয়েটি ভুল করে ওকে অন্য কারো গ্লাস দিয়ে গিয়েছে। সাত পাচ না ভেবে সে ঢক ঢক করে এক নিশ্বাস এ সবটুকু শেষ করে ফেলে।
ব্যাস, তারপর আর কি!নিউরোলেপ্টিক এর প্রভাবে নেতিয়ে পরে সে।তবে অজ্ঞান হয়নি। ড্রপিনে অজ্ঞান করার মত কোন উপাদান নেই।
ফাহাদ তার নিজস্ব রূপে নিজের স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। বেশ অনেক্ষন পর সেই লোকটি বারের ভিতরের ভিড় থেকে আবার বামপাশে আসে। এসেই শোরেন্স কে দেখতে পায়, তার সাথে কথা বলার চেস্টা করে। কিন্তু শোরেন্স ছিল অনড়। সে সব কিছু দেখতে বা শুনতে পারলেও কথা বলার বিন্দুমাত্র শক্তি কিংবা সক্ষমতা তার ছিল না।
.
.
.
কিছুক্ষন ডাকাডাকির পরে লোকটা নিরাশ হয়ে ফাহাদের কাছে ফিরে আসে।
এসে টাক মাথাটা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
সামনের দু দিনের ভিতরে একজনকে খুন করে দিতে হবে।
তোমার ওস্তাদ কি পারবে?? পারলে মোটা অংকের টাকা দিব। একদম নগদ ১০ লাখ পাউন্ড। তবে এডভান্স করতে পারব না। কাজ হলে, তারপর টাকা।
মেজাজ খারাপ হলো ফাহাদের। কাজ হয়ে গেলে যে পরে আর টাকা পাওয়া যায় না, তা নিকোলাসকে খুন করেই বুঝতে পেরেছে সে।
আইভানহোর কাছে গেলে ঠিকই ৮ লাখ টাকা এডভান্স করতে হতো।
তবুও মাথা ঠান্ডা রাখে সে। ৫০ হাজার পাউন্ড ও ফাহাদের জন্য এখন অনেক বেশি। তবে আইভানহো প্রফেশনাল। ওর নামে টাকা জালিয়াতি করার কোন রেকর্ড নেই। সুতরাং আইভানহোকে পুরো টাকাটা নিশ্চিন্তে এডভান্স করলেও ফাহাদকে ১০০ পাউন্ড দিতেও যে কারো গায়ে লাগবে। ডিল করতে হবে ঝুঁকি নিয়েই।
অবশেষে তাদের মাঝে চুক্তি হয়,
কাজ শেষ হওয়ার পরদিন ই ঠিক এই সময়ে এসে ১০ লাখ পাউন্ড দিয়ে যাবে লোকটি।
ফাহাদ মনে মনে বিরক্ত থাকলেও রাজি হয়,অনিশ্চিত সুযোগগুলিও কখনো হাতছাড়া করতে নেই। কাজের সুবিধার্থে লোকটার সাথে অনেক্ষন কথা বলে বিভিন্ন প্রশ্ন করে টার্গেটের ডেটিলস জেনে নেয় সে।
.
.
.
.
রাত প্রায় ১১ টার দিকে রাস্তা দিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে হেঁটে যাচ্ছিল রবিন। হঠাৎ সে শুনতে পায় কাছ থেকেই কেউ একজন যেন তাকে ডাকছে,
এরকম হঠাৎ অপরিচিত কন্ঠে ডাক শুনে খুব অবাক হয় সে। রাস্তার আশেপাশে চোখ বুলায় রবিন। হঠাৎ মেইন রাস্তার পাশ দিয়ে বাড়িঘরের ভিতরের দিকে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা একটা গলির মুখে কালো একটা ছায়ামূর্তি চোখে পরে তার। শব্দটা সে ই যে করছে তা খুব ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। পরিচিত কেউ হতে পারে ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় রবিন।
পরদিন কায়রোর পুলিশরা একটা ডাম্প-ইয়ার্ডের সামনে থেকে রবিনের লাশ উদ্ধার করে।
লাশটা অক্ষত ছিল কিন্তু পেট অনেক উঁচু হয়ে আছে। পুলিশ কর্মকর্তারা
তাৎক্ষণিক ভাবে লাশ আইডেন্টিফিকেশন করে ফেলে রবিনের পকেটে থাকা পাসপোর্ট দেখে।এর পর দ্রুতই লাশটাকে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এর জন্য পাঠায় তারা।রিপোর্ট আসে রবিন এলকোহলিক ছিল।এবং ওর পাকস্থালী তে প্রচুর পরিমানে পানি পাওয়া গিয়েছে।ইনফ্যাক্ট অতিরিক্ত পানি পানের ফলে লিভার ফেটে গিয়ে রবিন মারা গিয়েছে। লাশের গায়ে কোন প্রকার আঘাতের চিহ্ন নেই।
মার্ডার নাকি এক্সিডেন্ট, একপ্রকার হেজিটেশনের ভিতরে পরে পুলিশরা। তবে এই কেসের সুরাহা করার মত কোন সূত্র খুঁজে পায় না তারা।
পরদিন একই ড্রেসে বারের ভিতর দাঁড়িয়ে ফাহাদ অপেক্ষা করতে থাকে সেই ভদ্রলোকের জন্য। ফাহাদের কেন যেন মনে হচ্ছিল সেই ভদ্রলোক টাকা নিয়ে আসবে। অন্তত তার খুশি হয়েই টাকা নিয়ে চলে আসার কথা। যেহেতু পুলিশি কোন ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে না।
কিন্তু না, লোকটি সেদিন আসে নি।
তার পর কয়েকদিন পার হয়ে গেলেও লোকটি আসে নি আর।
এর ভিতরে নতুন কোন কন্ট্রাক্ট ও পায় নি ফাহাদ। এক প্রকার নিরাশ হয়ে পরে সে।
বারের কোনায় দাঁড়িয়েই নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে থাকে, এ পেশা ছেড়ে কি করা যায়!!
হঠাৎ এমন সময় কালো একটা ব্রিফকেস নিয়ে বারে প্রবেশ করে লোকটি। একপ্রকার ছুটেই চলে আসে কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা ফাহাদের দিকে।
এসেই প্রথমে ক্ষমা প্রার্থনা করে দেরী হয়ে যাওয়ার জন্য।
এরপর ব্রিফকেস বের করে নগদ টাকা গুলো ফাহাদের সামনে প্রদর্শন করে।টাকা দেখে ফাহাদ নিজে মনে মনে খুশি হয় কিন্তু বাইরে সে খুশি প্রকাশ করে নি।
লোকটি ব্রিফকেস ফাহাদের হাতে দিয়ে বলে, তোমার ওস্তাদ তো বাজিমাৎ করেছে। পুলিশ এটাকে আদৌ খুন ই ভাবে নি। আমার আরো একজন লোক কে এভাবে সরিয়ে দিতে হবে। যেন কেউ টের ই না পায় যে ওনাকে খুন করা হয়েছে। কাজ টা করতে পারলে আমি ২০ লাখ পাউন্ড দিব। তবে সাবধান, উনি খুন হয়েছে এটা পুলিশ জানতে পারলে আমার অনেক বড় ক্ষতি হবে। ব্রিফকেস এ টোটাল ১৫ লাখ পাউন্ড আছে। তোমার ওস্তাদের জন্য এডভান্স কিছু টাকা। কাজ হওয়ার পর বাকি টা দিয়ে দিব।
ফাহাদ মনে মনে হাসে, ভাবে তার কোন ওস্তাদ নেই। সে ই সব। লোকটা একটা ফাইল হাতে তুলে দেয় ফাহাদের। টার্গেটের ছবি ও সব তথ্য আছে ওটায়।
ব্রিফকেস ও ফাইলটা কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নেয় সে। এতগুলো টাকা কখনো একসাথে চোখেও দেখে নি ফাহাদ।
এতগুলো টাকা দিয়ে কি করবে সে!! ভাবতে ভাবতে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে।
.
.
.
এদিকে রাতুল তার নিজের এবং সুবাতার ছবি উমিরের অফিসের কাজে ব্যাবহৃত জিমেইল এড্রেস এ সেন্ড করে একটা ফেক একাউন্ট দিয়ে। তবে সেখানে অফিসের কাজে ব্যাবহৃত সকল কম্পিউটার রিং টপোলজি আজারে যুক্ত ছিল। যাতে কেউ পারসোনাল ভাবে কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে এবং কোন তথ্য আদান প্রদান করতে না পারে। সুতরাং ওখানে একজনের কম্পিউটারে যে জিমেইল আসত তা সবার কম্পিউটারে দেখা যেত। তবে অফিসের একজন অন্যজনের জিমেইল সাধারণত খুলে দেখত না। কারণ অফিসের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টারি ছাড়া ভিন্ন কিছু কখনোই আদান প্রদান করা হত না।
হঠাৎ করে মেইল আসায় উমর হাতের কাজ রেখে মেইল টা ওপেন করে। সেখানে একটা ভিডিও ও কিছু ফটোক্লিপ ছিল। উমর ভিডিওটাই প্রথমে ওপেন করে।
আশেপাশের সবাই যে যার মত কাজ করছিল। ওমর ভিডিও টা ওপেন করতেই সেখানে হঠাৎ অশ্লীল সব শব্দ এবং কথাবার্তা উচ্চ সাউন্ডে বেজে উঠে। সবাই অবাক হয়ে ওমরের দিকে তাকায়। ওমর নিজে খুব মারাত্মক একটা শক খায়, একেতো এমন একটা বাজে ভিডিও সবার মাঝে ফুল ভলিউমে প্লে হয়েছে, আর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে শকিং ব্যাপার এটা তার নিজের স্ত্রীর ভিডিও। তাও নিজের বন্ধুর সাথে। ভিডিওটা পস করে উমর চুপিসারে বসে থাকে চেয়ারে। হঠাৎ করে সে একই ধরণের সাউন্ড তার পাশে কাজ করতে থাকা একজনের পিসিতে শুনতে পায়। অফিসের প্রায় সবাই ই সুবাতাকে চিনত উমরের স্ত্রী হিসেবে। উমর টেবিলের ডেস্কের উপর মাথা গুঁজে ফেলে। একে একে এ টেবিল থেকে ঐ টেবিল সব জায়গায় একই ধরণের অশ্লীল শব্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে পুরো অফিস রুম। ওমর মাথা নুইয়ে চিন্তা করতে থাকে, ঠিক ৫ মিনিট পর তার পৃথিবী টা কেমন হবে!!
নিজের স্ত্রীর এহেন কর্মকান্ডে খুব মারাত্মক রকমের ধাক্কা খায় উমর। নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরে সে।মনে মনে ভাবতে থাকে আজ বাসায় গিয়েই এলোপাথাড়ি বেশ কিছু ঘুষি মারবে সোজা সুবাতার নাকমুখের উপরে।মারা যাওয়ার পর লাশ ফ্লোরে ফেলে টুকরা টুকরা করে ফেলার দৃশ্যটা সে মনে মনে কল্পনায় ভেবে নেয়।ওকে কেটেকুটে কুকুরকে না খাওয়ানো পর্যন্ত শান্তি নেই উমরের।
এত অশ্লীলতা! ছিহ: তাও আবার নিজের বন্ধুর সাথে!!সবচেয়ে বড় কথা রাতুলের শালি ছিল ও। না, না কিছুই কিছু মিলাতে পারছে না ফাহাদ।
অথচ উমরের বুকে মাথা রেখে এতদিন কত ভালোবাসার, ভালোলাগার কথা বলেছিলো সুবাতা। সব তাহলে মিথ্যে!!
প্রায়াত প্রথম স্ত্রী তিং মাং এর কথা মনে পরে সেদিন আবারো খুব কান্না পায় উমরের।ভালো জিনিস কেউ বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না, কেন যে এটা পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম বাস্তবতার ভিতর একটা !!ভেবে পায় না উমর।
উত্তেজিত না হয়ে বরং খুব ঠান্ডা মাথায় ই বাসার দিকে হাঁটতে থাকে সে। উত্তেজিত না হলেও গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলো উমর। কিভাবে সুবাতাকে কষ্ট দিয়ে খুন করবে তার ফন্দি আঁটতে থাকে মনে মনে।উমর সেসব দৃশ্য কল্পনায় ভাবতে ভাবতে অন্যরকম একটা প্রশান্তি অনুভব করে নিজের ভিতরে।হাঁটতে হাঁটতে একা একাই দৃশ্যগুলো ভাবছে আর প্রশান্তিতে মিটি মিটি হাসছে । উমর হঠাৎ করেই যেন তিং মাং এর কন্ঠে একটা বিকট চিৎকার শুনতে পায়- "উমওওর"। কল্পনার ঘোর মুহূর্তেই কেটে যায় তার।আশে পাশে তাকিয়ে তিং মাং কে খুঁজতে গিয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা ব্যাস্ত হাইওয়ের মাঝ রাস্তায়। তার দিকে একটা মালবাহী বড় লম্বা ট্রাক সাঁই সাঁই করে ছুটে আসছে।
.
.
গান শুনতে শুনতে ৮০ কিমি পার আওয়ার এ চালানো এক ট্রাক চালক হঠাৎই খেয়াল করে তার গতিপথে কে যেন একজন দাঁড়িয়ে আছে। এত কাছে যে এখন হার্ড ব্রেক করেও কোন লাভ নেই। এত স্পিডের ভারী ট্রাকটাকে হার্ডব্রেক করলে এটা গতিপথ পরিবর্তন করে আশেপাশের প্রাইভ কার সমেত অন্যান্য যানবাহনকে পিষে একট বড় দুর্ঘটনার সূচনা করবে। এতে করে ট্রাক চালকের নিজেরেও প্রাণহানীর সম্ভাবনা রয়েছে। কয়েকসেকেন্ড এর ভিতরে সবকিছু ভেবে নিয়েই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে অভিজ্ঞ ড্রাইভার। চোখ বুজে ট্রাকের স্পিডটা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। উমরের মাথাসহ উপরের অর্ধেক দেহ ট্রাকের সামনের অংশের সাথে সজোরে ধাক্কা খায়।মাঝ রাস্তায় ঘ্যাচ করে একটা শব্দ আসে।
ড্রাইভারের সামনে থাকা বড় কাঁচের উপর উমরের মাথার খুলির কিছু অংশ এবং থোকা থোকা ঘিলু ছিটকে এসে পরে। খুলি থেকে উমরের চোখ দুটো বের হয়ে বেশ কয়েকমিটার দূরে ছিটকে যায়। ট্রাক চালক গাড়ির নিয়ন্ত্রণ প্রায় হারিয়ে ফেললেও অভিজ্ঞতার জোরে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে ট্রাকের গতি স্লো করে অজ্ঞান হয়ে যায় নিজের সিটেই। এত বিভৎস দৃশ্য সে আগে কখনো দেখে নি। কয়েকমিনিটের মাথায় হাইওয়ে বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ আসে, এসে লাশের পরিচয় বের করে। অফিস এবং বাসায় খোজ নেয়। পরে "স্ত্রীর পরকীয়ায় আসক্তির কারনে আত্মহত্যা" বলে কেস ডিসমিসাল করে দেয়।
পরকীয়া অবৈধ হওয়ায় তাৎক্ষণিক ভাবে পুলিশ রাতুল এবং সুবাতাকে আটক করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু লাভ হয় না কিছুই। পুলিশ যতক্ষনে পৌঁছে ততক্ষনে দুজনেই পগার পার। কি করতে গিয়ে রাতুল কি করে ফেলেছে তা সে নিজেও বুঝতে পারে নি। রাতুল যদি পুলিশের হাতে ধরা পরে তো তবেই বেঁচে গেল। সুবাতা বা শায়েলা এ দুজনের যে কেউ একজন পুলিশের আগে রাতুলকে খুঁজে পেলে সায়াথে সাথেই যমের সাথে দেখা করিয়ে দিবে।
.
.
.
.
নিজের প্রথম কাজ নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট ফাহাদ । তবে ওর বাসাটার উপর দিয়ে বেশ ধকল গিয়েছে। অবশেষে ভাড়া বাসাটা ছেড়ে নিজের একটা স্থায়ী বাসা নেওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
ক্লাবের মিউজ্যিক ম্যান কে আগেই একটা থ্যাংকস দেয়ার দরকার ছিলো।
মিউজ্যিক ম্যানের বিশাল বড় লাকেজের মত ব্যাগে ভারী সাউন্ডবক্স নিয়ে আসার দৃশ্য দেখেই ফাহাদ ভেবেছিল,এই ব্যাগে করে তো অচিরেই যে কোন মানুষকে বহন করা যাবে। কেউ ঘুনাক্ষরেও কিছু টের পাবে না।
সেদিন ই সে মিউজিক ইন্সটুমেন্ট বিক্রির দোকানে যায়, ওরকম বড়সর একটা, সাউন্ডবক্স ক্যারী করার চাকাযুক্ত ব্যাগ, একটা গিটার ও লম্বা কিছু ডুপ্লিকেট হেয়ার-সেট কিনে। যেরকম হেয়ার সেট সাধারণত কন্সার্ট করার সময় শো অফ করার জন্য পারফর্মার দের মাথায় লাগানো হয়।
ব্যাস। বাকি কাজ থাকলো ক্লোরোফর্ম সংগ্রহ ও এমন একটা জায়গা নির্বাচন করা, যেখানটা সিসি ক্যামেরার এংগেলের বাইরে লোকচক্ষুর ও একটু আড়ালে।
বেচারা বোকা রবিন ডাক দিতেই যে কাছে চলে আসবে এমনটা সেদিন ভাবেও নি ফাহাদ।
রবিনের দেহটা একটু ভারী ই ছিল। তবুও ব্যাগের নিচে চাকা সংযুক্ত থাকায় বহন করতে কষ্ট হয় নি। পিঠে গিটার আর মাথায় লম্বা চুল থাকায় কেউ চেক ও করতে চায় নি ব্যাগটাকে। এমন ব্যাগ নিয়ে ডিজে মিউজ্যিক ম্যান রা হার হামেশাই চলাফেরা করে, পার্টিতে যায়।
একটু কাঠখড় পোড়ানোর পর ই রবিনকে দোতলার নিজের বাসার ভিতরে ঢুকাতে সক্ষম হয় ফাহাদ।
এবার হল খেলা শুরু। রবিনের নিস্তেজ দেহটা লাগেজ থেকে বের করে সে। নিজের বিছানার চাদরটা নামিয়ে সেটাতে রবিনকে রোল করে মুড়ে ফেলে । পরে স্কচটেপ দিয়ে চারদিক থেকে খুব ভালোভাবেই পেঁচিয়ে দেয়। রবিন সামান্যতম নড়াচড়াও করতে পারবে না। আগে থেকেই ফাহাদ জানত, রবিনের অগ্নাশয় স্ফীতির রোগ ছিল। সুতরাং ওকে মারার প্লানটাও সেই রোগের সাথে রিলেটেড করে তৈরি করেছিলো সে।
অজ্ঞান অবস্থায় কিছুতেই রবিনের মুখের ভিতর কিছু ঢোকানো যাবে না। এতে করে ঠোঁট কেটে যেতে পারে বা কোন স্পট লেগে যেতে পারে। তাই ফাহাদকে অপেক্ষা করতে হল রবিনের হুঁশ ফেরা পর্যন্ত। ভয়ানক স্বপ্ন দেখে যেমন মানুষ হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে জাগ্রত হয়ে যায়, ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করা মানুষের সেভাবে হঠাৎ করেই হুঁশ ফিরে আসে না। ব্যাপারটা হয় ধীর প্রকিয়ায়। তাই রবিন চিৎকার করে উঠবে এমনটা নিয়ে টেনশন করার কিছু ছিল না ফাহাদের।রবিনের যখন হালকা জ্ঞান ফিরেছিল,নিজের চিন্তাশক্তি ফেরৎ পেতে শুরু করেছে তখন ই ফাহাদ রবিনের মুখ একটু চেষ্টার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় হা করাতে সক্ষম হয়েছিল।এরপর পাইপের মাধ্যমে দু গ্লাস ভদকা ঢুকিয়ে সোজা রবিনের পেটে চালান করে দিয়েছিল সে।অগ্নাশয়ের রোগ প্যানক্রিয়েটিটিস হলে এলকোহল এবং ক্যাফেইন সম্পূর্ন রূপে এড়িয়ে চলতে হয়। রবিন রয়েল লন্ডন হসপিটাল থেকে সাত দিনের হাই ডোজ মেডিসিনের একটা কোর্স করে এসেছিল মাস দুয়েক আগেই। এলকোহল তার জন্য সম্পূর্ন নিষিদ্ধ।
সুতরাং পেটের ভিতর এলকোহল চালনা করার উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র পুলিশের ইনভেস্টিগেশন বন্ধ করা।
এর পরের কাজ টা বেশি কঠিন ছিল না। রবিনের বুকের উপর বসে এক হাত দিয়ে মুঠো করে ওর চুল ধরে অন্য হাতে পাইপ নিয়ে গলার ভিতরে ওয়াটার পুশ করার কাজটা ছিল ভাবনার চেয়েও বেশি সহজ । রবিন, যখন প্রায় পুরোপুরি হুশ ফিরে পাওয়ার পরে চিৎকার করতে চাইছিল, তখন তার চিৎকারের শব্দ তো গলা থেকে বের হচ্ছিল ই না বরং ঢক ঢক করে গলার ভিতরে আরো বেশি পানি ঢুকে যাচ্ছিল। রবিন এক পর্যায়ে কাঁশি দিতে শুরু করে। কিন্তু এই কাশিও ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পানি গলা দিয়ে পেটে ঢুকে যেতে থাকে । ওর লিভার এত পানির চাপ সহ্য করতে না পেরে ভিতর থেকে উগরে দেয় সব। বমির সাথে রক্ত বেরিয়ে আসে রবিনের। ফাহাদ বুঝতে পারে, আর বার দুয়েক এ প্রক্রিয়া চালালেই রবিন ওপারের পথ দেখবে। তবে ফাহাদের হাতে গ্লাভস পরা না থাকলে এবং রবিনের দেহ চাদর ও স্কচটেপ দিয়ে মোড়া না থাকলে সেদিন ই অনেক বড় একটা অঘটন ঘটে যেতে পারত।
পরদিন যখন পুলিশ লাশ উদ্ধার করে তখনও যেন রবিনের চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে।
পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দেখে প্রশাসনের ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেয়, রবিন এসাইটিস এর কারণে মারা গিয়েছে।
পাকস্থলীর বহির্ভাগ পেরিটোনিয়াম নামক পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। পাকস্থলী এবং পেরিটোনিয়ামের মাঝে যে ফাঁকা স্থান থাকে তাকে পেরিটোনিয়াম ক্যাভেটি বলা হয় এবং ঐ ফাঁকা স্থানে পানি জমলে তাকে এসাইটিস বলে।পানির পরিমান বেড়ে গেলে লিভার ফেইল করে। প্যানক্রিয়েটিটিস থাকার পরেও মদ্যপান করেছে বলে এমনটি হতে পারে বলে ধারণা করে তারা। তবে ফাহাদের ভাগ্য ভালো। লিভারে পানি জমে থাকে নি। বমি করে পানি বের করে দিয়েছিল রবিন। নইলে লিভারে অতিরিক্ত পানি থাকার ব্যাপারটায় একটা খটকা লেগেই থাকত।
.
.
.
বুকের উপর টাকার ব্যাগ নিয়ে এসব চিন্তা করতে করতে করতে অল্প অল্প ঘুম এসে যায় ফাহাদের। কবে যে সে নিজের কেনা বাসায় ঘুমাবে সে খুশি আর ধরে না তার। যে টাকা রয়েছে তা দিয়ে অনায়েসে ছোট্ট দুই রুমের একটা এপার্টমেন্ট কিনে ফেলা যাবে।
হঠাৎ করেই তার খেয়াল হলো এই অপরাধ জগতে, গা ঢাকা দিয়ে থাকার জগতে এখনই স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করে কি লাভ, আরো কিছু টাকা কামিয়ে কায়রো থেকে বাইরের শহরে গিয়ে শান্তিতে বসবাস শুরু করাটাই ভাল হবে। বাহ, ভালো সিদ্ধান্ত,
নিজের বুদ্ধির প্রশংসা নিজেই করে সে। এ টাকাগুলো এখন ব্যাংকে জমা করাটাই তার কাছে সবথেকে উপযুক্ত কাজ মনে হল। তবে একদিনে হুট করে এত টাকা জমা করা যাবে না। আস্তে আস্তে জমা করতে হবে। নইলে যে কোন সময়ে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।
.
.
.
.
.
খবরের কাগজে বড় বড় করে উমরের মৃত্যুর খবরটা ছাপা হয়। ছাপা হয় উমরের বিভৎস দেহের ছবিও। সাথে রাতুল ও সুবাতার ছবি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পরে চারদিকে। এক পর্যায়ে সেটা তার ঔরসজাত পুত্র ফাহাদের কানে গিয়ে পৌঁছে। এতদিনে বাবা সুখে আছে ভেবে বাবাকে বেমালুম ভুলে থাকলেও আজ তার মৃত্যুর খবর শুনে সেদিনের মাকে হারানোর মত কষ্ট অনুভব করতে থাকে ফাহাদ। বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো, চকলেট কিনে দেওয়ার আবদার করা, সাইকেল চালানো শেখা সহ হাজারো স্মৃতির পাহাড়ে একের পর এক চাপা পরতে থাকে ফাহাদ।
ছোট বেলায় যে বাবার শরীরটাকে পাঞ্চিং ব্যাগ বানিয়ে খেলত, সে শরীরটাকে রাস্তার উপর এমন ছিন্নভিন্ন ভাবে অযত্নে অবহেলায় পরে থাকতে দেখে একটা ঝড় বয়ে যায় ফাহাদের মাঝে।
চোখের জল টপটপ করে মাটিতে পরতে থাকে তার।
নিজের ঘিঞ্জি এপার্টমেন্ট এর দিকে পা বাড়ায় সে। এখন তাকে ঘুমাতে হবে। সামনে খুব বড় একটা কাজ। ফাহাদ যেন নিজেই নিজেকে ভাড়া করবে একটা বিভৎস খুনের জন্য। হাঁটতে হাঁটতে এপার্টমেন্ট এর দিকে আগায় ফাহাদ। তার প্রতিটা পদচিহ্নের চারপাশে যেন ঘুরে ঘুরে ধুলোর ঝড় উঠে। ঠিক কি পরিমান আক্রোশ সে জমা করে রেখেছে নিজের ভিতর তা সে নিজেও জানে না। হঠাৎ করেই মায়ের দেয়া লকেটের দিকে চোখ যায় তার। লকেটটা উজ্জ্বলভাবে নীল আলো ছড়াচ্ছে। এটা দেখে ফাহাদ অবাক হয়না বরং অনুভব করে তার ভিতরে ক্রোধ শক্তি ও সাহস যেন কয়েকশগুন বেড়ে গেল। রাস্তার আশেপাশের মানুষ ফাহাদের চালচলনের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা খেয়াল করেই হুডি দিয়ে মাথা ঢেকে সবার মাঝ থেকে নিজের চেহারাটা আড়াল করে নেয় , রিভার্স ডক্টর।
বাসায় ঢুকেই দরাম করে দরজা লাগিয়ে দেয় ফাহাদ। গায়ের জামাটা খুলে ফেলে সে সোজা শাওয়ার নিতে চলে যায়। ট্রাকের নিচে চাপা পরা বাবার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহটা তার চোখের সামনে বারংবার ভাসতে থাকে।নোংরা ঝরনার নব এর দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে সে।
সিদ্ধান্ত নেয় বহুদিন পরে সে আসওয়ান শহরে পা রাখবে, রাতুল, শায়লা ও সুবাতার সাথে কিছু হিসেব নিকেষ বাকি আছে তার।
.
.
.
মাঝবয়সী একজন সুস্থ-সবল লোক হেরাস। খুব রগচটা।পর পর দুবার ডিভোর্স খাওয়ার পর সে একা একাই থাকে,বিয়ে করে নি আর। প্রাচীন ফেরাউন বংশের লোক সে।
বলে রাখা ভালো, আমাদের যেমন, খান, হাওলাদার কিংবা ভূইয়া বংশ রয়েছে, ফেরাউন ও ঠিক এমনি একটা বংশ। কোন নির্দিষ্ট ব্যাক্তির নাম ফেরাউন নয়। ফেরাউন একটা রাজবংশের নাম।
.
হঠাৎ করে দেখলে, হেরাসকে ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার একটা দানব বলে মনে হতে পারে।ফেরাউনদের মতই তার রগচটা - অত্যাচারী এবং হুকুম করার স্বভাবের কারণে দুটো বিয়ে করার পরও একটা বউকেও নিজের সাথে বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারে নি।তবে এমন দানবীয় দেহ নিয়ে বেশিদিন সিংগেল থাকতে হয় না। কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা ছেলেদের এমন বিকট দেহ দেখলেই প্রেমে না পড়ুক লোভে পরে। হেরাসও তার নিজের বিকট দেহের ফায়দা লুটে।মাঝে মাঝে হেরাস কাপড়চোপড় ছাড়া বিবস্ত্র অবস্থায় নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই অনেক গর্ববোধ করে। মাথায় শুধু কিছু চুল না থাকার কারণেই হয়ত হলিউডে অভিনয় করার সুযোগটা হাতছাড়া হলো!!এমনটা ই ধারণা তার।
.
প্রাচীন মিশরীয়রা যে দেবতাদের পূজো করত সে দেবতাদের একজনের নামের সাথে হেরাসের নামের খুব মিল আছে।
দেবতার নাম ছিল " হোরাস"।কথিত আছে, প্রাচীন মিশরীয়রা ভাবতো,
হোরাস হলেন আকাশের দেবতা। তিনি ছিলেন ওসিরিস এবং আইসিসের পূত্র। দেবতা সেথের হাতে ওসিরিস খুন হওয়ার পর তার জন্ম। মা আইসিস তাকে লালন পালন করে বড় করেন। বড় হয়ে হোরাস হয় একজন বড় যোদ্ধা।সে ৮০ বছর ধরে যুদ্ধ করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন।এরপর তিনি মিশরের শাসনকর্তা হিসেবে অভিসিক্ত হন।
সে ছিল রাজাদের রক্ষাকারী পৃষ্ঠপোষক দেবতা। হোরেস গ্রেট ইনিয়াড ৯ জন দেবতাদের একজন। ফ্যালকন বা ঈগল পাখির মাথাওয়ালা পুরুষ দেবতা হোরাস ছিলেন রাজাদের কাছে সবথেকে প্রিয় দেবতা। হোরাসের উপাসনাস্থল হল বেহদেত এবং হিয়েরাকোনপলিস।
হেরাসের বিলাসবহুল বাড়িতে এমন ফ্যালকনের মাথা ওয়ালা হাজার হাজার ছবি ও মূর্তী রয়েছে।
তার ভিতর একটা ছবি খুবই দুর্লভ এবং দামী। ছবিটার ফ্রেমের ভিতর অসংখ্য ডায়মন্ড খোদাই করা রয়েছে।ডায়মন্ড এর চেয়েও মূল্যবান জিনিস হল,ছবিটার সাথে জড়ানো ইতিহাস। ফেরাস উত্তরাধিকার সূত্রে এ দুষ্প্রাপ ছবির রক্ষাকর্তা হয়েছে।তবে ছবিটা হাজার হাজার বছরে হাজার হাজার ফেরাউনের হাত ঘুরে এখন শেষমেস ফেরাসের হাতে এসে ঠেকেছে।
মিশরের নামকরা মিউজিয়ামগুলোতে ঘুরলেও এমন প্রাচীন ছবির দেখা পাওয়া ভার।
এই ছবির মূল্যের কথা খুব ভালোভাবেই জানতেন সা'দ সামির। হেরাসের মা ছিলেন মুসলিম। সাদ সামির হলেন হেরাসের মামা। বয়সে হেরাসের থেকেও অনেক বড়।তবে হেরাসের বাসায় তার আসা যাওয়া এবং পারিবারিক সখ্যতা থাকায় ছবিটার ইতিহাস এবং মূল্য সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই জানতো সে।
কতরাত যে সে স্বপ্নে দেখেছে, ছবিটা এমেরিকায় পাচার করে, সেখান থেকে পাওয়া মোটা অংকের অর্থ দিয়ে শহরে দুটো শপিং মল কিনেছে!! তার ইয়াত্তা নেই।লোভে পরে এসব স্বপ্ন দেখা স্বপ্ন দোষের চেয়েও মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। হতাশায় ভোগায় প্রতিমুহূর্ত।
চাইলেই ছবিটা চুরি করতে পারত সাদ সামির। কিন্তু তাতে লাভ হত না। হেরাস ঠিকই ধরে ফেলত। তার বাসার চাকর রা দেখে ফেলত কিংবা সিসি ক্যামেরায় ধরা পরত তারপর রগচটা হেরাস তাকে এক হাত দিয়ে গলা টিপে মেরেই ফেলত একদম। তাই সুযোগের অপেক্ষায় কাটতে থাকে সাদ সামিরের দিনগুলো। কিন্তু তেমন সুযোগ আর তার আসে না।
.
.
.
একদিন রাতে এক গার্লফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে শপিং করে,শপিং মল থেকে বের হয় হেরাস।।অনেক টাকার শপিং করেছিল সেদিন।এই মেয়েটার পিছনে বুঝি টাকা একটু বেশি ই খরচ করে ফেলেছে সে। মেজাজ এমনি খিটখিটে থাকে হেরাসের, তার উপর আজ একটু বেশিই বিগড়ে আছে মাথাটা, এমন এটা ওটা চাই টাইপ মেয়ে আগে কখনো পরেনি তার লাইফে। একবার বাসায় নিয়ে যাওয়া যাক, তারপর বিছানায় দেনা পাওনা পরিশোধ করা যাবে ভেবে নিজেকে একটু শান্ত রাখতে চেস্টা করে সে।
এর মাঝেই পিছন থেকে একটা ডাক শুনে হেরাস,
" হেরাস!! হেই হেরাস!!
হেরাস পিছন ফিরে তাকায়। একটা ২১ বছর বয়সী ছোকড়া, তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইগনোর করে গাড়ির দিকে হাঁটা দেয় হেরাস। আবার ডাকা হয় ওকে,
হেই বল্ড বার্স্টার্ড আই এম কলিং ইউ, ইডিয়ট,। যার অর্থ, ঐ টাকলু জারজ, আমি তোকে ডাকছি,নির্বোধ।
হেরাসের মাথা এমনি ই গরম ছিল। সে ঘুরে চোখ গরম করে তাকায় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসে।এসে হেরাসের সাথে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে, হেই বিউটি ল্যাডি, হোয়্যাট আর ইউ ডুইং,উইথ দিস ইমাস্কুলেট গাই,?? হুম?? হি ইস ঠু উইক টু মেক ইউ সেটিসফাইড ইন বেড। যার অর্থ, হে সুন্দরী নারী!! তুমি এই পুরুষত্বহীন লোকটির সাথে কি করছ? সে তোমাকে বিছানায় সুখী করতে অপারগ।
কথাটা শুনে হেরাসের সাথে থাকা মেয়েটি একটা শব্দ করে হাসি দেয়,
হেরাসের মাথায় টগবগিয়ে রক্ত উঠে যায়। ছেলেটার কলার ধরে মাটি থেকে এক হাত উপরে উঠিয়ে ধরে চিৎকার করে বলে উঠে, ইউ লিটল মস্কোয়াইট!! হাউ ডেয়ার ইউ!! বলার সাথে সাথেই ছেলেটি মুখ থেকে এক দলা থুথু ছিটায় হেরাসের নাকেমুখে। সহ্যের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায় হেরাস। সে ওকে এক হাত দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে সোজা থুতনী বরাবর একটা ঘুষি লাগিয়ে দেয়। সাথে সাথে বিকট চিৎকার করে উঠে ছেলেটা। হেরাস ওকে হাত থেকে ছেড়ে দিলে ও গলাকাটা মুরগীর মত নিচে লুটিয়ে পরে। নাক মুখ থেকে অবিরাম গতিতে রক্ত বের হতে থাকে।ছটফট করতে করতে আস্তে আস্তে দেহটা স্থির হয়ে যায়। চার দিকের লোকজন সবাই ছেলেটার চিৎকার শুনে ইতিমধ্যেই হেরাসের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ছেলেটাকে লুটিয়ে পরতে দেখে সবাই ওদের দিকে দৌড়ে আসতে থাকে।হেরাস হঠাৎ ই ভয় পেয়ে যায়। সে মার্ডার করে ফেলল নাকি!! হাত টা ছেলেটার নাকের সামনে নিয়ে ধরে। নাহ কোন বাতাস বের হচ্ছে না বা ভিতরে যাচ্ছে না। হেরাসের মনে একটা কথাই বাজতে থাকে, "বাঁচতে হলে ভাগ হেরাস!! সময় নষ্ট করিস না।" হেরাস ওর গার্ল্ফ্রেন্ড কে সেখানে রেখেই পাশে থাকা নিজের গাড়িতে উঠে পরে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে খুব দ্রুত গতিতেই গাড়ি টান দেয়। সেই যে হেরাস গাড়িটা জোরে টান দিলো, গাড়ি আর থামল না!!
চারদিক থেকে লোকজনকে দৌড়ে আসতে দেখে শপিং এর জিনিসপত্র ফেলে মেয়েটাও সাইডে কেটে পরে। লোকজন কাছে আসতেই রাস্তা থেকে গা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে পরে ফাহাদ। দুটো ছোট ছোট ট্যাবলেট থেকে এত্তগুলো ফেক ব্লাড বের হবে কল্পনায় ও জানা ছিলো না তার। ছিল না তার। তবে ঘুষিটা বেশ জোড়েই লেগেছিল। অমন বিশালদেহী শক্তিশালী কারো একজনের ঘুষি হজম করাটা খুব সহজ যে হবে না, তা আগেই ধারণা করেছিল সে।
কিন্ত ঐ যে বলে না!! পেটে খেলে পিঠে সয়!! পরদিন সন্ধায় বারের বা পাশের কোনায় সাদ-সামির যখন নগদ কয়েকলাখ টাকা নিয়ে আসবে তার জন্য, তখন এ আঘাত কে খুব সামান্য ই মনে হবে।
.
.
পরদিন সকালেই খবরের কাগজে গাড়ি এক্সিডেন্ট এর কারণে হেরাসের মৃত্যুর সংবাদ শুনে লাফ দিয়ে খাট থেকে মেঝেতে পরে যান সাদ সামির, আনন্দে তিনি নিজের রুমে একা একাই নাচানাচি করেন কিছুক্ষন। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সেদিন আইভানহোর চ্যালার কাছে না গিয়ে রিভার্স ডাক্তার এর চ্যালার কাছে গিয়ে সে কাজটা শতভাগ সঠিকই করেছিল । ছবিটা হাতিয়ে নিতে তাকে বাঁধা দেওয়ার মত আর কেউ থাকলো না তবে! হেরাসের বাবা ও সাদ সামিরের বোন ছিলেন খুবই বৃদ্ধ। সুযোগ বুঝে সাদ সামির ডুপ্লিকেট তৈরী ছবির সাথে আসল টা পাল্টিয়ে বাজেয়াপ্ত করে দিলে একটা পিঁপড়াও টের পাবে না এখন।
মনে মনে রিভার্স ডাক্তার এর উপর বেশ খুশি হয় সাদ সামির।
বাকি টাকাগুল কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়ার সময় ফাহাদকে সাদ সামির " মটিভ অফ কিলিং হেরাস" সম্পর্কে সবকিছু-ই শেয়ার করেন।
কিন্তু রবিনকে হত্যা করার কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে যান। ফাহাদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর ভিতরে ঘাটায় নি।সে জানে, সোনার ডিম পাড়া হাসকে হাতছাড়া করার কোন মানে নেই। তাই সাদ-সামির কে যে কোন বিব্রতকর পরিস্থিতে না ফেলাই ভাল।
বেশ কিছু টাকা ফাহাদের হাতে এসে গিয়েছে। এবার সময় একটা ভালো এপার্টমেন্ট এ শিফট করার।
কায়রোতে টাকা থাকলেই বসবাসের জন্য ভালো-বাসা পাওয়া যায়। আগে বস্তি এলাকায় থাকলেও এবার সে আগের জায়গা থেকে বেশ দূরে মধ্যবিত্তদের এড়িয়ায় একটা খুবই উন্নতমানের বাসা ভাড়া নেয়। বাসাটার দরজার লক ফিংগারপ্রিন্ট সিস্টেম এর। তার হাতের স্পর্শ ছাড়া কিছুতেই দরজা খুলবে না। ভিতরের সব কিছু বেশ সাজানো গোছানো। প্রতিটা কক্ষ সাউন্ড প্রুফ এবং দরজা জানালা গুলো রিমোট কন্ট্রোলারের আওতাধীন, খোলা কিংবা বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই। তিনটি ভিন্ন কামড়া এবং একটি বাথরুম রয়েছে। কামড়া গুলো বেশ ছোট। তবুও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করার জন্য প্রতি মাসে বিল সল ২ লক্ষ পাউন্ড গুনতে হবে ফাহাদের। এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।টাকার উৎস আছে তার কাছে। সাদ-সামিরকে সে এখন দালালের মত ব্যাবহার করতে পারবে।কারণ, আরো কিছু ডিল হতে যাচ্ছে ফাহাদ এবং সাদ সামিরের ভিতরে, এমনটাই আভাস দিয়েছিল সামির। তবে কাজগুলো সাদ সামিরের নিজের নয়, তার বন্ধুর। এভাবেই এক জন দু জন করে আন্ডারওয়ার্ল্ড এ ফাহাদের সুনাম ছড়িয়ে পরতে থাকবে ভেবে বেশ পুলকিত হয় ফাহাদ।
কায়রোতে নিজের সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে,
নিজের ল্যাপটপ সহ প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামাদি ব্যাগে প্যাক করে ফাহাদ আসওয়ানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ।
দীর্ঘ ৫ বছর পরে সে আসওয়ান যাবে ।তবে ফাহাদের বাবা মায়ের কথা মনে পরলেই বার বার ভিতর থেকে কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলে। বাবা মায়ের সাথে অনেক আবেগ অনুভূতির ব্যাপার জড়ানো। তাদের কথা মনে পরলে ভিতর থেকে কঠোরতা হারিয়ে যায় তার। তিং মাং ফাহাদকে এতটাই ভালোবাসত যে সে খুব অল্প বয়সেই তার গোত্র,মা বাবার আশ্রয় ত্যাগ করে, একটা চাকরানীর কাজ নিয়ে কষ্ট করে জীবন যাপন করছিলো শুধুমাত্র তার সন্তানের কথা ভেবে।
তাদের গোত্র কর্তৃক তার সন্তানের যেন কোন ক্ষতি না হয়, সে কথা ভেবে। সেই সন্তান আজ এত বড়, তবে তাকে একনজর দেখার ও সুযোগ নেই।তিং মাং যে তার সন্তানের থেকে ভিন্ন জগতে!!
চোখে পানি চলে আসে ফাহাদের।
চোখ মুছতে মুছতে সে নিজের বাসা থেকে বের হয়।
মনে মনে বলতে থাকে,
.
.
"শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে,
আঘাত হয়ে দেখা দিলো, আগুন হয়ে জ্বলবে...."
.
.
.
চলবে..
.
.
লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।

Post a Comment

Previous Post Next Post