গল্প- ফেরা,লিখেছেন-রুহুল আমিন



রুপা ছাড়া আমরা সব ভাইবোন বাড়ির কোনার রুমটাই মন খারাপ করে বসে আছি। আমি, বড় বুবু, মনির আর তুলি। তুলি কাঁদছে। মাঝে মাঝে তুলির কান্নার ফোপানি শোনা যাচ্ছে। তুলির কান্না দেখে মনির ভীষণ রেগে যাচ্ছে। কয়েকবার শাসিয়েছেও। তারপরও তুলি কান্না থামাচ্ছে না।
আব্বা আজ খুব ভোরে নতুন বিয়ে করে বউ নিয়ে বাসায় এসেছে। বড় বুবু ছাড়া আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে বসার ঘরে গিয়ে দেখি আব্বার সাথে এক মহিলা বসে আছে। আমাকে দেখে আব্বা কিছুই বললো না। আমি বিষয়টি জানলাম তুলির কাছে। জানার পর এক এক করে আমরা সব ভাইবোন কোণার রুমে গিয়ে বসে আছি। রুপার বয়স চার। সে ভীষণ খুশি। আব্বা আজ তার জন্য পুরো প্যাকেট ভর্তি সন্দেশ এনেছে। উপরে বাদাম দেওয়া সন্দেশ। একটা সন্দেশ শেষ করে সে আবার আব্বার নতুন বউ মানে আমাদের ছোট মায়ের কাছ থেকে আরেকটা সন্দেশ চেয়ে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে সে আমাদের এই রুমে এসে জানাচ্ছে কয়টা সন্দেশ খেয়েছে। ছোট মা কোলে নিয়ে খাইয়েছে সেটাও বললো। মনির ভীষণ ক্ষিপ্ত হলো। রুপাকে মারতেও চাইলো কয়েকবার কিন্তু বড় বুবু বাঁধা দিলেন।
আম্মা খুব স্বাভাবিক। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না তার মধ্যে কি হচ্ছে।আব্বার বিয়ে নিয়ে তাকে কোন হৈ চৈ করতে দেখা যাচ্ছে না। আজ সকালে তার গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথার কথাও বলতে শোনা গেলনা। রোজ সকালে তার গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা উঠে। এই ব্যাথা নিয়েই তিনি আব্বার জন্য রোজ রোজ রুটি বানান। আব্বা গরম গরম রুটি খেতে পছন্দ করেন। আমরা রোজ দিনই সকালে বেগুন ভর্তা বা আলু ভাজি দিয়ে ভাত খায় তবে মাঝে মাঝে রুটি। আজও আম্মা রুটির জন্য আটা মাখাচ্ছেন। বড় বুবুকে একবার ডেকেছেন রুটি বেলতে কিন্তু বুবু কোন সাড়া শব্দ করলো না। আজ বুবুর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। বুবু ভীষণ ভালো ছাত্রী। একবার পড়লেই যেকোন জিনিস মুখস্ত করতে পারে। আজ সকাল থেকে তাকে একবারও পড়তে দেখা যায়নি। আমি মাত্র কলেজে উঠলাম। মনির ক্লাস নাইনে আর তুলি এইটে।
আমি বড় বুবুকে বললাম আজ পড়বেনা বুবু?
বুবু কোন উত্তর দিলেন না। মনে হলো না আমার কথা তার কানে গিয়েছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, বুবু আজ না তোমার পরীক্ষা?
বুবু ভীষণ রেগে গিয়ে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলেন। আমি কিছুই বুঝলাম না্। বুবু আমাদের গায়ে কখনো হাত তুলেন না। এমনকি আব্বা যখন নানা কারণে আমাদের গায়ে হাত তুলেন তখন বুবু ভীষণ কাঁদতো। আজ আমাকে চড় মারার পরও বুবু নিশ্চুপ।
কেনজানি বুবুর চড় খেযেও আমার একটু কান্না পাচ্ছে না। আমি বড় বুবুকে বললাম, আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।
বুবু আমার একটা হাত চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, খবরদার। এই কাজ কখনও করবি না।
মায়ের সাথে আমাদের নতুন মা রুটি বেলছে। আমরা সবাই নাস্তা করতে বসেছি। আজ সবার জন্য রুটি হচ্ছে। আমরা সব ভাইবোন চুপচাপ বসে আছি। আব্বা কিছু একটা বলতে গিয়ে বললেন না। চুপ করে আছেন। নাস্তা করে আমরা আবার আগের রুমে এসে বসে আছি।
এই শহরে আমাদের পরিচিত বলতে তেমন কেউ নেই। যদিও আমাদের আত্নীয় স্বজন খুব একটা আছে বলে মনে হয়না। কাউকে তেমন একটা আসতেই দেখিনি। খবর পেয়ে পরিচিত এক মামা আসলেন। এসে আম্মার সাথে কথা বললেন।
বোঝালেন এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে মায়ের কি করার আছে। থানা পুলিশ করে কোন লাভ হবেনা। তারচেয়ে ছেলেমেয়ের কথা ভেবে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। আম্মার নিশ্চুপ থাকাটা আমার কাছে মনে হলো আম্মাও মানসিকভাবে আমাদের জন্য আব্বার এই অপরাধ মেনে নিয়েছেন।
আমাদের সব ভাইবোনের সময় আর জীবনটা কেমনজানি পাল্টে যেতে লাগলো। পরিচিত লোকজন দেখলেই আব্বার বিয়ে নিয়ে জানতে চাই। ভয়ে আমরা কেউ বাইরেও তেমন একটা যাই না। মাসখানেকের মধ্যে আব্বা আলাদা একটা বাসা নিলেন। আমাদের ছোট মা ওখানেই থাকে। প্রথম প্রথম বেশি একটা আসলেও এখন আব্বা এই বাসায় খুব একটা আসেনা। আমি মাঝে মাঝে ঐ বাসায় গিয়ে আমাদের খরচের টাকা নিয়ে আসি। আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। ঐ বাসায় গিয়ে বসে আছি আব্বার জন্য অমনি ছোট মা বললেন, হাসান তোমার আব্বার তোশকটা একটু ছাদে দিয়ে আসো। অনেকদিন রোদে দেওয়া হয়না। হাসান, বাসায়তো আদা নেই, তোমার আব্বা এসে আদা চা চাইবে। তুমি তারাতারি সামনের দোকান থেকে আধা কেজি আদা নিয়ে এসো। এভাবে আমি প্রতিনিয়ত ঐ বাসায় গিয়ে ফরমায়েশ খাটি। তারপরও আম্মার চাচাচাপিতে যেতে হয়।
একবার টেবিল থেকে পড়ে গিয়ে রুপার হাত ভাঙ্গলো। বাসায় কোন টাকা পয়সা নেই। আমি দৌড়ে গেলাম ছোট মায়ের বাসায়। আব্বা তখনো অফিস থেকে ফেরেননি। বসে রইলাম আব্বার জন্য। ঘন্টা দুয়েক পর আব্বা এসে ঘটনা শুনে আমার সাথে ভীষণ রাগারাগি করলো। আম্মাকে নিয়ে ভীষণ বকাঝকা দিলেন। আম্মা ঠিকমত দেখাশুনা করেননা বলেই এমন হচ্ছে। এছাড়া আম্মাকে নিয়ে আরো ভীষণ খারাপ খারাপ গালাগলি করলো। আমি আব্বার সামনে দাড়িয়ে কাঁদছি। আমার একটুও ভালো লাগছেনা। ইচ্ছে করছে দৌড়ে কোথাও পালিয়ে যায়। তারপরও রুপার কথা চিন্তা করে দাড়িয়ে রইলাম। আব্বাকে আমার খুব অপরিচিত মানুষ মনে হলো। মনে হলো এই লোকটাকে আমি একটুও চিনিনা। রোজ বিকেলে বাদাম দেয়া সন্দেশ নিযে বাসায় ফেরা লোকটাকে আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি তখন একবার আমার খুব জ্বর হলো। জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বলছি। আব্বা আমার পাশে সারারাত বসে থাকলেন। ফজরের নামাজ শেষ করে আমার মাথায় ফুঁ দিয়ে ঘুমাতে গেলেন। আমার খুব মনে আছে, আমরা ভাইবোনরা কেউ অসুস্থ হলে আব্বা কেমন যেন হয়ে যেতেন। অথচ সেই আব্বা রুপার হাত ভাঙ্গার কথা শুনেও মন খারাপ না করে রাগারাগি করছে।
আস্তে আস্তে আমরা সব ভাইবোন বিষয়গুলো নিয়ে সহনশীল হয়ে গেলাম। বড় আপা অর্নাস শেষ করেই একটা চাকরী নিলো। আমিও পড়ালেখার পাশাপাশি একটা চাকরী করি। বেশ কিছুদিন আব্বা আমাদের তেমন একটা খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করে দিলেন। আমরাও যোগাযোগ করিনা। আম্মা বড় আপার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন কিন্তু আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে সবাই কেনজানি এড়িয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পর বড় আপার খুব ভালো একটা বিয়ে হলো। আমিও পড়ালেখা শেষ করে ভালো একটা চাকরী করি। সংসারটা মোটামুটি চলে যাচ্ছে।
প্রায় তিন বছর পর। মাঝ রাতে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হলো। মনে হচ্ছে চারিদিক ভেসে যাবে। হঠাৎ দেখি আব্বা কাকভেজা হয়ে বাসায় আসলো। বাবাকে ভীষণ বির্মষ দেখাচ্ছে। আম্মা খুব অস্তির হয়ে পড়লেন। আলমারিতে যত্ন করে রাখা আব্বার লাল তোয়ালেটা এনে তার হাতে দিয়ে বললো এই বৃষ্টিতে কেউ এভাবে ভিজে। আম্মার কথা শুনে মনে হলো একটু আগেই আব্বা আম্মার সাথে কথা বলে বাইরে গিয়েছিলেন।
আব্বার জন্য গরম ভাত রান্না করা হয়েছে। বৃষ্টির দিনে আব্বা গরম ভাতের সাথে ঘি দিয়ে খেতে খুব পছন্দ করেন। আমি আব্বার সামনে বসে আছি। তুলি আর রুপা ঘুম থেকে উঠে এসে আব্বাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে গেল। মনির আব্বার সামনে আসেনি। আব্বার উপর তার ভীষণ রাগ। আব্বা ঘি দিয়ে গরম ভাত খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে অনেকক্ষন বসে রইলেন। বৃষ্টি থামতেই আব্বা হুট বেরিয়ে গেল।
এভাবে আব্বা মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় হুটহাট করে আসতে লাগলেন। একদিন মাঝ রাতে বসার রুমে কান্নার আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙ্গলো। গিয়ে দেখি আব্বা কাঁদছেন। বড় বুবু এই বাসায় ছিলেন। সে আব্বার পাশে বসে আছে। বড় বুবুও কাঁদছেন। আব্বার একটা হাত তার মুটো করে ধরা। আমি আব্বার পাশে গিয়ে বসলাম। আমার তেমন একটা কষ্ট লাগছে না। ঐ যে বললাম, অনেক সহনশীল হয়ে পড়েছি। আব্বার পাশে কাগজে মোড়ানো একটা বক্স আব্বা লুকাতে চাইলো। আমাদের পাশে বসে আছে আব্বা। অনেকক্ষন সময় পেরিয়ে গেল। আমি, বড় বুবু, আব্বা, আম্মা কেউ কিছুই বলছিনা। হঠাৎ আব্বা হুট করে বেরিয়ে গেলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর কাগজে মোড়ানো প্যাকেটটা খুলে দেখি আমাদের সবার প্রিয় সেই বাদাম দেওয়া সন্দেশ। আমার বুকের ভেতরটা ছিড়ে যেতে চাইলো। আমি হাউমাউ করে কাঁদছি। কাঁদছেন বুবু আর মা। আমরা জানিনা কেন কাঁদছি। অজস্র নির্মমতার স্রোত পাড়ি দিয়ে যে সমুদ্র আমরা অতিক্রম করেছি তাতে কান্নার কোন জায়গা নেই তবুও আমরা কাঁদছি। আমরা সবাই কেনজানি ভোরের প্রতীক্ষায় বসে আছি। প্রথম প্রহরে হয়তো বাবার মুখটা দেখার প্রতীক্ষায় বসে আছি।
গুনে গুনে বিশ দিন হলো আব্বা আসেনি। একুশতম দিনে ঠিক ভোরে আব্বার মৃতদেহ আমাদের বাসার সামনে। মনির চিৎকার করে কাঁদছে। সারাটা জীবন মনির নিজের মাঝে পুষে রাখা রাগ, ক্ষোভ যেন আকাশসম ভালোবাসায় রূপ নিয়ে কান্না হয়ে বেরুচ্ছে। সবাই কাঁদছে। মা, বড় বুবু, তুলি, রুপা সবাই। আমি খুব ভয়ে থাকতাম। এমন একদিন কি আসবে যখন আমরা কেউ আব্বার জন্য কাঁদতে পারবো না। আমার সেই ভয় কেঁটে গেলো। আমাকে সারাটা জীবন আর ভয় নিয়ে এগুতে হবেনা। আব্বার নিয়ে আসা বাদাম দেয়া সন্দেশের সুখ যেমনটি আমরা সব ভাইবোন লালন করেছি ঠিক তেমনি বাবা হারানোর কষ্টটা আমি এবং আমরা অনুভব করতে চেয়েছি। যে মানুষটির জন্য কষ্ট অনুভব হবেনা সেই মানুষ আমাদের জীবনে ছিলো কিনা তা সন্দেহ থেকে যাবে। আমি চাইনি আমার বাবার জায়গাটি তেমনটি হোক। আমি প্রতীক্ষায় থেকেছি দিনশেষে তিনি যেন আমার বাবাই থাকেন।
-----ফেরা
#Ruhul_Amin

Post a Comment

Previous Post Next Post