গল্প: সার্ভাইভ, পর্ব: ১,লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ


"ফাহিম? রিফাত কোথায়??"
-আছে হয়তো কোথাও।
-বিষ আনতে বলেছিলাম তোকে, এনেছিস??
- হ্যাঁ।
ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ফাহাদ। অর্ধেক পানি ঢক ঢক করে পান করে বাকি অর্ধেক পানির ভিতর কাগজে পেঁচিয়ে আনা চিনির সবটুকু ঢেলে দেয় সে।
ফাহিম কে উদ্দেশ্য করে বলে,
ইঁদুরের বিষ টা দে,
ফাহিম নিজের হাতে থাকা ৪ প্যাকেট ইঁদুরের বিষ এগিয়ে দেয় ফাহাদের দিকে। ফাহাদ প্যাকেট ছিড়ে পানিতে বিষ মেশাতে শুরু করে।
এরই ভিতর রিফাত এসে যায়,
কথা বলতে বলতেই ফাহাদের কাছ থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে ছিড়ে বোতলের পানিতে মিশিয়ে ফাহাদকে সাহায্য করে রিফাত।
চার প্যাকেট মেশানো শেষ হতেই হাতে বোতলের ছিপি আটকে ঝাঁকাতে থাকে ফাহাদ।
বেশ অদ্ভুত ধূসর রঙ এর একটা মিশ্রন তৈরি হয়েছে।
.
.
.
পুরোনো একটা জমিদার বাড়ি।
এত বড় বাড়িটায় সব মিলিয়ে  ৫ টা দালান।
একটা থেকে অন্যটার দুরত্ব ২০-৩০ ফুট।
প্রধান বিল্ডিংটায় কেয়ারটেকার দেলোয়ার,  বৃদ্ধ নীলচাঁদ আর তার স্ত্রী থাকেন। নীলচাঁদ হলেন জমিদারের ছেলে রাজশেখরের বউ এর ভাই। জমিদারের ছেলে এবং তার বউ  রুদ্রশেখর কে ছোট রেখেই পরপারে চলে যান। রুদ্রশেখর বড় হয় নীলচাঁদের কাছে। টাকাপয়সার অভাব একদমই ছিল না। ছোট থেকেই উন্নত পরিবেশ ও পড়ালেখার জন্য নীলচাঁদ ইংল্যান্ড  পাঠিয়ে দেন রুদ্রশেখর  কে। মোটা অংকের টাকাও পাঠাতেন প্রতিমাসে। রুদ্রশেখর নাকি সেখানে বড় হয়ে বিয়েও করেছেন। ইংল্যান্ড এর স্থায়ী বাসিন্দা। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে জমিদার বাড়ি বিক্রি করে রুদ্রশেখর দেলোয়ার এবং নীলচাঁদ ও তার বৌকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন।
তবে এসব কাহিনীতে ফাহিম, রিফাত ও ফাহাদ আগ্রহী নয়।
জমিদার বাড়ি ফাহাদের বাড়ি থেকে বেশ কয়েক কিলো দূরে হলেও ফাহাদ ঘেটে ঘুটে বেশ ভালো কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে বাড়িটা সম্পর্কে। ফাহাদের দাদা এক সময় জমিদার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন কবিতা লিখে জমিদারকে শুনানোর সুবাদে। তখন জমিদার বাড়িতে অনেক মানুষ ছিলো। জমিদাররা মোট ৬ জন ভাই,  প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দালান ঘর ছিলো। সবচেয়ে সুসজ্জিত ও প্রধান দালান টায় থাকতেন জমিদার নিজেই। তবে জমিদারের ভাইয়েরা ভালো ছিলেন না। রাত হলেই জলসা - গানের আসর আর মেয়েদের নিয়ে আড্ডা দিতেন তারা। সবচেয়ে খারাপ দিক ছিলো জমিদারের একদম ছোট ভাই।  ফাহাদের দাদার কাছ থেকে জানা যায়, ঐ ছোট ভাই-ই নাকি জমিদারের অপর ৪ ভাই এবং তার বৌদের খুন করেন। ফাহাদের দাদা তখন কিশোর বয়সের। কবিতা লিখে মাঝবয়সী  জমিদারকে পড়ে শোনাতেন। এই কারণেই বাড়ির  ভিতরের অনেক কিছুই জানতে পেরেছিলেন ফাহাদের দাদু। তিনিও আজ বেঁচে নেই। তবে জমিদারের বৌ খুন হওয়ার পর নাকি জমিদার তার ছোট ভাইকে মেরে ফেলেন। এরপর  কোথায় উধাও হয়ে যান, কেউ জানেনা। রাজ শেখর বড় হন প্রধান দালান বাড়িতে। তিনি তার জীবদ্দশায় বাকি ৫ দালান ঘরে পা বাড়ান নি। প্রত্যেকটা ঘর ছিলো দুই তলার। তবে সু সজ্জিত আলিশান দালান ঘর। আশেপাশে বাগান। ফলফুলের গাছ থেকে চাকররা ফল সংগ্রহ করলেও ঐসব দালান ঘরে পা দেন নি। তবে জমিদার বাড়িতে চোর ঢুকতো না কখনো। ঢোকার সাহস পেত না। বাড়ির ভিতর গুনে গুনে ১৭ টা বিলেতি কুকুর রাতে ছাড়া থাকত। ভালো ট্রেইনিং দেয়া। বেশি ডাকা ডাকি করেনা। কিন্তু কোন মানুষ বিনা অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলে তাকে কয়েকটুকরো মাংসে পরিনত করা মামুলি ব্যাপার ছিলো।
এখন আর অত কুকুর নেই। বয়সের ভারে বিলেতি কুকুরগুল মারা গিয়েছে। এখন আছে একটা মাত্র দেশি কুকুর।
.
.
.
.
হাতে ম্যাপ ও লাইট নিয়ে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রওনা দেয় ফাহাদ।ঘড়িতে রাত দুইটা। সামনে আগালেই মোড়ে রিফাত ও ফাহিমের দেখা মিলবে। এক বুক আশা নিয়ে হাতের ম্যাপ দেখতে দেখতে সামনের দিকে এগিয়ে ফাহাদ। তবে মোড়ে এসে পৌঁছানোর পর ফাহাদ বেশ অবাক হয়। ওরা দুজন নয়। তিন জন। চোখেমুখে বিষ্ময় নিয়ে ওদের সামনে হাজির হতেই রিফাত আগ বাড়িয়ে মেয়েটিকে পরিচিয় করিয়ে দেয় ফাহাদের সাথে। ফাহাদ, এ হলো আমার কাজিন, নেহা!
আমি আসোলে ওকে সব কিছু বলেছি। পরে ও আমার সাথে আসতে চাইলো পরে নিয়ে এলাম।
ফাহিম উত্তেজিত কন্ঠে বলে, শুধু একটা কুকুর খুন, তারপর ম্যাপ অনুযায়ী যাওয়া, জিনিসটা খোঁজা এবং নিয়ে আসা। এতটুকুই তো ব্যাপার।
একজন সাহায্যকারী  পেয়েছি। তাতে মন্দ কি!!
বৃদ্ধ দেলোয়ার আর নীলচাঁদরা তো মরার দিন গুনছেন। কুকুর না ডাকা ডাকি করলে যতই শব্দ হোক, তারা বের হবেনা। তবে বের যদি হয়েই যায়, টের যদি পেয়েই যায়, তবে সমস্যা।দু'নলের বন্দুক দিয়ে খুলি উড়িয়ে দিবে মুহূর্তেই।
এসব ভেবেই ফাহাদের কষ্ট হচ্ছিলো নতুন একটা মেয়ে তাদের সাথে যাবে এটা মেনে নিতে।
.
.
.
জমিদার বাড়ির লোকরা এখন আর জমিদার না থাকলেও তাদের টাকা পয়সার অভাব কোন কালেই ছিল না। জমিদার বাড়ির বৌদের যে ভারী গয়নাগুলো ছিলো ওগুলো এখনো লকারেই রয়েছে।
তবে জমিদারা বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে বাড়ির সবকিছু ইংল্যান্ড চলে যাবে। ফাহাদ রিফাত ও ফাহিম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এই গয়নাগুলো চুরি করার। প্রধান দালান বাড়িটার কোন জায়গায় লকার রুম রয়েছে তা ফাহাদের ম্যাপ এ চিহ্নিত করা রয়েছে।
তবে তাদের আগে কেউ সেখান থেকে ওগুলো সরিয়ে ফেলেছে কিনা তা নিয়ে তারা এখনো সন্দিহান।
কারণ জমিদার বাড়িতে কি কি থাকতে পারে তা সবাই ই জানে এবং আজকাল চুরি করার অনেক নতুন ও অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। নীলচাঁদ আগেও ওগুলো বিক্রি করে দিতে পারেন। তবে চেষ্টা একটু করে দেখতে তো কোন সমস্যা নেই।
চারজনই হাতে লাইট নিয়ে রওনা দেয় জমিদার বাড়ির  উদ্দেশ্যে।
পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ৪৫ মিনিট লেগে যায়।প্রধান গেটের সামনে যে রাস্তা,  সে রাস্তার অপর পাশে একটা গাছের আড়ালে চারজন দাঁড়িয়ে যায়। ফাহাদ ব্যাগ থেকে বিষ মেশানো পানির বোতলটা বের করে।
পাউরুটি টার উপর সে পানি ঢেলে রুটিটাকে জুবজুবে করে ফেলে।
ফাহিম প্লান অনুযায়ী হাতে একটা পাথরের টুকরা নিয়ে সজোরে গেটের লোহার উপর ছুড়ে মারে। টং করে একটা শব্দ হয়। সাথে সাথেই বাড়ির ভিতর থেকে একটা কুকুর ডেকে উঠে। ঘেউ......
শুনশান রাতে ওরা চারজন ই শুনতে পায়, চার পায়ের কিছু একটা ছুটে আসছে গেটের দিকে।প্লান অনুযায়ী কাজ হয়েছে। এবার হাতে থাকা পাউরুটিটা ছুড়ে গেটের উপর থেকে ভিতরে ফেলে ফাহাদ। চাঁদের আলোয় ওরা স্পষ্ট দেখতে পায়,কালো রঙ এর কুকুরটা রুটি টাকে কিছুক্ষন শুঁকে দেখে। তারপর চলে যায়। ওরা সবাই নিরাশ হয়ে যায়। কিন্তু কুকুরটা ২০/৩০ সেকেন্ড পর ই রুটিটার কাছে আসে। ভালো করে শুঁকে দেখে। তারপর এক কামড়ে অর্ধেক মুখের ভিতর নিয়ে চিবুতে থাকে।কাজ হয়েছে প্লান সাকসেসফুল। পুরো রুটিটা খাওয়া শেষ হতে না হতেই কুকুরটা মাটিতে লুটিয়ে পরে।
ওরা আর দেরী না করে দেয়ালের পাশে চলে যায়। প্লান অনুযায়ী দড়ি দিয়ে দেয়াল টপকে ফেলে তিনজনই। স্কুলের দেয়ালে বহুবার  প্রাক্টিস করেছে তিনজন। তবে সমস্যা হলো মেয়েটাকে নিয়ে। ওকে তুলে যখন চারজন ই জমিদার বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল, রাত তখন ৩:৩০। হাতে বেশি সময় নেই। সবাই হন্তদন্ত হয়ে ম্যাপ দেখে সামনে এগুতে যাবে, এমন সময় অপরিচিত একটা শব্দে ফাহিম, রিফাত ফাহাদ চমকে উঠলো।
পিছনে ফিরে দেখলো নেহা একটা অর্ধেক ইট দিয়ে কুকুরটার মাথার মাঝ বরাবর একটা ঘা মেরে প্রায় ঘিলু বের করে ফেলেছে। ওদের অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নেহা ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল, মৃত্যু নিশ্চিত করলাম। রিক্স নেয়া ভাল না।
ফাহাদ মনে মনে ভাবলো, এই মেয়ের স্বামীর কপালে অনেক দু:খ আছে।
ম্যাপ দেখে এগিয়ে যাচ্ছে চারজন। শুধুমাত্র রিফাতের হাতে লাইট জ্বলছে। সবাই পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে ম্যাপ অনুযায়ী। খুব পানির পিপাসা পেয়েছে সবার। সবাই একটু দাঁড়িয়ে পানি খেয়ে নিলো।
অন্ধকারে ম্যাপ বুঝে চলতে ভালোই কষ্ট হচ্ছিলো তাদের।
আস্তে আস্তে সামনে এগোচ্ছিল তারা।
হঠাৎ-ই পিছন থেকে শুনতে পেলো অদ্ভুত এক আওয়াজ।...গরর..গর গর গর!!
কুকুর হঠাৎ শিকার কে বাগে পেয়ে গেলে যেমন শব্দ করে,  ঠিক তেমন শব্দ। রিফাত কম্পিত হাতে পিছনের দিকে লাইট মারে।
এরপর যা দেখল, তাতে তিনজন ই হতভম্ভ হয়ে গেল।
সেই কালো কুকুরটা তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা থেকে চামড়া কেটে ঝুলে গিয়েছে। সেখানের হাড় ভেদ করে ঘিলু দেখা যাচ্ছে অনেকটা। চোখের কোটর থেকে এক চোখ নেই। জিহ্বাটা বিষক্রিয়ায় নীল বর্ণ ধারণ করেছে। দাঁত গুলো যেন আগের চেয়েও মারাত্মক বড় আকারের হয়ে উঠেছে।নখের থাবা গুলো আরো ভয়ানক ও ধারালো দেখা যাচ্ছে।কুকুরটার গা থেকে কেমন সবুজাভ আভা ঠিকরে বের হচ্ছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে চারজন এর দিকে।

ভয়ানক চোখ ও ঘিলু বের করা কুকুরটা আস্তে আস্তে ওদের দিকে এগুতে শুরু করে। ওরা বুঝতে পারে ওদের দৌড়াতে হবে। কিন্তু দৌড়ে কোথায় যাবে তা কেউ ই জানে না। চাপা স্বরে কমান্ড দেয়। প্লিজ সবাই এক সাথে থাকো। কিন্তু দৌড় শুরু করলে মেয়েরা আছাড় খাবেই। এটা যেন চিরন্তন সত্য। অবশ্য এর কারণ ও আছে।  মেয়েরা খুব কম দৌড়াদৌড়ি  করে। এজন্য জোরে দৌড় দিলে নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে পারে না।
এক্ষেত্রেও নেহা ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যায়। কয়েকবার গড়াগড়ি ও খায়। ও ছিলো সবথেকে পিছনে। ওর নিচে পরে যাওয়ার আওয়াজ শুনে সবাই পিছনে লাইট মারে। দেখতে পায় নেহা পিছনে পরে আছে। রিফাত দ্রুত গিয়ে নেহাকে টেনে তুলে। কিন্তু ততক্ষনে কুকুরটা এসে নেহার গায়ের উপর ঝাপিয়ে পরে। এমন সময় ফাহাদ দৌড়ে এসে হাতে থাকা টর্চ দিয়ে কুকুরটার মাথায় একটা আঘাত করে। হাতের টর্চ টা ভেংগে যায়। কুকুরটাও একটু পাশে ছিটকে পরে। কিন্তু পরা মাত্রই আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তড়িৎ  গতিতে কি করতে হবে তা অনেকেই চিন্তা করতে পারেনা। তবে দৌড়াতে দৌড়াতে ফাহাদ ফাহিমকে বলে- "ফাহিম সামনে দেখ দালান ঘর, ওখানে চল। নিরাপদ কোন জায়গা পেতে পারি।"
যেহেতু ফাহাদের হাতে লাইট নেই সেহেতু ফাহিম আগে আগে ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফাহিম ফাহাদের কথা মত দৌড়ে একটা দালান ঘরের সামনে চলে আসে। ঘরটার দরজাটা বাহির থেকে ছিটকিনি দিয়ে লাগানো। তালা মারা নেই। সাত পাঁচ না ভেবে ফাহিম দরজা খুলে ঢুকে পরে। পিছন পিছন ফাহাদ ঢুকে, তারপর নেহাকে সাথে করে রিফাত। ঢোকার পরপরই দরজা লাগিয়ে দেয় ওরা। কুকুরটা ওদের পিছন পিছন দৌড়ে এসে লুটিয়ে পরে বাড়ির দরজার সামনে। চারজনই হাপাচ্ছে। ফাহিমের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খায় সবাই। হঠাৎ নেহা খেয়াল করে ওর জামা বুকের সামনে থেকে অনেকটাই ছিড়ে গিয়েছে। হাত দিয়ে বুক ঢাকার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালায় ও। ব্যাপারটা বাকি তিনজন বুঝতে পারে। ফাহাদ তার শার্ট খুলে নেহার দিকে এগিয়ে দেয়। ঘড়িতে সময় ৪:৪৫ মিনিট। ফযরের আযান হবে ৫ টায়। সবাই ঠিক করে আজ সারাদিন ওরা এই বাড়িতে থাকবে। রাতে কাজ সেরে বের হয়ে যাবে।কিন্তু বাড়িটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। দালানের গায়ে লতাপাতা  জন্মে জানালাগুলোকে একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। লাইট জ্বালিয়ে আর কতক্ষন চলা যাবে!! ঘরে তো বিদ্যুৎ ও নেই। তবে দেয়ালে লাইট মেরে ওরা লন্ঠন দেখতে পায়। একহাত পর পর লন্ঠন গুলো সাজানো। আর একদম ছাদের সাথে লাগানো একটা ঝাড়বাতি। তাতে অসংখ্য অর্ধগলিত মোম রয়েছে। আগুন হলে হয়তো ঘরটাকে আলোকিত করা যাবে।দেয়াশলাই ছুড়ি দড়ি এসব সাধারণ জিনিস ফাহাদ ব্যাগে অনেক আগেই রেখেছিলো। এখন সেগুলো কাজে দিবে। চারজন মিলে চেষ্টা করে মোটামুটি সব লন্ঠন আর ঝাড়বাতিতে আগুন দিয়ে আলোকিত করে।এরপর হলো অবাক হওয়ার পালা। সবার মুখ কয়েক ইঞ্চি হা হয়ে যায়। একটা পরিত্যক্ত  বাড়ির ভিতরটা এমন সুন্দর হয় কিভাবে!! ওরা যেন কিছু সময়ের জন্য হা হয়ে গিয়েছিলো। চারদিকে আভিজাত্যের ছাপ।
দেয়ালে বাঘের মাথা, হরিণের শিং, নানা ধরণের তৈলচিত্রে আঁকা ছবি, ভারী কাঠের আসবাবপত্র, আর তারপরেই চোখে পরে শ্বেত পাথরের বাঁধাই করা কারুকার্য করা হাতলসহ একটা সিঁড়ি। যা দোতালার দিকে উঠে গিয়েছে। সবাই উদ্দেশ্য ভুলে বিষ্ময়ে মোহিত হয়। সবাই মিলে ঠিক করে উপরে যাবে ওরা। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাহাদ দেয়াল থেকে একটা লন্ঠন নামিয়ে নেয়। তারপর চারজনকে সাথে নিয়ে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে যায়। উপরেও একই রকম, ঘর আলোকিত করার জন্য কাঁচের চিমনিযুক্ত লন্ঠন। সবগুলো জ্বালানোর পর ওরা আগের চেয়েও বেশি অবাক হয়। কারণ দোতলার উপর অনেক বড় একটা ভেন্টিলেটর, যার সাথে সারি সারি রুম। এগুলো হয়তো শোবার ঘর। প্রতিটা ঘরে ভারী ভারী কাঠের দরজা। দরজাগুলোতে বাঘ, সিংহের নকশা খোদাই করা। ঘুরে ঘুরে ওরা যত দেখছে, অবাক না হয়ে পারছে না। হঠাৎ ওদের নাকে আসলো বেলী ফুলের গন্ধ। খুব সুবাসিত সে ঘ্রাণ। জমিদাররা আসোলে কেমন বিলাসী জীবনযাপন করত তা এই পরিত্যক্ত ঘর দেখলেই বুঝা যায়। অনেক ক্লান্ত ওরা। আপাতত  সাথে করে আনা শেষ খাবারটুকু খেয়ে একটা ঘুম দিতে হবে। রাতে আবার অনেক কাজ। ঘুমানোর জন্য কামড়া খুজতে থাকে ওরা। এর ভিতর নেহা জানায় ওর ওয়াশরুমে যেতে হবে। ছেলেদের বেলায় এই ব্যাপারটা হলো আড়ালে দাঁড়িয়ে ছেড়ে দাওয়ার মত। কিন্তু মেয়েদের বেলায় তো আর তেমন না। এসব ভেবেই হয়ত বিরক্তির চোখে ফাহাদ আর ফাহিম রিফাতের দিকে তাকায়। কেন ও নেহাকে নিয়ে আসলো। নেহা ওদের চোখের ভাষা বুঝতে পারে। ও বলে- "আচ্ছা,  আমি ঠিক আছি।"
বাসা থেকে মিথ্যা বলে বের হয়েছিলো সবাই। পিকনিকের কথা বলে। ওদের প্লান ছিল এখান থেকে সোনা- গহনা উদ্ধার করে সোজা ঢাকা চলে যাবে। সেখানে কোন এক দোকানে বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে।  তাই বাসা থেকে আগেই দিন কয়েকের সময় নিয়ে এসেছে ওরা। সাথে সামান্য কিছু জামাকাপড়  থাকলেও খাবার দাবার তেমন নেই বললেই চলে। বিভিন্ন ধরনের আলাপ আলোচনা করতে করতে ওরা একটা কামরা খুঁজে পায়, বেশ বড়। দরজায় বিভিন্ন ধরণের নগ্ন মেয়েদের ছবি আঁকা। ফাহিম দরজা দেখেই ধারণা করে, এটা বোধ হয় জলসা ঘর ছিলো। এরপর ওরা ঢুকে পরে কামরার ভিতর। লন্ঠনগুলো জ্বালিয়ে দেয়। সেখানে  শোয়ার জন্য কিছু বেড আছে। লাল কাপড়ে ঢাকা।ধুলোমাখা চাদর দিয়ে ঢাকা তবলা, হারমোনিয়াম, কাঠের শো-কেস এ রাখা মেয়েদের পায়ের ঘুংগুর  সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে ওরা। এ রুমের সাথে মিশানো আরেকটা ছোট রুম। সে রুমটায় বড় বড় আয়না দিয়ে মোড়ানো। এখানে হয়ত নর্তকীরা মেকাপ করতেন।
নেহা চুপি চুপি তার ফোন বের করে। সেলফি তোলার  লোভ সে কিছুতেই সামলাতে পারছিল না।কিন্তু ফোন বের করেই অবাক হতে হয়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ৯০% চার্জ ছিলো ফোনে। এখন ফোন অফ!! কয়েকবার অন বাটন প্রেস করেও কাজ হচ্ছিলো না। ফোন অন হচ্ছেনা। অনেক অদ্ভুত ব্যাপার হলেও সব কিছুই ঠিক ছিলো, যতক্ষন পর্যন্ত না ফাহিম খেয়াল করলো তার ঘড়িটা আর চলছে না। এটা জানানোর পর সবাই নিজ নিজ হাতের দিকে তাকালো।

(চলবে...)
লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ
গল্প: সার্ভাইভ
পর্ব: ১

Post a Comment

Previous Post Next Post