গল্পঃ ব্লাক ক্যাফেটেরিয়া | লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ | পর্বঃ৪

গল্পঃ ব্লাক-ক্যাফেটেরিয়া  পর্ব ৪

লেখকঃ হাসিবুল ইসলাম ফাহাদ।



আস্তাবলে রিওর মন খুব ছটফট করছিলো। বার বার মনে পড়ছিলো হেলেনকে, বদ আলফাটা হেলেনকে ঠিক ভাবে দেখেশুনে রাখতে পেরেছে কিনা সেটা নিয়েও বেশ সন্দিহান হয়ে পরে রিও।আলফা রিওর মত বিদ্যুৎ বেগে তো আর ছুটতেও পারে না!! আলফার বড় বড় দাঁত না থাকলে রিও অনায়াসেই আলফাকে পেশি শক্তিতে হারিয়ে দিতে পারতো।
এদিক সেদিক নড়াচড়া করে রিও সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক না কেনো হেলেনের কাছে যাবে সে। ছোটবেলা থেকেই এখানে বড় হয়েছে রিও। গলায় কখনো দড়ি লাগিয়ে রাখা হতো না তার। আস্তাবলের দরজার ছিটকিনিটা প্রতিদিন বিলওয়াল কিভাবে টেনে খুলে এতদিনে রিওর তা জানা হয়ে গিয়েছে।
একটু চেষ্টা করে দেখতে তো আর ক্ষতি নেই।
আস্তাবলের ছোট দরজার উপরের ফাঁকা থেকে গলা বের করে জিভ দিয়ে ছিটকিনিটা খুলে ফেলার অনেক চেষ্টা করতে থাকে রিও। কিন্তু বার বারই পিছলে যাচ্ছিলো। এদিকে জোরে শব্দ হলে বিলওয়াল উঠে যেতে পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে তার। কিন্তু বার বার জিভ দিয়ে চেষ্টা করার পরও রিও কিছুতেই ছিটকিনির হাতল উঠিয়ে দরজা খুলতে সামর্থ্য হচ্ছিলো না।
শেষমেশ একটা নতুন বুদ্ধি মাথায় খেলে যায় তার।
আস্তাবলের কাঠের দেয়ালে খুব জোরে তার শক্ত খুড় দিয়ে লাথি দিতে শুরু করে। শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বিলওয়াল।
তাড়াতাড়ি ছুটে যায় আস্তাবলে।
রিও বিলওয়াল কে দেখেই ভয়ানক ভাবে লাফাতে শুরু করে। রিও ইঁদুর খুব ভয় পায়, ওর থাকার জায়গায় যখন ইঁদুর ঢুকে যায় তখন ও এমন আচরণ করে। বিলওয়াল ভাবে রিওর ঘরে আবারো ইঁদুর ঢুকেছে। সে একটা ছোট লাঠি হাতে নিয়ে আস্তাবলের দরজা খুলে ইঁদুর তাড়ানোর জন্য ভেতরে ঢুকে। এইতো সুযোগ! আর এক মুহূর্ত ও দেরী করে না রিও। বিলওয়ালের মাথার উপর দিয়ে ছোট্ট একটা লাফ মেরে আস্তাবলের বাইরে চলে আসে সে।বোকা বনে যায় বিলওয়াল, একটা ঘোড়া তাকে গাধা বানিয়ে দিলো!!
কিন্তু আস্তাবলের বাইরে আসাটাই শেষ বাঁধা ছিল না। এরপর এরিকের বিশাল ইটের তৈরি প্রাচীর ডিঙাতে হবে। প্রায় পনের ফিট উঁচু প্রাচীর লাফ দিয়ে ডিঙানো তো রিওর পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে বিলওয়ালও রিওকে ধরার জন্য ছুটে এসেছে পেছন পেছন। এদিক সেদিক তাকাতে থাকে।
আস্তাবলের পাশেই রাজহাঁস দের ছোট্ট একটা ঘর করা ছিল। রিও দৌড়ে গিয়ে সেই ঘরের ছাদে উঠে গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে একটা লাফ মারে।
এত জোরে আগে কখনো লাফ দেয়নি রিও। নিজেই অবাক হয়ে যায় সে,নিজের অজান্তেই প্রাচীরের উচ্চতার ও কয়েক হাত বেশি উপরে লাফিয়ে উঠে গিয়েছে।
সামনের দুপায়ের উপর ভর দিয়ে মাটিতে অবতরন করে ঠিক ভাবেই। তবে সামান্য ব্যাথাও লাগে রিওর ডান পায়ে।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিলওয়াল প্রাচীরের দরজা খুলে বাইরে আসে।
বিলওয়াল এর দিকে তাকিয়ে, চিহিহিহি করে একটা ডাক দেয় রিও, রিও আসলে বিলওয়াল কে হাসতে হাসতে বলেছিলো, গাধারাম তুমি কি আমাকে এখন ধরতে পারবে!!
বিলওয়াল এর চোখের সামনেই বাতাসে ধুলো উড়িয়ে প্রচন্ড ঝড়ো গতিতে ছুট দেয় রিও। চোখের পলকেই অদৃশ্য হয়ে যায় বিলওয়ালের সামনে থেকে।
তেজী, দীপ্ত-মান ও শক্তিশালী ঘোড়া রিও।
জন্ম থেকেই হেলেনের গায়ে কাঁঠালচাঁপা ফুলের একটা তীব্র ঘ্রাণ ছিলো, রিও সে ঘ্রাণ খুব ভালো ভাবেই আঁচ করতে পারতো। বাতাসে হেলেনের গায়ের ঘ্রাণ অনুসরণ করেই জংগলের পথে তার শক্ত খুড় চালিয়ে দুর্বার বেগে ছুটতে থাকে রিও।
গাঢ় অন্ধকারে চলতে, আলফার মত দক্ষ না হলেও সমস্যা হচ্ছিলো না। চাঁদের আলো সঙ্গী দিচ্ছিলো একাকী রিওকে।
.
.
.
জুতোর শক্ত হিলে খট খট শব্দ তুলে নির্বিকার ভাবে ভিতরে প্রবেশ করে গায়ে চাদর জড়ানো লোকটি। কাঁঠালচাপা ফুলের একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগে তার নাকে।
ক্যাফেটেরিয়ায় বসা বৃদ্ধ ক্রুইফ সাহেবের অসহায় চেহারা চোখে লাগে তার। আস্তে আস্তে হেঁটে ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরের দিকে এগিয়ে যায় লোকটি।
একটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় পাঁচজন বলিষ্ঠ দেহের পাথরের নিচে চাপা পরে পিষে যেতে নিচ্ছে একটি কাঁঠালচাপা ফুল।
কিন্তু তাতে লোকটির কোন আগ্রহ নেই। দৃঢ় ভারী কন্ঠে সে পাঁচজনকেই উদ্দেশ্যে বলে, "এখন আমার চা খাওয়ার সময়। আমি নিরবতা পছন্দ করি। "
গুরুগম্ভীর কন্ঠে গুছানো কথাটা শুনতে যেনো একদমই ভালো লাগে নি হেলেনকে তাড়া করে নিয়ে আসা লোকগুলোর।
পাঁচজনই সমস্বরে হেসে উঠে। ওরা নিজস্ব সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের মাঝে কিছু একটা বলে।
একজন এগিয়ে আসে চাদর জড়ানো লোকটির দিকে। কোমর থেকে ধারালো একটা ছুড়ি বের করে তার গালে এপিঠ ওপিঠ ঘষে হলুদ ময়লা যুক্ত দাঁত নিয়ে একটা বিশ্রী হাসি দেয়। উত্তেজিত না হয়ে চাদরের ভেতর থেকে ধীর গতিতে ডান হাত বের করে লোকটি। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে বনদস্যু দলের সদস্যটির বুকের উপর আস্তে একটি চাপড় মারে লোকটি। ঝন ঝন শব্দে জানালার কাঁচ ভাঙ্গার আওয়াজ এবং আর্তনাদের শব্দে চমকে উঠে উপস্থিত সবাই। সামান্য এটুকু আঘাতেই ক্যাফেটেরিয়ার জানালা ভেঙ্গে ক্রিকেট বলের মত রাস্তার ওপাশের জলাশয়ে গিয়ে পতিত হয় বনদস্যুটি।
বাকি চারজন এ দৃশ্য দেখার পরে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু।
কিন্তু নিরাশ না হয়ে চারজনই একযোগে আক্রমণ করতে ছুটে আসে অদ্ভুতুড়ে লোকটির দিকে। কোন প্রকারের আঘাত করতে ব্যর্থ হয় তারা। লোকটি ওদের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে ফড়িং এর পাখা ধরার মত-ই বাকি চারজনের ঘাড় ধরে এক এক করে ভাঙ্গা জানালা থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়। একটু পর পর পাঁচজনেরই আর্তচিৎকার শুনতে পায় ক্রুইফ সাহেব। খানিক বাদে লাঠিতে ভর দিয়ে কম্পিত হাতে চা নিয়ে আসেন তিনি। চোখে দেখতে না পেলেও ঠিক ই আঁচ করতে পেরেছিলেন কি ঘটনা ঘটেছিলো সেখানে।
লাঠিতে ভর দিয়েই আস্তে আস্তে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকা হেলেনের দিকে এগিয়ে যান বৃদ্ধ ক্রুইফ। গায়ে গেঁথে থাকা বিষাক্ত ছোট তীরগুলো টেনে বের করেন একে একে।আশেপাশে কোন চিকিৎসালয়ও নেই। চা শেষ করে উঠে দাঁড়ানোর পরে চাদরের ভেতর থেকে বেশ অনেকগুলো টাকার নোট বের করে ক্রুইফের দিকে ছুড়ে মারে লোকটি।
- এতগুলো টাকা..
"জানালাটা ঠিক করে নিবেন।"
- তোমার নাম কি বাবা?
বেশ অনেকক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকার পরে গম্ভীর কন্ঠে উত্তর সেয়,
"ওহমা.."
"ওহমা তকিতা",
এরপর লোকটি আস্তে আস্তে সামনের দিকে হেঁটে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকেন ক্রুইফ।
.
.
.
.
.
এদিকে রিও ছুটতে ছুটতে চলে আসে টিলার কাছে। এসেই হেলেনের ঘ্রাণ হারিয়ে ফেলে। তীব্র পঁচা মাংসের ঘ্রাণ এসে লাগে তার নাকে। এর উপরে হালকা বৃষ্টিও হচ্ছে এখানে।লক্ষ্যহীন ভাবে এদিক সেদিক ছুটতে থাকে রিও। হঠাৎ কানে আসে অদূরে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে ঢাক ঢোলের উৎসব মুখর আওয়াজ,রিও উৎসুকভাবে শব্দ অনুসরণ করে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। আরেকটু কাছাকাছি পৌঁছাতেই রিও খুব পরিচিত একটা কন্ঠস্বর শুনতে পায়, মাথা ঝাকায় সে!! এটা কি ঠিক শুনছে!
আরেকবার ঘাড় কাঁত করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে । হ্যাঁ কিছুতেই ভুল হতে পারে না তার, কুঁই কুঁই শব্দ তুলে কান্না করছে আলফা। বিপদ টের পায় রিও। কোন প্রকার দেরী না করেই ছুটতে শুরু করে আলফার কান্নার শব্দ অনুসরণ করে।
.
.
.
ক্যাফেটেরিয়ার চুলার আগুনে বৃদ্ধ ক্রুইফ তার রুমাল গরম করে হেলেনের ক্ষত স্থান গুলোয় ভাপ দেয়। হাত পা কুসুম গরম তেল দিয়ে মালিশ করতে থাকে বসে বসে। তারপরও জ্ঞান ফিরে আসছে না দেখে চোখ মুখে পানির ছিটে দেয়ার জন্য উদ্যত হয় ক্রুইফ। কিন্তু মুখে তো নকশা করা মুখোশ লাগানো মেয়েটার।
খোলার জন্য ক্রুইফ হাত বাড়িয়ে মুখোশ টা ধরতেই অন্য একটা হাত এসে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে। ব্যাথায় ক্রুইফের মুখ থেকে আহ করে শব্দ বের হয়। চোখ মেলে তাকায় হেলেন। ক্রুইফের হাত ছেড়ে দেয় সে।
বৃদ্ধকে দেখেই চিনতে পারে ।
কোন কথা না বলে বিষ্ফোরিত চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ঐ লোকগুলো কোথায়!!
ক্রুইফ উত্তর দেয়,
- ওহমা ওদের মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। ও না থাকলে আজ হয়ত তোমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত।
- তুমি কে মা?
ওহমা নাম শুনতেই হেলেনের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দরজায় দাড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটির কথা।
এ যাত্রায় বড় বাঁচা বেঁচে গেছে হয়তো হেলেন।
কাতর স্বরে হেলেন বলে করে, 'ওহমা!!'
তিনি এখন কোথায়!
ও তো চলে গিয়েছে।
- একটা ধন্যবাদও দিতে পারলাম না তাকে।
শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই দুর্বল শরীর নিয়ে পরে যায় হেলেন।
অনেক রাত হওয়ার পরেও বাসায় না ফেরার কারণে ক্রুইফ সাহেবের স্ত্রী এবং তাদের সাথে থাকা ছেলেটি ক্যাফেটেরিয়ায় চলে এসেছে।
এসে হেলেনকে আহত অবস্থায় দেখতে পায়। ক্রুইফ সাহেব সব খুলে বললে, তারা ঠিক করে আপাতত এই মেয়েটাকে একা ছাড়া যাবে না। বাড়ি নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অতঃপর কোনরকম ধরাধরি করে হেলেনকে সাথে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনজনই।
.
.

বাসায় পৌঁছানোর পরে হেলেনকে খাঁটি গরুর দুধ এবং খাবার খেতে দেয়া হয়। কিন্তু হেলেন জানায় সে তার চেহারা উন্মুক্ত করতে পারবে না।
বৃদ্ধ ক্রুইফ দম্পতি এটা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করে না,
হেলেনকে আলাদা কক্ষে খেতে দেয়া হয়। দরজা বন্ধ করে
মুখোশ খুলে রেখে হেলেন খেতে বসে।
কিন্তু ওদের সাথে থাকা ছেলেটা দরজায় থাকা সামান্য ফাঁকা জায়গা থেকে হেলেনের চেহারা দেখার চেষ্টা করে।
আর এই চেষ্টাই তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সাথে সাথে অন্ধ হয়ে যায় ছেলেটি।
চোখে দেখতে না পাওয়ায় দ্বিকবিদিক হারিয়ে ছুট দেয় সে। খানিক বাদেই দেয়ালের সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পরে থাকে মেঝেতে।
খাওয়া দাওয়া শেষে, বিশ্রাম নেয়ার জন্য শুয়ে পরে হেলেন।
মনে মনে ভাবতে থাকে ওহমা নামক লোকটির কথা। হেলেনের অবশ্য একটু রাগও হচ্ছিল মনে মনে, পালোয়ান মার্কা পাঁচজন মানুষের হাত থেকে একটা মেয়েকে বাঁচানোর পরে তাকে আহত অবস্থায় রেখে কিভাবে কেউ চলে যেতে পারে!
মনে মনে এটাও ভাবে, যেহেতু পাঁচজন কে একাই হারিয়ে দিয়েছে, ওহমাও হয়তো হেলেনের মতই যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী কেউ একজন হবে। সুস্থ হওয়ার পরে অবশ্যই ওহমার সাথে একরাউন্ড ফাইট করে নিতে হবে।
কিছুক্ষন পরেই আবার আলফার কথা মনে পড়ায়, বিমর্ষ হয়ে পড়ে হেলেন। খুব কান্না পায় তার। চোখের পানি গড়িয়ে ভিজে যায় তুলোর বালিশ। নিরবে কান্না করতে করতে ঘুমের কোলে ঢলে পরে সে।

চলবে..
-

Post a Comment

Previous Post Next Post