গল্পঃ প্রতিচ্ছবি লেখা : আখলাকুর রহমান

 গল্পঃ প্রতিচ্ছবি

 লেখা : আখলাকুর রহমান

মা গলায় দড়ি দেওয়ার দিন সকালে আমায় পাশে বসিয়ে বলেছিল, তর ছুডো ভাইডারে দেখিস বাপ!
আমি তখন এগারো ক্লাসে পড়ি। মায়ের কথায় যে এত গভীরতা ছিল তা আঁচ করে উঠতে পারিনি। পরে বোধ হয়েছে, মায়েদের সব কথাই গভীর হয়।
আমি সূর্য না উঠলে কখনো বিছানা ছাড়ি না। কিন্তু সেদিন সূর্য উঠারও অনেক আগে আমার ঘুম ভেঙে গেল। বোনের কান্নায়।
এর আগে অনেকবার বোনের কান্না খুব সকালে কানে এসেছে। হয়তো মায়ের হাতের রুটি বেলনের আঘাত না সহ্য হওয়ার কান্না, নয়তো ঠিকমতো থালা বাসন না ধুতে পারার দরুণ!
তবে আজকের কান্নায় কেমন একটা হাহাকার খুঁজে পেলাম। কান্নার আওয়াজেও যে 'কিছু নেই, কিছু নেই' ভাব উঠে আসে তা বোনের কান্না শুনে প্রথম বুঝলাম।
চোখ কচলাতে কচলাতে বোনের কান্নার উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি মা সটান হয়ে শুয়ে আছে। ত্রয়োদশা আমি সারা জীবন দেখেছি মা সবার আগে ঘুম থেকে ওঠে। কিন্তু আজ এত কান্না আহাজারিতেও মায়ের ঘুম ভাঙছে না। মাথার উপরে ঝুলতে থাকা দড়িটাতে নজর আটকে যাওয়ার পরমুহূর্তেই কেমন যেন শূন্যতা অনুভব করলাম। পৃথিবীর পাপী বস্তু হিসাবে যদি কিছুকে দায়ী করি, সেটা হয়তো এই ঝুলতে থাকা দড়ি।
আমার বাবার দু'বেলা মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করার অভ্যাস ছিল। যে ঝগড়াকে পূর্ণতা দিতে বাবা হাতের নিকটে যে বস্তু পেয়ে যেতো, সেটা দিয়েই মাকে প্রহার করতো। যে ঝগড়া থামানোর সাহস না ছিল আমার, না আমার বোনের। আর ছোট ভাই তো নিতান্ত শিশু।
মা আর বাবার ঝগড়ার বিষয়বস্তু ধরতে কত চেষ্টা করেছি! কিন্তু তখন কিছুই ধরার ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়নি। রাতে বোনের পাশে শুয়ে গল্প শুনার ফাঁকে কত লুকিয়ে শুনেছি, বু আব্বা মাকে ধরে পিটানি দ্যায় ক্যান?
বোন কী উত্তর দেবে সেটা আমার জানা, চিরচেনা। বোন প্রতিবারই বলতো, তুই চুপচাপ গল্প শোন ভাই। সখীপুরের রাজার মস্ত.....!
যখন আমার নাক আর নাভীর নিচে পশম গজালো তখন আমাকে বোনের কাছে শুয়ে গল্প শুনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। যার কারণ জানতে চেয়ে আমি উত্তর পেয়েছি, বড়ো হইতাছোস না? বড়ো হইলে আলাদা ঘুমান লাগে।
বড় হওয়ার কথা আমার কানে গেঁথে যায়। আমিও বড় হব, শহরে যাবো। যে শহরে বড় বড় আইসক্রিম পাওয়া যায়। সে আইসক্রিম আমাদের গাঁয়ের টেপু মালাইয়ের মতো না। শহরের আইসক্রিম হয় মোলায়েম! যার গায়ে মাখন আর দইয়ের মাখামাখি। আইসক্রিমের লোভের কাছে গল্প শুনার লোভ পরাজিত হয়ে যায় নিমিষেই।
বিকালে আমাদের মাটির ঘরে একদল লোক এলো। তাদের গায়ে গাঢ় নীল রঙের পোশাক। হাতে ইয়া বড় বন্দুক। কোমরে মোবাইলের মতো কী বাঁধা! যার মাথায় সরোয়ার চাটুইয়ের বাড়ির টিভির মতো এ্যান্টেনা লাগানো।
আমি পরে বোনের কাছে তাদের নাম জানি, পুলিশ। আমি পুলিশের গল্প শুনেছি আগে। তারা বড় বড় চোর ধরে। তারপর তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে গারোদে ঢুকিয়ে দেয়।
পুলিশ দেখতে পাওয়ার আনন্দে আমার চোখ চকচক করে ওঠে। যে চকচকানির আড়ালে কিছুক্ষণের জন্য চাপা পড়ে যায় এক মমতাময়ীর মৃত্যুর শোক।
খানিকবাদে পুলিশেরা মাকে গাড়িতে তোলে। গাড়ি স্টার্ট হয়, গাঁয়ের পথ ঠেলে চলতে চলতে অদৃশ্য হয়।
আমার মন জিজ্ঞাসাকাতর হয়ে ওঠে। বোনকে বলি, বু, মাকে কি ওরা গারোদে নিয়ে গেল? মা কী চুরি করছেরে বু?
আমার বোন চোখ মুছে জবাব দেয়, মা চুরি করে নাই ভাই। মারা গেলে পুলিশেরা লাশ নিয়ে যায়।
'সেদিন রেণুর দাদিও তো মরলো! কই পুলিশ আইসা তো নিয়া যায় নাই? আমার মারে নিয়া গেল ক্যান তা'লে?'
আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে দোলনা থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ছোট ভাই কাঁদছে। আমি তার কান্নার ভাষা বুঝতে পারি, ক্ষুধার কান্না। কান্নারও যে নিজস্ব ভাষা হয়; গভীর ভাষা।
পরদিন সকালে আবার পুলিশের গাড়ি এলো। তারা মাকে ফেরৎ নিয়ে এসেছে। পলিথিনে মোড়ানো আমার মাকে গাড়ি থেকে নামানো হলো। তবে পুলিশের গাড়ি খালি ফেরে না। মোটা গোঁফওয়ালা পুলিশ আমার বাবার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে গাড়িতে তোলে। আবার স্টার্ট হয় গাড়ি। চলার আগে আমার দিকে তাঁকিয়ে বলে, এইটা বাপ না হারামজাদা? তোমার মা গলায় দড়ি দেয় নাই, এই হারামজাদায় গলা টিপে মেরে ঝুলাই দিছে।
পুলিশের কথার ভার সেদিন আমি অতটা বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু আমার বোনের গলা ফাঁটানো কান্নার ভার আমি বুঝে উঠতে পারি। যে কান্নায় থেকে থেকেই উতলে উঠছে তিনটা প্রাণের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার শঙ্কা।
মাকে কবরে নামানোর আগে কেউ একজন বলল, শেষবার মুখখান একটু ছেলেডারে দ্যাখান যায় না?
'চোখ নাই, খালি কোটর। ছেলে মানুষ, দেখলে ভয় পাইবো। তারচে' তাত্তাড়ি কবরে নামাও,' বলেই মাকে কবরে নামানো হয়। মায়ের মুখ তো আমি বহুবার দেখেছি। কই কখনো তো ভয় পাইনি! বরং সে মুখ মনে উঠলে সাহস বাড়ে। মায়ের মুখ দেখলে কেন ভয় পাব সে কারণ আমার কাছে ঘোলা জলের মতো।
মায়ের মৃত্যুর কারণ যতদিনে আমি জেনে যাই ততদিনে আমার ছোট ভাই এক দু'পা হাঁটতে শিখেছে। পাড়ার অন্য বাচ্চাগুলো যখন মুখে ভাসা ভাসা শব্দে 'মাআআ, বাআবাআআ' বলা শিখছে তখন আমার ভাই অর্জন করছিল, ভাই আপা বলার মতো যোগ্যতা। ভাইটাকে আমার বোন মাটির কতকগুলো খেলনা বানিয়ে দিয়েছিল। সারাদিনের বেশির ভাগ অংশই সে পার করতো সেসব খেলনা নেড়ে।
অভাব অতটা আমাদের গ্রাস করতে পারেনি আমার বোনের জন্য। বাড়ির আঙিনার উচ্ছিষ্ট জমিতে আমি আর বোন সবজি চাষ করেছি। বাবা আর মাকে এভাবে অকালে হারিয়ে স্বাভাবিকভাবে পড়ালেখার চাকা আর গড়াইনি আমার। ইশকুলের মাষ্টার মশাইয়ের কাছে পড়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমি পাড়ার শেষ মাথার বাজারে সবজি নিয়ে বসতাম। যে মাষ্টার মশাইকে আমাকে পড়া না পারার দরুণ বেঞ্চের উপরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার আদেশ দেওয়ার কথা, আমার পশ্চাৎদেশে চিকন বেতের আঘাত করে 'কাল থেকে পড়া করুমনে' শোনার কথা, সেই মাষ্টার মশাই গলা হাঁকিয়ে সবজির দাম শোনেন। তাতেও আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। ছোট থেকেই অভিযোগ না করার মতো কঠিন প্রতিভা তৈরি হয়েছিল আমার মাঝে।
আমি এখন অষ্টদশা। ছোট ভাইটার বয়স ছয়। বোনকে কতবার বলেছি বিয়ের জন্য। কিন্তু আমার বোন রাজি হয় না। বলে, সেই ছোট্ট থেকে তোগো কাছে কাছে রাখছি। তোগো ছেড়ে কই যাইবো আমি ভাই? মানুষ বানাইবো তোগো।'
বোনের কথায় ছোট ভাইয়ের ভ্রু সংকুচিত হয়ে আসে। তাঁকিয়ে বলে, আমরা তো মানুষই আছি আপা। আমাগো আবার মানুষ ক্যান বানাইবা?
তার কথায় আমি হেসে উঠি। ভাইয়ের দিকে তাঁকিয়ে আমার চোখে স্বপ্ন ভাসে; আগলে রাখার স্বপ্ন।
একদিন বাদ আছর কাদের আলী ছুটে আসে। নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বলে, তোমার বাপের গেল রাইতে ফাঁসি হয়ে গেছে গা!
কাদের আলী আমার দিকে তাঁকিয়ে অনুশোচনার দৃষ্টি কামনা করে। কিন্তু আমার চোখে আফসোস বা অনুশোচনার লেশমাত্র না দেখে সে বিচলিত হয়। খেলতে থাকা ছোট ভাই এগিয়ে এসে বলে, ভাই কী হইছে? কার কী হইছে?
আমি ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলি, কিছু হয় নাইরে ভাই। শহরে একটা গরু জবাই হইছে, দুষ্টু গরু।
পরনারীতে আসক্ত যে পুরুষ আমার মাকে ঝুলিয়েছে তার কোনো খবর আমি ভাইকে ছুঁতে দেই না। তার জানার প্রয়োজন বাবা মারা গেছে। সেই প্রয়োজনটুকু তার মগজে আমি খুব আগেই ঢেলে দিয়েছি।
আগের সেই ছেলেবেলার মতো খুব দেরিতে ঘুম ভাঙে না। সূর্য তার আলো ছড়ানোর আগে বিছানা ছাড়ি। কিন্তু আমার বোনের আগে বিছানা আমায় ঠেলে দিতে পারে না। আমি বোনের দিকে তাকিয়ে থাকি। বোনের মুখে একটা মুখের প্রতিচ্ছবি দেখি। যে প্রতিচ্ছবি আমায় ডেকে বলে, তর ছুডো ভাইডারে দেখিস বাপ!

Post a Comment

Previous Post Next Post