গল্পঃ এ উইজার্ড, পর্ব : ২,লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।


গল্পঃ  এ উইজার্ড
পর্ব : ২
________
" রিভার্স ডক্টর " নাম করণটার পেছনে রয়েছে অজানা একটা গল্প। যেটা গল্পটা শুধু ফাহাদ ই জানে। অন্য কেউ নয়। অন্য কেউ জেনে থাকলেও সে বেঁচে নেই এখন। রিমোট কন্ট্রোলার দিয়ে দরজাটা লক করে নেয় ফাহাদ। লাইট অফ করে চেহারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে সে।
.
.
.
.
নিকোলাস কায়রোতে পা রাখে ২৪ বছর বয়সে।
ইবনী সে সময়ে ছিল কায়রো শহরের ড্রাগসের মেইন ডিলার। সর্বপ্রথম নিকোলাস ইবনীর একজন হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে কাজ করা শুরু করে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো ইবনী নিকোলাসের মাধ্যমে করিয়ে নিলেও তাকে তার প্রাপ্যটা কখনোই কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয় নি। ইবনী ছিলো ঠকবাজ ও ধূর্ত প্রকৃতির। পক্ষান্তরে নিকোলাস ছিল কাজের প্রতি একনিষ্ঠ। মানুষকে ঠকানোর মনোভাব তার ভিতরে ছিলো না।
নিকোলাস একসময় ইবনীকে তার ঠকবাজ মনোভাবের জন্য ও টাকার হিসেবে গড়িমসি করার জন্য মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করে।
মানুষের মনের ভাব আস্তে আস্তে তার কাজ ও কথায় প্রকাশ পায়। নিকোলাসের বেলায় ও তাই হলো। সে তার সহকর্মীদেরকে ইবনীর টাকা সাফাইয়ের ব্যাপারে বলে বেড়াতে লাগল।একসময় এক কান দু কান করে সব কর্মীদের কানে ইবনীর দুর্নাম ছড়িয়ে যায়। ইবনী এসব ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি।অগোচরে সবার মনে ইবনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলতে থাকে।
যারা ড্রাগসের পরিবহনের সাথে যুক্ত ছিল তাদের বড় একটা অংশ ছিল শহরের ছোট বড় গ্যাংস্টাররা।এদের সবাই পাবলিক প্লেসেও লোডেড আর্ম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।পুলিশ ও এদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। স্পেশাল মিশন ছাড়া হুট করে এদের উপর হামলা করলে নিজেদের জানটাই খুইয়ে ফেলতে হবে। একজনকে গুলি করলে রাস্তার আশে পাশের বিল্ডিং থেকে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষন শুরু হয়। তবে এইসব গ্যাংস্টার দের উপর কয়েক মাস পর পর ই ইনকাউন্টার চালানো হয়। তখন প্রশাসনের সবাই আট ঘাট বেঁধে আসে।তারপর কিছুদিন সব ঠান্ডা থাকে, তবে কয়েক সপ্তাহ পার হলেই আবার শহরটা পিঁপড়ার মত দলবদ্ধ ক্রিমিনালে ভরে যায়। সুতরাং এদের যে কেউ চাইলেই ইবনীর মাথার ভিতর দুটো কাঁঠালের বিচি ঠুকে দিতে পারত, কিন্তু লস টা তাদের ই বেশি হত।শহরে ড্রাগস ইম্পোর্ট এন্ড সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যেত। কারণ ইবনী ছাড়া বাইয়ার রা অন্য কারো সাথে ড্রাগসের জন্য ডিল করে না। এমনকি যারা ড্রাগস এ শহরে পাঠায় তাদের কাছেও ইবনী একটা বিশ্বস্ত নাম। ইবনীকে ছাড়া তারা মোটা অংকের টাকার ড্রাগস কায়রোতে সাপ্লাই দিবে না।সুতরাং ইবনীকে মেরে ফেলা একটা বোকামি বৈ আর কিছুই নয়।
ইবনীকে মেরে ফেলা ছাড়া একটা বিকল্প পন্থার দরকার ছিল এবং তারা তা পেয়েও গেল। বুদ্ধিটা বের করেছিল মূলত নিকোলাস ই। শহরের নামি দামি কয়েকটা গ্যাংস্টার দলের সাথে বৈঠকে বসে সে। প্লান করা হয়, ইবনীর ড্রাগস যখন টাকা পয়সার লেনদেন চুকিয়ে শহরে ঢুকবে তখন ইবনীর সিকিউরিটির উপর হামলা করে ড্রাগস হাতিয়ে নিতে হবে। কোন কোন পথে ড্রাগস আসে সেটা নিকোলাস খুব ভালো ভাবেই জানত।তবে কাজটায় রিস্ক ছিল। ইবনীর সিকিউরিটি ও খুব কড়া, গোলাগুলিতে অনেকেই হতাহত হতে পারে আবার পুলিশও থার্ড পার্টি হিসেবে অবতরণ করতে পারে।তবে সকল সাবধানতা অবলম্বন করেই বুদ্ধীমান নিকোলাস সবাইকে প্লান বুঝিয়ে দেয়। অঘোষিত ভাবেই নিকোলাসকে গ্যাংস্টার দলগুলো বস ভাবতে শুরু করে।
এরপরে আসে কাঙ্ক্ষিত সে দিন।তেমন কোন ঝামেলা ছাড়াই ৭ টি প্রাইভেট কার আটক করে সব ড্রাগস হাতিয়ে নেয় নিকোলাস ও তার দল। সেদিন ইবনীর সাথে চূড়ান্ত বাটপারিটা করে ওর সিকিউরিটি গানস ম্যান রা। ওরাও গিয়ে নিকোলাসের গ্যাং দের সাথে যোগ দেয়।তাই গোলাগুলির ঝামেলা পোহাতে হয় নি তেমন।
প্রায় ১২ কোটি পাউন্ডের ড্রাগস জিম্মি করে নিকোলাস। কিন্তু সমস্যা ছিলো একটাই। নিকোলাসের কাছ থেকে কেউ ই ড্রাগস কিনবে না।শহরে সাপ্লাই দিতে হলে সেই ইবনীকেই লাগবে তাদের।
.
ওদিকে ড্রাগস সহ গাড়ি লোপাট হওয়ার খবর শুনে ইবনীর যেন হার্ট এট্যাক করার মত অবস্থা হয়। এত্তগুলো টাকা লোকসান হলে সে আর কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবে না। তার সপরিবারে মৃত্যু নিশ্চিত।যারা উপর থেকে ড্রাগ সেল করে ইবনীর কাছে, তারাই ইবনীকে ইধাও করে দিবে ড্রাগসের টাকা কড়ায় গন্ডায় বুঝে না পেলে।
অবশেষে নিকোলাসের কাছে গিয়ে হাত জোড় করতে হয় ইবনীর। বুদ্ধিমান নিকোলাস ও চুক্তি সেরে ফেলে, শহরে যত টাকার ড্রাগস ঢুকবে তার হিসেব নিকোলাস কে দিতে হবে। এবং সব ড্রাগস সেল হবার পরে যে লভ্যাংশ থাকবে তার ৮০ শতাংশ নিকোলাস ও তার দল নিবে। বাকি ২০ শতাংশ ইবনীর। সিকিউরিটি এবং পরিবহনের দায়িত্ব নিকোলাসের ছেলেদের। ইবনীর কাজ হবে শুধু ডিল করা।
ইবনীর মনে মনে নিগ্রো নিকোলাসকে গাল দিতে দিতে চুক্তি মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না সেদিন।
এভাবেই হঠাৎ করে গ্যাংদের গডফাদার বনে যায় নিকোলাস। তবে নিকোলাস সবার পাওনা টাকা প্রতিশ্রুতি মত শোধ করে দিত, এবং তার দলের কেউ কোন কাজ করতে গিয়ে আহত বা নিহত হলে তার পরিবারের পুরো দায়িত্ব নিকোলাস নিজের কাঁধে নিত। সুতরাং গডফাদার হিসেবে সে হঠাৎ করেই অনেক জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় ।
.
শহরের অলি গলি থেকে বেকার যুবকরা নিকোলাসের দলে যোগ দিতে আরম্ভ করে। সেই সাথে স্রোতের টানে চলে আসে ফাহাদ নামের এক ১৭ বছরের যুবক ও।
.
.
.
ফাহাদ নিজেও ছিল নিকোলাসের মতই কর্মনিষ্ঠ এবং সৎ। এ জন্য খুব তাড়াতাড়ি সে নিকোলাসের বিশ্বাসের পাত্র হয়ে ওঠে এবং নিকোলাস তাকে নিজের সাথে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে শুরু করে। নিকোলাসের সাথে মোট ৭ জন লোক সব সময় বডি গার্ড হিসেবে থাকত। ফাহাদ ছিলো তাদেরই একজন এবং নিকোলাসের সবথেকে প্রিয় ব্যাক্তি।এর কারণ ও ছিল Ruger LCR ( ছোট পিস্তল) চালাতে ঐ ৭ জনের ভিতর সবথেকে পারদর্শী ছিল ফাহাদ ই।
.
.
গ্যাং দের ভিতর চলতে চলতে ইবনী ও নিকোলাসের কাহিনী টা আস্তে আস্তে জেনে যায় ফাহাদ। সবাই একজায়গায় আড্ডা দিলে এক কথায় দু কথায় অনেক কথা উঠে।ইবনীকে ভালোভাবেই চিনত সে। নিজ থেকেই গিয়ে গিয়ে কথা বলত ইবনীর সাথে। অবশ্য এর কারণ ও ছিলো। ইবনীর একজন সুন্দরী ভাতিজি ছিল। ফাহাদের ইচ্ছে ছিল ইবনীকে পটিয়ে পাটিয়ে ওর ভাতিজির সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় বের করা।
ইবনী মুখে হাসি খুশি থাকলেও নিকোলাসের উপর যে ইবনীর অনেক রাগ জমে ছে সে সম্পর্কে ফাহাদের বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিলো না। সেদিন ক্লাবে বিয়ার খেতে খেতে নিকোলাস কে খুন করাতে হবে, এ প্রস্তাবটাই দিয়ে বসে ইবনী।
ফাহাদ গিয়ে নিকোলাস কে বলে দিলেও ইবনীর কোন সমস্যা হত না। কারণ নিকোলাস নিজেও জানে ইবনী সুযোগ পেলে তাকে খুন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। ইবনী যাস্ট সিচুয়েশনের ফাঁদে পরে নিকোলাস কে মেনে চলে।কিন্তু নিকোলাস এটাও জানে, ইবনী তাকে মেরে ফেলে পালাতে পারবে না কোথাও। পুরো শহরে নিকোলাসের লোক গিজগিজ করছে। নিকোলাস খুন হলে সবার আগে ইবনীর দেহ টুকরো টুকরো করে মরুভূমিতে ফেলে আসা হবে। গ্যাংস্টারদের কলিজার টুকরো, ভালোবাসার মানুষ হচ্ছে নিকোলাস। পর্যাপ্ত পরিমান অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে পেয়ে যাওয়ায় প্রতিটা সদস্য কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলে যায় তারা ক্রাইম করছে, তাদের মনে হয় তারা যেন নিকোলাসের অফিসে প্রফেশনাল জব করছে। ইবনী নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়ার মত বোকা নয়।
তবে নিকোলাসের কনফিডেন্স একটু বেশি ছিল।সে ভেবেছিল তার দলের কেউ তার সাথে বেঈমানি করবে না। অন্তত তার বডিগার্ড রা তো না ই। আর ফাহাদ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটা কল্পনায় ও ভাবত না নিকোলাস।
কিন্তু একসাথেই যদি এক লক্ষ পাউন্ড পাওয়া যায়, তবে সপ্তাহে এক হাজার পাউন্ড বেতনের জন্য কে ই বা অপেক্ষা করে!! এ কথাটাই সেদিন ভেবেছিলো ফাহাদ।
কিন্তু শর্ত ও ছিলো, এমন ভাবে খুন টা করতে হবে যেন মনে হয় এক্সিডেন্ট ; যদি কেউ বুঝে ফেলে যে নিকোলাস খুন হয়েছে তবে নিকোলাসের লোকেরা ঠিক খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলবে কারা এ কাজ টা করেছে। তখন সবার ফাঁসতে হবে। ফাহাদ ইবনীর কথার কোন উত্তর দেয় না। শুধু ঘাড় টা কাত করে একটা ঠান্ডা হাসি দেয়।
.
.
.
সেদিন রাতে নাইটক্লাবে রমনীদের নিয়ে উৎসবে মেতেছিল নিকোলাস। এক পর্যায়ে নিকোলাস দুটো মেয়ে নিয়ে বিলাসবহুল রুমে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়। বডি গার্ডরা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। জরুরী বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে ফাহাদ সটকে পরে পার্টি থেকে। বাথরুমে ঢুকে ড্রেস চেঞ্জ করে মুখে মাস্ক পরে নেয় সে।
অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজটা সম্পন্ন করতে হবে ।বাইরে এসে সবার চোখের আড়ালে
নিকোলাসের গাড়ির গিয়ারবক্স জ্যাম করে দেয় সে।এতে গাড়ি একেবারে উপরের গিয়ারে তুললে আর নিচের দিকে নামানো যায় না।এরপর
সে গাড়ির ব্রেকের তার কেটে ফেলে, এক্সিলেটরে মাল্টিট্রিগার অটোইগনিশন সিস্টেম লাগিয়ে দেয়।ফলে এক্সিলেটরে পা দাবানোর সাথে সাথেই অটোইগনিশন ট্রিগার অন হয়ে গাড়ি ফুল এক্সেলেরশনে চলতে শুরু করে। যা পরে পা সরালেও বন্ধ হয়না।
কাজ সেরে চলে আসার সময় ইবনীর ডাক শুনে পিছনে তাকায় ফাহাদ।
ইবনী: কাজ হয়েছে?
ফাহাদ মুখোশ সরিয়ে জবাব দেয়, মিশন কম্পলিট।
.
বোকা নিকোলাসের ড্রাইভার নিকোলাস কে নিয়ে গাড়িতে উঠেই সেই রকম একটা ভাব নিয়ে গাড়ি হাই স্পিডে টানতে শুরু করে।
একবার যে শুরু হলো, আর থামল না। চলন্ত
একটা মালবাহী ট্রাকের নিচে চাপা পরে নিকোলাসের বিলাসবহুল গাড়িতেই প্রাণ হারায় সে ও তার ড্রাইভার।খবরের কাগজেও বিজনেসম্যান নিকোলাসের এক্সিডেন্টে মৃত্যুর কথাটাই বড় বড় হরফে ছাপা হয়।
.
ইবনী আবার দখল করে নেয় নিকোলাসের জায়গাটি। নিকোলাসের সম্পত্তির উত্তারাধিকারী না হলেও ক্ষমতার একমাত্র উত্তরসূরি ইবনী ই ছিলো।
নিকোলাসের মৃত্যুতে ক্রাইম ওয়ার্ল্ডে শোকের ছায়া নামে। ইবনীর আগের ধুরন্ধরী নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায় না তেমন।
কিন্তু কুকুরের লেজ সোজা হয়না কখনো।
ফাহাদ তার কাজের পেমেন্ট চাইতে গেলে ইবনী তাকে টাকা তো দেয় ই না বরং সেদিনের একটা ভিডিও বের করে ফাহাদের সামনে প্লে করে। ভিডিতে ফাহাদের মুখ মুখোশে ঢাকা থাকলেও সে যে ইবনীর সামনে এসে মুখোশ খুলে কথা বলেছিল। নিজেকে স্যান্ডুইচের মাঝে ফেঁসে যাওয়া অবস্থায় উদ্ধার করে ফাহাদ।
ইবনী ফাহাদকে ব্লাকমেইল করতে শুরু করে।
সেদিন ইবনীর সাথে যারা বেঈমানি করেছিলো, তাদের সবাইকে আস্তে আস্তে খুন করার প্রস্তাব দেয় হয় ফাহদকে ।
ফাহাদ ঝটপট চিন্ত করে ফেলে ঝুঁকি নিয়ে গ্যাংস্টার দের সাথে ঝামেলায় লাগা সহজ?? নাকি আধবুড়ো একটা অকৃতজ্ঞ লোক কে উপরে পাঠিয়ে দেয়া সহজ!! উত্তরটাও তাৎক্ষণিক ভাবেই পেয়ে যায় রিভার্স ডক্টর।
( চলবে)
.
.
.
লেখক: হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।

Post a Comment

Previous Post Next Post