গল্পঃ জনম বিফল । লেখাঃ অজানা

 
গল্পঃ জনম বিফল 
 লেখাঃ অজানা
সকাল ৮:৩০, বাবা বাথরুমে গোসল করছে, একটুপর অফিসে যাবে। এদিকে এক নাগাড়ে বাবার ফোনে রিং বাজছে। আম্মু রান্নাঘর থেকে আমাকে বলছে, জুলি তোমার বাবার ফোন বাজে, দেখো তো কে কল করেছে..??
আমি বাবার টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম মিজান চাচা কল করেছে। ফোনটা নিয়ে এক দৌঁড়ে রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুকে বললাম, তাড়াতাড়ি রিসিভ করো, বাড়ি থেকে মিজান চাচা ফোন করেছে।
আম্মু ফোন রিসিভ করতেই মিজান চাচা বলে ওঠলো, ম্যামসাহেব, ইলি মামণির কবরটা আবার ভেঙ্গে গেছে, পানিও ওঠেছে কবরে। ঝড় নাই, বৃষ্টি নাই তবুও এই কবরটা খালি ভেঙ্গে যায়।
আমি আম্মুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম তাই ফোনের ঐপাশ থেকে মিজান চাচার কথা অস্পষ্ট হয়ে আমার কানে এলো। ইলি আপুর নাম শুনে আমি আঁতকে ওঠলাম। নিজের অজান্তেই গলা দিয়ে শব্দ বেরিয়ে এলো, ইলিপু..!!! হাত পা কাঁপতে লাগলো আমার। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এলো। তারপর আর কিছুই বলতে পারবো না।
জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম আম্মুর বিছানায়। বাবা অনলাইনে ট্রেনের টিকিট টাকার জন্য চেষ্টা করতেছে। এদিকে বিছানায় শুয়ে আমার ধ্যান খেয়াল সব ফিরে গেলো নয় বছর পিছনে। যেখানে আমার রব ছিলো অপরিচিত।
৩১ জুলাই,২০১১
সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান ভেসে আসলো বাসার পাশে থাকা তিন চারটা মসজিদ থেকে। ইলি আপুর গানের টিচার চলে এসেছেন। মাগরিবের আজান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রেওয়াজ শুরু হয়ে গেলো। আপু বিভিন্ন প্রোগ্রামেও গান গায়। গানের বিষয় হচ্ছে লোকসঙ্গীত।
রেওয়াজের শুরুতে তানপুরা বাজতে থাকে। আপু এক ধান্দায় মাথা দুলাতে থাকে, সাথে থাকে আমাদের উৎসাহমূলক করতালি।
গান করতে করতে এশার আজানের শব্দও পেলাম। বাসার পাশে তিন চারটা মসজিদ থাকায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমরা আজানের শব্দ শুনতে পাই। কিন্তু সেদিকে কোনদিনও কোন খেয়াল ছিলো না আমাদের।
আম্মু এসে বললেন, ইলি মা আমার এবার একটু রেস্ট করো। ইলি আপু বললো, আম্মু পরশু থেকে তো রমজান মাস শুরু। এবার কিন্তু রমজানের প্রথম সপ্তাহেই আমাকে সব শপিং করে দিবে প্লিজ। ঈদের তৃতীয় দিন একটা কনসার্টে পার্টিসিপেট করতে হবে। আগে থেকেই সব ড্রেস বানিয়ে রাখবো, পরে এত ঝামেলা করতে ভালো লাগে না। আম্মু বললেন, তুমি কোন চিন্তা করো না, রমজানের প্রথম সপ্তাহেই তোমার যা যা লাগে সব কিনে ফেলবো। আমার মেয়েকে টিভিতে দেখাবে এরচেয়ে গর্বের বিষয় আমার জন্য আর কি হতে পারে..!!
রাত ১২:৩০, সবাই ছাদে বসে চা খাচ্ছিলাম আর ইলি আপুর গান শুনছিলাম,
"কারে করিছো সন্ধান
সন্ধানে কি ফল..??
সন্ধানে মিলে না কিছুই,
জনম বিফল.."
চা,গান,আড্ডা এসব করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেলো। সবাই নিচে নেমে এলাম। ঘড়িতে তখন পৌঁনে তিনটার কাছাকাছি। ইলি আপু আমাকে বললো, জুলি কাল রাতে এই টাইমে আমরা সাহরী করবো। জানিস জুলি, রমজান মাসটা আমার কাছে ইমাজিং লাগে। সারারাত জেগে থাকা যায়, বিকাল পর্যন্ত ঘুমানো যায়। আহ্,শান্তি আর শান্তি...
আমি আর ইলি আপু একই বিছানায় থাকতাম। সেদিন কাঁচা ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারলাম ইলি আপু আমাকে জোরে একটা লাথি দিয়েছে। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার। কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো, শুনতে পেলাম ফজরের আজান হচ্ছে। ফজরের আজানের সাথে ভয়ঙ্কর গোঙানির শব্দ মিশ্রিত হয়ে এক আচানক শব্দ কানে এলো। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখ খুলতে পারলাম না। গা শিউরে ওঠতে লাগলো আমার।
খানিকপরে টের পেলাম আমার জামার একপাশ থেকে ইলি আপু খামচেঁ ধরেছে। জামা ছিঁড়ে চিড়চিড় শব্দ হচ্ছে এটাও স্পষ্ট কানে এলো। আস্তে আস্তে চোখ খুললাম, আমার পাশে শুয়ে থাকা ইলি আপুকে কেমন বিভষ্যৎ লাগছে। আমি চিৎকার করতে পারলাম না।
বিছিনা অনবরত কাঁপছে। মনেহলো আমার ভিতর থেকে শুকনো কলিজাটা কেউ হিচকা টানে বের করে এনেছে।
ইলি আপুর গোঙানি শব্দে বাবা ছুটে এলেন আমাদের ঘরে,পিছনে পিছনে আম্মুও এসে দাঁড়ালেন। ইলি আপুর মুখ দিয়ে পিচ্ছিল লালা বের হয়ে আমার শরীর ভিজে যাচ্ছে। গরম ফুটন্ত পানির মতো যন্ত্রনা অনুভব করলাম আমি। আম্মু ভয়ে আমাদের কাছে আসলেন না। মা ভয়ে সন্তানের কাছে আসছে না, পৃথিবীতে এরচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য আর কি হতে পারে..??
বাবা রুমের দরজা খোলে মসজিদের দিকে ছুটে গেলেন। একটুপর একজন হুজুরকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। সকাল তখন একদম পরিষ্কার। সকালের ঠান্ডা মৃদু বাতাস আর ইলি আপুর গরম নিঃশ্বাসে রুমের ভিতর এক বিষাক্ত পরিবেশ তৈরী হলো।
এদিকে ইলি আপুর চোখ অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে গেছে। হুজুর ইলি আপুর কানের কাছে বললেন, মা কালিমা পড়ো "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্" পড়ো মা, পড়ো।
ইলি আপু পড়তে লাগলো, "জনম বিফল.."
হুজুর আবার বললেন, বলো মা "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্"
ইলি আপু বলতে লাগলো, "জনম বিফল.."
ইলি আপুর চোখ বড় থেকে আরো বড় হতে লাগলো। মনেহলো চোখের মণি এখনি ছিটকে বেরিয়ে আসবে। খামচেঁ বিছানার চাদর ছিঁড়ে ফেললো। দুই পায়ের সবগুলো আঙ্গুল বেঁকে কুঁকড়ে গেলো। আস্তে আস্তে ইলি আপুর পা কাঁপা বন্ধ হয়ে গেলো।
আমি পলকহীন চোখে খেয়াল করলাম ইলি আপুর পেট অনবরত লাফাচ্ছে, নাড়ি ভুড়ি সব বের হয়ে আসবে এমন অবস্থা। আস্তে আস্তে পেট শান্ত হয়ে এলো। মুখ দিয়ে বারবার উচ্চারণ করতে লাগলো, "জনম বিফল.."
নিমিষের মধ্যেই চোখ ফ্যাকাসে রং ধারন করে স্তব্ধ হয়ে গেলো। সকালের রোদ তখন উঁকি দিচ্ছে। হুজুর বাবাকে বললেন, চোখ দুটো বন্ধ করে দিতে। বাবা ভয়ে ইলি আপুর কাছে আসলেন না। হুজুর নিজেই চোখ বন্ধ করে দিলেন। আমি কাঁদতেও পারছিলাম না, অসহায় মনেহলো নিজেকে নিজের কাছে।
ইলি আপুকে কবর দেওয়া হলো আমাদের গ্রামের বাড়িতে। অনেক কষ্টে ইলি আপুকে কবরে রাখা হয়েছে। তিনটা কবর খুঁড়া হয়েছিলো, কিন্তু তিনটা কবরেই পানি ওঠছিলো বারবার। তারপর কোনরকম বাঁশের ফালিগুলো পানির উপর রেখে সেভাবেই আপুকে কবরে রাখা হয়।
মাঝেমাঝে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতাম ইলি আপু আমার পাশে শুয়ে আছে। আমি চোখ খোলা মাত্রই আমার বুকের উপর ওঠে বসতো আর আমার গলা তার দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে বলতো, তোরা কেনো তখন আমার গানের সাথে করতালি দিতি..?? তোদের জন্য আমি তো আমার রব কে চিনতে পারি নি। তুই কেনো আমার দুনিয়ার সাথী হয়েও কবরের সাথী হলি না..??
আমি চিৎকার করতে চেয়েও চিৎকার করতে পারতাম না তখন। নিঃশ্বাস আটকে যেতো আমার।
গত নয় বছরে বেশ কয়েকবার কবর ভেঙ্গে গিয়ে পানি ওঠেছে আবার সেই কবর মেরামত করা হয়েছে। আবার ভেঙ্গে গিয়েছে। ইলি আপুর কথা মনেহলে আমার কানে এখনো তার গোঙানির শব্দ সুস্পষ্টভাবে বাজতে থাকে, চোখের সামনে ভাসতে থাকে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তার ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে থাকা, "জনম বিফল"
#বি.দ্র : কখন কার মৃত্যু আসবে এটা কেউই জানিনা, তবে কোন হালতে আমরা দিন অতিবাহিত করছি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করতে হবে, কেননা যে যেভাবে দিন অতিবাহিত করে চলেছে মৃত্যু সেরূপে এসেই ধরা দেবে, মৃত্যু কারো ভালো হবার আশায় অপেক্ষা করবেনা,
#ইয়া_আল্লাহ !! মৃত্যু যখন দিবেন যেন আপনার সন্তুষ্টির পথেই যেন প্রত্যাবর্তন হয়...
colected

Post a Comment

Previous Post Next Post