ব্লাক-ক্যাফেটেরিয়া ☕ পর্ব- ১০ | লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ

ব্লাক-ক্যাফেটেরিয়া  পর্ব- ১০
লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ


______________________
ওহমা চলে যাওয়ার পরে লাশের অক্ষত মাথার দিকে চোখ চলে যায় হেলেনের।স্যামুয়েল তার বিশ্বাসঘাতক চোখ দুটো বন্ধ করারও সময় পায়নি। নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটো এবং ঠোঁটে ফুটে উঠেছে একরাশ ভয় এবং বিভ্রান্তি।
গলার সাথে দড়ি এমন ভাবে বাঁধা হয়েছিল, যাতে রাস্তার সাথে ঘর্ষনে পুরো দেহ ক্ষতবিক্ষত হলেও মাথাটা সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকে।
হেলেন রিওর লাগাম ধরে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে আসে লাশ সহ।এরপর ক্রুইফ কে জানায়, রোমান অজ্ঞান হয়ে গেছে।ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ হয় সেদিন একটু জলদি।
ক্রুইফ ও তার সার্ভিস বয় জ্যাক ধরাধধরি করে রোমান কে নিয়ে নিজ বাড়ির দিকে এগোয়।হেলেন ক্রুইফ কে বলে রাখে ছোট একটা কাজ আছে তার, সেরেই এসে যাবে। ক্রুইফ কথা বাড়ায় না। রোমানকে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে নিজ নিবাসে।
হেলেন, রিওর লাগাম হাতে নিয়ে রাস্তা ধরে সোজা চলে যায় বিপরীত দিকে। অন্ধকার তখন আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে। হেলেন হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে রোডলাইটের আলোর সীমাবদ্ধতার বাইরে।
রাস্তার পাশ দুদিকে ঢাল হয়ে নেমে গিয়েছে। একপাশে হালকা গাছপালাযুক্ত বন, অপরপাশে
লম্বা লেক। সুবিধামত একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে যায় হেলেন। সে ইশারা দিতেই আলফা লেকের পাশের দিকের ঢাল বেয়ে নেমে যায় কিছুদুর। সামনের দু পায়ের ধারালো নখ দিয়ে দ্রুত গতিতে নরম মাটিগুলো সরিয়ে গর্ত খুড়তে শুরু করে সে। হেলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু, কিছুই করতে হয়না তাকে। তবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে তার মা কোথায়! তাকে খুঁজে পাওয়াটাও জরুরী ।হেলেনের মা কোথায় আছে এটা জানতে হলে একমাত্র ভরসা হচ্ছে ওহমা। কিন্তু ওহমার কাছে জিজ্ঞেস করে যে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যাবে না, সেটাও বুঝতে পারে হেলেন। এক্ষেত্রে রিওর সাহায্য নিতে হবে। যেহেতু রিও ওহমার সাথে ছিলো, সেহেতু ওহমার নিবাস সম্পর্কে রিওর জানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক৷ হেলেনের এসকল ভাবনা চিন্তার সময়টুকুর মধ্যেই
আলফা বিশাল আকৃতির একটা গর্ত করে ফেলে।হঠাৎ ই মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিজলির চমক।ঠা ঠা শব্দে কেঁপে উঠে চারপাশ।
রোড লাইট টা কয়েকবার নিভে জ্বলে নিভে জ্বলে হুট করে নিভেই যায়। আকাশের কান্না শুরু হয়েছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়ত তা আরো প্রখর হবে।
বিদ্যুৎ চমকের আলোতে
বিভৎস লাশটাকে আরো বেশি ভয়ানক লাগছে।
তাড়াতাড়ি করতে হবে যা করার।
হেলেন নিজের কোমরে লুকিয়ে রাখা খাপ থেকে ছোট্ট একটা পকেট ছুড়ি বের করে৷ দু পোঁচে কেটে নেয় লাশের কাটা গলার ভিতর দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা দড়ি।
আলফা একটু ক্লান্ত হয়ে পাশে বসে আছে।
রিও সামনে হেঁটে লাশটাকে গর্তের মুখে নিয়ে আসে। খাড়া ভাবে মাটি চাপা দিতে হবে। গর্তের ভেতরে নামানোর জন্য হেলেন স্যামুয়েলের মাথা ধরে টান মারে। এতেই ঘটে বিপত্তি, স্যামুয়েলের মাথাটা ছিড়ে হেলেনের হাতে চলে আসে। টাল সামলাতে না পেরে হেলেন নিজেই পা পিঁছলে মাথা নিচের দিকে হয়ে পড়ে যায় গর্তের ভিতর। ঘাড়ের কয়েকটা হাড্ডি কড়কড় করে উঠে হেলেনের। একেবারে ভেংগে না গেলেও ভীষন ব্যথা পায় সে। এর থেকেও জঘন্য ঘটনাটা ঘটে, স্যামুয়েলের কাটা মুন্ডূর গলার অংশ টা হেলেনের মুখের উপর এসে পরাতে। নাকের ছিদ্রে ও ঠোঁটের ভিতর দিয়ে কিছু রক্ত- পানি ঢুকে যায় হেলেনের।।চুল মুঠো করে ধরে মুখের উপর থেকে স্যামুয়েলের বিচ্ছিন্ন চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা মুন্ডু টা একপাশে রাখে। নিশ্বাস বন্ধ নিজ রেখে মাথাটাকে খুব সাবধানে ঘুরিয়ে সোজা হতে সক্ষম হয় সে।
কিন্তু হালকা পানি জমে যাওয়ায় নিজের উচ্চতার থেকে একটু বড় গর্ত থেকে বের হতে পারছিল না হেলেন। হাড়ি উল্টো করে রাখার মত স্যামুয়েলের মাথাটা বসিয়ে সেটার উপর পায়ের ভর দিয়ে অতি কষ্টে টেনে উপরের দিকে উঠতে চাচ্ছিল হেলেন। কিন্ত মাটি ভিজে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় সেটা খুব একটা সহজ হচ্ছিল না। রিও এগিয়ে আসে। ঝুঁকে মাথা নিচু করে দেয়। হেলেন রিওর গলায় থাকা, লাগান ধরলে একটানে উপরে উঠিয়ে ফেলে।
সোজা রাস্তায় বেশ দূর থেকে ছোট্ট একটা লাল আলো এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। হয়তবা কোন একটা লোক আসছে কুপি হাতে। যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। এবার আর ভুল করেনা হেলেন, পা দুটো ধরে ধাক্কা দিয়ে গর্তের ভেতরে ফেলে স্যামুয়েলের মাথাহীন দেহ। থপ্পাস করে একটা শব্দ হয়। হেলেনের কাছে এ শব্দটা প্রশান্তির।
উঠে আসে আলফা। হেলেন ও আলফা মিলে আশপাশ থেকে মাটি জড়ো করে চাপা দিয়ে দেয় স্যামুয়েলের দেহ। মাটি ভরাট হয়ে গেলে রিও তার শক্ত খুড় দিয়ে আরো ভালোভাবে মাটি গুলোকে সেঁধিয়ে দেয় ভিতরে। বেলে মাটি। বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে খোড়াখুড়ির কোন চিহ্ন ই থাকবে না। কাজ শেষ করে
হেলেন পাশে থাকা লেকের ভেতর নেমে পরে।সাথে সাথে নামে আলফাও। মাটি খুড়ে সেও অপরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। রিও ইচ্ছা করে আলফার গায়ের উপর ঝাঁপ দেয়, পানির নিচে ভদ্র ছেলের মত চুপচাপ আলফাকে দুটো লাথি মেরে দিলে হেলেন তা তো আর দেখবেনা!!
তিনজন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে যখন তীরে উঠে আসে, দেখতে পায়, দূর থেকে যে লোকটি কুপি হাতে এগিয়ে আসছে, সে আর কেউ নয়, ক্রুইক সাহেব,সাথে জ্যাক। দুজনের কন্ঠে হেলেনের নামে ডাকাডাকি শুনে দূর থেকেই চিনতে পারে হেলেন।
তুমুল বৃষ্টির ভিতরেও মেয়েটা কোথায় গিয়েছে, তা নিয়ে চিন্তিত হয়েই হয়ত খুঁজতে নেমেছে তারা।
হেলেন রিওর পিঠে চেপে দ্রুত চলে আসে ক্রুইফ সাহেবের কাছে। জ্যাক কে রিওর পিঠে তুলে আগেই পাঠিয়ে দেয় ক্রুইফের বাড়িতে।হেলেনের
অনেক কিছু বলার আছে ক্রুইফ সাহেব কে।
হেলেন যতটুকু প্রয়োজন খুলে বলে তাকে। এতক্ষন ধরে স্যামুয়েলের লাশ মাটিচাপা দিচ্ছিল সেটাও বলে দেয় হেলেন। রোমান যাতে এসব কিছুই টের না পায়, সেজন্য ছোট খাট একটা প্লান ও করে ফেলে তারা।
.
.
.
.
মাঝ রাতে হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে ধড়ফড়িয়ে ওঠে রোমান। সাথে সাথেই তার মনে পরে যায় সেই বীভৎস লাশটির কথা।হেলেন এবং ক্রুইফ সাহেব ও তার সাথের জ্যাক কে তখন ই চিৎকার করে ডেকে তোলে ঘুম থেকে। হেলেন সবার আগে ছুটে আসে।
হেলেনকে দেখা মাত্রই আরো জোরে চিৎকার করে ওঠে রোমান,
" ঐ খুনীটা কোথায়? আর লাশ টি!"
হেলেন অবাক হওয়ার চেহারা করে উত্তর দেয়,
লাশ!
কিসের লাশ!
কার লাশ!!
" ওহ শিট! তুমি কি পাগল হয়েছ হেলেন?
- পাগল হইনি।
" কাল ক্যাফেটেরিয়ার কথা মনে নেই?
- মানে! কাল তো খুলেই নি ক্যাফেটেরিয়া, ক্রুইফ আংকেল অনেক অসুস্থ। তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছ।
ক্রুইফের অসুস্থতার কথা শুনে চুপচাপ হয়ে যায় রোমান। কথা বাড়ায় না। তবে মন থেকে কিছু মুছেও যায়না ওর।
.
.
সকাল সকাল উঠেই আর রিও এবং হেলেনকে দেখতে পাওয়া যায় না।
আলফা বসে আছে বাসায় ঝিম ধরে।
মন খারাপ যে বোঝা যাচ্ছে তার।
কিন্তু মন খারাপ থাকলেও উপায় নেই৷
হেলেনের আদেশ অমান্য করতে পারবে না সে।
রিও হেলেনকে নিয়ে সূর্যের আলো ফোটার আগেই তুমুল বেগে দৌড়ে বন জংগলের মাঝ দিয়ে এসে হাজির হয় বড় পাহাড় দুটোর সামনে। এর পেছনেই ওহমার নিবাস।
রিও কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না হেলেন কে এখানে আনতে। কিন্তু হেলেনের কাকুতি মিনতি অনুরোধ ফেলার মত পাষণ্ড রিও ছিল না।
অবশেষে তারা এখন ওহমার ট্রি হাউজ থেকে একটুখানি দূরে মাত্র।
সাদা অখন্ড পাথর এর পাহাড় বাওয়া খুব সহজ কাজ নয়।মারাত্মক আকারের পিচ্ছিল ও ধারালো থাকে এগুলো। কিন্ত হেলেন তো একেবারেই দুর্বল নয়।
সেও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী একজন যুবতী।
শারিরীক বিভিন্ন কসরত করে হেলেন বেশ অনেক সময় ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে সফলতা লাভ করে। পাহাড়ের শক্ত প্রাচীর পার হয়ে যায়।
কিন্তু এপাশে এসে নামতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় হেলেনের। এরকম সুন্দর একটা পরিবেশ,
যেন এক টুকরো স্বর্গের ছবি কেউ রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে। রিও মাথা উঁচু করে ঘরটির দিকে নির্দেশ করে। ওখানেই থাকে ওহমা। ওহমার বাসায় যাওয়ার আগে পায়ের জুতো খুলে ফেলে হেলেন, নরম ঘাস এ পা এলিয়ে হাঁটতে ভীষন ভালো লাগছে তার। চারদিকটা এত সুন্দর!! আনমনেই দুহাত দু দিকে চলে যায় হেলেনের খোলা আকাশের নিচে ঘুরতে থাকে, পাখির কিচিরমিচির শব্দ, বাতাসের ফুরফুরে তান, সব কিছু মিলিয়ে মনটা একদম ফকফকে হয়ে যায় হেলেনের। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ছোট জলাশয়ের দিকে। নীল পদ্মটা মিইয়ে গিয়েছে। হয়ত সেখানে একটা শালুক সৃষ্টি হবে।
টলমলে পানির জলাশয়ে লাল নীল কমলা হলুদ রংএর ছোট্ট মাছের আনাগোনা।
আংগিনায় উড়ে বেড়ানো হরেক রংগের বাহারী প্রজাপতি ও গোয়াল!! এ তো এক টুকরো স্বর্গ ই। হঠাৎ রোমানের কথা মনে হয় তার। রোমান এখানে থাকলে আরো বেশি উপভোগ করা যেত। চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে চোখ যায় ওহমার ট্রি হাউজে। সেখানেও সু-রুচির এক ছোয়া লাগানো যেন। ট্রি হাউজের ছোট্ট বারান্দায় ছোট ছোট টব। এক জায়গায় পাখিদের জন্য কিছু খাবার পানি রাখা।গাছ থেকে কাঠবিড়ালি দৌড়াদৌড়ি করে এসে একবার বাসায় ঢুকছে আবার অন্য জায়গা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
একটু প্রস্তুতি নিয়ে সিঁড়িতে পা টিপে টিপে হেলেন উপরে উঠতে থাকে।
কিন্তু যখন বাসায় উপস্থিত হয়, তখন দেখতে পায় সম্পূর্ণ খালি একটা বাসা।আছে কিছু আসবাব পত্র, কাঠ দিয়ে বানানো খাটের উপরে নরম শুকনো দুর্বার ঘাস দিয়ে বানানো জাজিম, পাখির নরম পালকের বালিশ,
পাশেই একটা টেবিল। টেবিলে অদ্ভুত ভাষার অনেক গুলো বই। পানি খাওয়ার গ্লাস, জগ, পেপার কাটিং, ডায়েরি, পাশে আছে আরেকটা ছোট্ট তাক। সেখানে ফুলদানিতে রাখা কিছু তাজা ফুল,
চারদিকটা অসম্ভব শান্তিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু লোকটি গেলো কোথায়!!
হেলেন সিদ্ধান্ত নেয়, ওহমা আসার আগ পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করবে সে। টেবিল থেকে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে নরম বিছানায় শুয়ে পরে সে।
ডায়েরি খুলতেই টুপ করে একটা পেপার কাটিং এসে পরে হেলেনের বুকের উপর।
তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকে হেলেন,
তালহা এবং তালহার শিশু সন্তান ফাহাদের একটা ছবি৷অজানা এক কারণেই ছবিটা দেখার পরে হাত কাঁপতে থাকে হেলেনের।কম্পিত হাতেই
ছবিটাকে পাশে রেখেই ডায়েরির পাতা উল্টায় সে।
মনে মনে বলতে থাকে,
আই হ্যাভ টু রিড দিস ডেভিল'স ডায়েরি এস সুন এস পসিবল।
(চলবে)


Post a Comment

Previous Post Next Post